ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চার শ’ কোটি টাকা ব্যয় হলেও চট্টগ্রামে জলজট বেড়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

চার শ’ কোটি টাকা ব্যয় হলেও চট্টগ্রামে জলজট বেড়েছে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল সেই শূন্যের কোটায় রয়ে গেছে। উল্টো উত্তরোত্তর জলজট সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর বর্ষা মওসুম এলে বা ভারী বর্ষণ হলে নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। গত দুই দশক সময়ে এ জলজট সমস্যা নিরসনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা। আমল বদলায়, মেয়র বদলায়। কিন্তু জলজট সমস্যার অবনতির চিত্র পাল্টায় না। সেই মনোনীত মেয়র থেকে নির্বাচিত মেয়র প্রত্যেকেই কেবলই আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন। যা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এখন আশার বাণী আসছে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্প নিয়ে। এরই মধ্যে ২৬টি বড় খাল এবং ১৩টি উপখাল মিলে ৩৯টি খালের অবস্থা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। একদিকে, দখল-বেদখল, অন্যদিকে নগরীর বর্জ্য ও পাহাড়ী ঢলের সঙ্গে নেমে আসা মাটিতে সবচেয়ে বড় খাল অর্থাৎ চাক্তাই খালটি একেবারেই ভরাট হয়ে গেছে। নৌযান চলাচল এখন অতীতের গল্পের মতো রূপ নিয়েছে। খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লাহ বাজার থেকে কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই মোহনা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা সংস্কারে কোন কাজই হয়নি। অথচ এ চাক্তাই খালে অন্যান্য খাল ও উপখালের পানি গিয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে তা প্রবাহিত হয় কর্ণফুলী নদীতে। মূল স্থানটি যেখানে ভরাট হয়ে সমান হয়ে আছে, সেখানে শহর এলাকায় বর্ষণের পানি খালে না গিয়ে নতুন নতুন এলাকা ডুবিয়ে দিচ্ছে। ফলে নগরবাসীর অবস্থা দিন দিন নাকালই হচ্ছে। চশমা খাল, মির্জা খাল, নাছির খাল, হিজড়া খাল, বির্জ্জাখাল, নালি খাল, ডাইভারশন খাল, চট্টেশ্বরী খালের পানি চাক্তাই খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। সে দৃশ্য এখন আর নেই। এ পানি নগরকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। গত প্রায় দুই দশক ধরে চট্টগ্রামের জলজট সমস্যা নিরসনে কত প্রকল্পই না নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। জাতীয় পার্টির আমল থেকে শুরু করে বিএনপি ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সব সময় প্রাধান্য পেয়েছে জলজট সমস্যার বিষয়টি। ফলে নতুন নতুন বড়-ছোট নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি আগের তিমির ছাড়িয়ে আরও অবনতি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জোয়ারের পানি। বর্ষণের সময় জোয়ার থাকলে পুরো শহরই যেন পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চসিকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সমস্যা নিরসনে যন্ত্রপাতি ক্রয়, খালগুলোর দুই পাড় থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, খনন কাজ তলাপাকাকরণ ইত্যাদিসহ কত কার্যক্রমই না হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু দিন যতই গড়াচ্ছে শহরটি ততই পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে একটি মাত্র বাণিজ্যিক এলাকা, অর্থাৎ আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা ও আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকা বর্ষণে অথৈই পানিতে ভেসে যায়। এছাড়া চকবাজার, বাকলিয়া, শুলকবহর, ষোলশহর, কাতালগঞ্জ, চান্দগাঁও, মোহরাসহ অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলগুলো বরাবরের মতো এবার আরও ব্যাপকভাবে পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। গত শুক্রবার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ফ্লাইওভারের নিচেও পানি। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা লালখান বাজার, জিইসি মোড়ে, পানি, প্রবর্তক মোড়ে পানি, আগ্রাবাদ পুরো এলাকা অথৈ পানি আর পানিতে ভেসে গেছে। বাণিজ্যপাড়াগুলোও পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। ক্ষতির পরিমাণ কত তা পরিসংখ্যান করে বলা মুশকিল। তবে একটি বিষয় উল্লেখ্য, বর্ষণ হওয়ার পর তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তবে স্বল্পস্থায়ী এ জলজটে পরিস্থিতি হয়ে যায় একেবারে ভয়াবহ। আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে এ পরিস্থিতির জন্য। সেবামূলক সংস্থার মাঝে কোন সমন্বয় নেই। এর জন্য চসিক ছাড়াও চউক, ওয়াসাসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। জেলা প্রশাসনও দায়মুক্ত নয়। তিন মাসের সময় দিয়ে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড় থেকে অবৈধ উচ্ছেদের যে চূড়ান্ত আদেশ হয়েছে সে আদেশ অদ্যাবধি কার্যকর করা যায়নি। উচ্চ আদালতের আদেশ জেলা প্রশাসনের কাছে পৌঁছালেও তা কার্যকর করতে বাধা কোথায়Ñ তা রহস্যজনক হয়ে আছে। চসিক সূত্রে জানা গেছে, এ সমস্যা পুরনো হলেও এবার তা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই প্রতীয়মান। তারা অপেক্ষায় রয়েছেন কখন ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্প অনুমোদন পাবে। এ আশায় তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় রয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে শুক্রবারের পরিস্থিতির জন্য মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নগরবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছাড় দেয়া হয়নি। সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে এমন এমন বক্তব্য ছাড়া হয়েছে, যা সংবাদপত্রের কলমের কালিতে লিখতেও বিব্রত হতে হয়। তবুও প্রচার মাধ্যমে এসবের কিছু কথা প্রচার হয়েছে। জলজট পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতে, গত প্রায় দুই দশকে যে চারশ কোটি টাকা সংস্কার কাজে ব্যয় হয়েছে এর অর্ধেকেরও বেশি লুটপাটই হয়েছে। নামে প্রকল্প বাস্তবে লোপাট, এ অবতারণার কারণেই নগরবাসী ভোগান্তির শেষ সীমায় পৌঁছেছে। খাল-উপখালগুলো দিয়ে পানি চাক্তাই খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। আবার কর্ণফুলী নদীও ড্রেজিং না হওয়ার কারণে বিস্তীর্ণ এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। এ দুয়ে মিলে এবার পরিস্থিতি দুঃসহ রূপ নিয়েছে। এর পাশাপাশি যত্রতত্র বাড়িঘর নির্মাণ, খালগুলোর দুপাড় বেদখল, নগর থেকে বর্জ্য অপসারণ হয়ে তা খালগুলোকে ভরাট করে ফেলার কারণেই সমস্যা তীব্রতর হয়েছে। সরকার প্রতিবছর জলজট সমস্যা নিরসনে চসিককে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। এ অর্থের পরিমাণ কখনও বেশি, আবার কখনও কম। আবার চসিক নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্প নিয়েছে প্রতিবছর। কিন্তু ফলাফল শূন্যের কোটায় রয়ে গেছে। যে চট্টগ্রাম শহর এক সