ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী ॥ একশত অর্থনৈতিক জোন দিয়ে কী হবে?

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী ॥ একশত অর্থনৈতিক জোন দিয়ে কী হবে?

বুধবারের খবরের কাগজে অর্থনীতি ও ব্যবসার ওপর বেশ কয়েকটা খবর পড়লাম। একটা খবর হচ্ছে, এখন থেকে মূল্যস্ফীতির ওপর তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে দেয়া হবে, মাসিক ভিত্তিতে নয়। দ্বিতীয় খবরটি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। এতে বলা হয়েছে ডলারের দাম বাড়ছে, এখন বাজারে এর মূল্য এক ডলার সমান ৮৫ টাকা। সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পাউন্ডের দামও। এর দাম ১১০ টাকা। তৃতীয় খবরটি স্বস্তির, খুবই স্বস্তির। এতে বলা হয়েছে, রোজার মাসে বিক্রয়যোগ্য ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। আরও ভাল খবর খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রত্যেকটি ভোগ্যপণ্যের দর কমছে। এদিকে ‘ভ্যাট’ নিয়ে ব্যবসায়ীরা আছেন শঙ্কায়- এই হচ্ছে আরেকটি উদ্বেগের খবর। সবশেষে যে খবরটি আমার নজরে পড়েছে তা হলো বিনিয়োগের ওপর। দেশে বিনিয়োগ নয়, বিদেশে আমাদের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বিনিয়োগ। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন বলে একটি খবর ছাপা হয়েছে। এ ধরনের আরও অনেক খবর আছে যা ব্যবসা ও অর্থনীতি সম্পর্কিত। সব খবরের ওপর মন্তব্য করার সুযোগ হবে না। তাই শুরু করা যাক মূল্যস্ফীতি দিয়ে। মূল্যস্ফীতির তথ্য মাসে মাসে দেয়া হতো। আমদানি, রফতানি, রেমিটেন্স ও মূল্যস্ফীতির খবর প্রতি মাসে আমরা পেয়ে আসছিলাম। এর দ্বারা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝা যেত। হঠাৎ কেন এ সিদ্ধান্ত? পৃথিবীর সকল দেশই মূল্যস্ফীতির খবর নিয়মিত দেয়, প্রতি মাসে এমনকি- অর্ধমাসিক তথ্যও দেয়। ‘বিভ্রান্তি’র অজুহাতে বর্তমান ‘প্র্যাকটিস’ থেকে কেন সরে দাঁড়াল পরিকল্পনা কমিশন তা ঈশ্বরই কেবল জানেন। এর দ্বারা কী মূল্যস্ফীতি কমবে? চালের দাম হু হু করে বাড়ছে। প্রচুর গম আমদানির পরও চালের দাম ৮-১০ টাকা কেজিতে বেড়েছে। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও হালুয়াঘাট ইত্যাদি অঞ্চলে ‘ফ্ল্যাশ ফ্লাড’ হওয়ায় সেখানকার দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি ভয়াবহ। এদিকে কিছুক্ষণ আগেই পড়লাম ডলারের দাম বেড়ে ৮৫ টাকা হয়েছে। এতে রফতানিকারকদের আনন্দ হবে, কিছুটা আনন্দ হয়ত হবে প্রবাসীদেরওÑ তারা তাদের রেমিটেন্সের মূল্য বেশি পাবেন। কিন্তু টাকার এপিট-ওপিট দুই-ই আছে। ডলারের মূল্য বাড়লে আমদানিযোগ্য সকল পণ্যের মূল্যও বাড়বে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমদানিনির্ভর দেশীয় শিল্প। সবচেয়ে বড় কথা বারোটা বাজবে সাধারণ ভোক্তাদেরÑ লাখো-কোটি মানুষের। প্রতিটি জিনিসের মূল্য দিতে হবে বেশি। মনে রাখা দরকার মানুষের আয় কিন্তু বাড়ছে না। উপরন্তু খবর আরেকটি বেশ প্রবল। ‘ভ্যাট’ বসবে সর্বত্র ১৫ শতাংশ হারে। সেটা দুই মাস বাদে অর্থাৎ জুলাই থেকে। একটি খবরে দেখলাম আশপাশের দেশে যেখানে এই হার মাত্র ১২ শতাংশ অথবা আরও কম, সেখানে বাংলাদেশে তা হবে ১৫ শতাংশ এবং তা হবে নির্বাচনের বছরের পূর্বেই। এসব খবরে কী মনে হয়? মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী, ত্রৈমাসিক খবর দিলে কী ‘বিভ্রান্তি’ কমবে, বা মূল্যস্ফীতির হার কমবে? প্রশংসা সবাই করে সরকার মূল্যস্ফীতিকে খাঁচায় বন্দী করেছে? কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারণে যদি মূল্যস্ফীতি বাড়ে তাহলে কী ত্রৈমাসিক হিসাব দিয়ে তা থামানো যাবে, না তা কোন কাম্য পরিস্থিতি হবে? এই প্রশ্ন রেখে এবার আসি রোজার বাজারে। আর এক মাসও নেই পবিত্র রোজার মাস শুরু হবে। বস্তুত পুরো জুন মাসই থাকবে রোজা। জুন মাসেই দেয়া হবে বাজেট। শুনতে পাচ্ছি এটা হবে বিশাল বড় বাজেট, আগের চেয়ে অনেক বড় বাজেট। অনেক বড় বড় প্রকল্পের জন্য টাকার দরকার হবে। এই টাকা কী কর না বসিয়ে যোগাড় করা যাবে? মনে হয় না। বুঝলাম ১৫ শতাংশ ‘ভ্যাট’ না হয় বসানো হবে। এ দিয়েই কী বিশাল টাকা যোগাড় করা যাবে? যাক, এটা বাজেটের দিক। আমার আজকের বিষয় রোজার বাজার। এখন পর্যন্ত খবর প্রচুর আমদানি মালের। পাইকারি বাজারে দামও কম। ব্যবসায়ীরা লোকসান আতঙ্কে আছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এই অবস্থায় যদি বাজেটে নতুন নতুন কর প্রস্তাব থাকে তা হলে অবস্থা তো হবে বিপরীত। ব্যবসায়ীরা পুরো সুযোগ নিয়ে বাজার থেকে টাকা তুলে নেবেন। এমনিতে আবার পাইকারি বাজার ও খুচরা বাজার একভাবে ব্যবহার-আচরণ করে না। পাইকারি বাজারে দাম কমলেও খুচরায় কমে না। আবার পাইকারি বাজারে মালের দাম কিছুটা বাড়লে খুচরা ব্যবসায়ীরা এই অজুহাতে মালের দাম বাড়ায় মাত্রাতিরিক্ত হারে। এবার আবার ভিন্ন একটা খবর আছে। ডলারের দাম বাড়ছে। এটা একটা অজুহাত হতে পারে। যদিও তা হওয়ার কোন কথা নয়। কারণ রোজায় বিক্রয়যোগ্য মালের ‘ঋণপত্র’ (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা হয়েছে অনেক আগে যখন ডলারের দাম ছিল কম। ওই কম দামেই মাল এসেছে এবং এখন তা খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে। কিন্তু আমাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ী ভাইয়েরা কোন কিছুতেই থেমে থাকেন না। ‘ডান হাত’, ‘বাম হাত’ ও ‘অজুহাত’ যে কোন একটা পেলেই হলো তারা তার সুযোগ নেন। আমি মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রীকে সাবধান থাকতে বলব। ‘বাজার অর্থনীতি’র কথা বলে তিনি যেন হাত গুটিয়ে বসে না থাকেন। সরবরাহ যাতে পর্যাপ্ত থাকে তার দিকে নজর রাখাই বড় কাজ হওয়া উচিত। আদেশ, উপদেশ, পরামর্শ, ডর-ধমক দেখিয়ে অন্য দেশে কাজ হতে পারে, বাংলাদেশে যে হবে না তার বহু নজির আছে। একটা নজির নিচে দিচ্ছি। আমাদের একজন সরকার-ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে কেনিয়া, কম্বোডিয়া, জর্দানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বেশকিছু শিল্প-কারখানা করেছেন। তিনি মনে করেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের অবৈধ এই বিনিয়োগকে ধীরে ধীরে আনুষ্ঠানিক করে নেয়া দরকার। বোঝা গেল তিনি কী বলছেন? বলছেন, বিনিয়োগ তো হয়েই গেছে। অতএব, একে বৈধ করে দেয়া দরকার। এই যে বলছিলাম সরকারের আইন, উপদেশ কেউ মানে না। যদি মানত তাহলে বাংলাদেশীরা কীভাবে বিদেশে শিল্প করে? এটা করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাগে? আর এই অনুমতি বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণতভাবে দেয় না। কারণ, এত ডলার আমাদের নেই। ৩২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে। এই টাকার পুরো মালিক সরকার নয়Ñ সরকার ‘কাস্টডিয়ান’। দ্বিতীয়ত, এই ডলার ফুরাতে কয়দিন? এ প্রসঙ্গ বাদ, প্রশ্ন বিদেশে বাংলাদেশীরা কীভাবে বিনিয়োগ করল? সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশে আমাদের ব্যবসায়ীরা কিভাবে বিনিয়োগ করছে? করছে সরকারের নিয়ম-কানুন, আইন লঙ্ঘন করে। তাই নয় কী? এবং করছে সবার ‘নলেজের’ মধ্যে। ওপেন সিক্রেট। মজা হচ্ছে, এখন দেখা যাচ্ছে এই অবৈধ বিনিয়োগকে বৈধ করার একটা পাঁয়তারা চলছে। এর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি আদায় করা। সরকার মনে হচ্ছে রাজি। একটি খবর পাঠ করে আমার এই ধারণাই হচ্ছে। বলা হচ্ছে : ‘বাংলাদেশে বিশ্বমানের কিছু উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এটা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে হয়েছে, ওষুধের ক্ষেত্রে হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের নতুন প্রজন্ম অনেক সক্ষম ও প্রতিভাবান। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়।’ এ কথা কে বলছেন? বলছেন ‘বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’র (বিডার) চেয়ারম্যান। তার বক্তব্য পাঠ করে আমার মনে প্রথম যে প্রশ্ন জেগেছে তাহলো ‘বিডার’ কাজ কী? ‘বিডার’ কাজ কী বাংলাদেশীরা বিদেশে যাতে বিনিয়োগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা বা স্বদেশে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা? ‘বিডার’ চার্টার আমার সামনে নেই। তবুও এ কথা বলতে পারি বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের পক্ষে ওকালতি করার অনেক লোক আছে। ‘বিডার’ দায়িত্ব দেশে বিনিয়োগ বাড়ানো। সরকার ১০০টি ‘অর্থনৈতিক জোন’ করছে। সেখানে বিনিয়োগের ব্যবস্থা কে করবে? দেশে বেসরকারী বিনিয়োগের আকাল। বিনিয়োগের পরিবেশ নেই অভিযোগ তুলে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী বেআইনীভাবে বিদেশে শিল্প করছে। সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ এই প্রবণতা রোধ করা। ব্যবসায়ীদের স্বদেশমুখী করা। তা না করে ‘বিডার’ চেয়ারম্যান ‘তাল’ তুলেছেন ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিতে হবে। একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেছেন, আমাদের ব্যবসায়ীরা নাকি অনেক বড় হয়ে গেছেন। আমাদের বাজার ছোট। একটা বড় কোম্পানি হলে নাকি এর গায়ে আরেক কোম্পানির ধাক্কা লাগে। অতএব, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দরকার। তাহলেই প্রশ্ন একটি। বাজার যদি ছোট হয় তাহলে সারাদিন বিনিয়োগের পরিবেশ নেই পরিবেশ নেই বলছেন কেন? মুখে বলছেন ‘পরিবেশ’ নেই, অন্তরে হচ্ছে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি প্রাপ্তির কামনা। এই দ্বিচারিতা কেন? যদি এই ব্যবসায়ীর কথা সত্যি হয়, তাহলে সরকার ১০০ ‘অর্থনৈতিক জোন’ কেন করছে? এসবের জবাব দরকার। দেখা যাচ্ছে একটা প্রভাবশালী গোষ্ঠী ‘অবৈধকে বৈধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশে বিনিয়োগের নামে তারা ইতোমধ্যেই তৈরি অবৈধ কারখানাকে বৈধ করতে চাইছে। যদি তাই করতে হয় তাহলে অবৈধ দেশী-বিদেশী সব সম্পদ ও সম্পত্তি সম্পর্কেই সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ‘কালো’ টাকা বৈধ করা যায় না। বলা হয় তাতে নিয়মিত করদাতাদের প্রতি অবিচার করা হয়। একই যুক্তিতে বিদেশে অবৈধ বিনিয়োগকেও বৈধ করা যায় না। তাই নয় কী? পরিশেষে আমি সরকারকে একটা কথা বলব। ব্যবসায়ী নেতার কথাÑ বাংলাদেশের বাজার ছোট। এই বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হোক। যদি সত্যি সত্যি ছোট হয়, তাহলে অনেক বড় বড় আয়োজন সম্পর্কেই নতুনভাবে ভাবতে হবে। আর তা যদি সত্যি না হয়, তাহলে ব্যবসায়ীদের ঘরমুখো করার চেষ্টা করতে হবে। এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে শেষ করব। একজন অর্থনীতিবিদ দুদিন আগে বলেছেন ‘উড়ো উড়ো মনের’ ব্যবসায়ীদের দিয়ে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিন মাস ঢাকায়, আর নবলব্ধ ধন-দৌলতের জোরে ৯ মাস বিলাত-আমেরিকা-কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরÑ এ ধরনের উদ্যোক্তা ‘শিকড়হীন’ উদ্যোক্তা। এদের নিয়ে ভাবতে হবে। এদের ওপর ভরসা করে দেশের উন্নতি করার কাজ কঠিন হবে। শোনা যায় বড় বড় ব্যবসায়ীর অনেকেই দুই দেশের নাগরিক, তাদের পরিবার-পরিজনও বিদেশী নাগরিক। এদের ওপর ভরসা যে করা যায় না তার প্রমাণ তারা দেশে নানা অজুহাতে বিনিয়োগ না করে বিদেশে করছেন। সবাইকেই ভাবতে হবে। এ ধরনের ‘উদ্যোক্তা’ সম্পর্কে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×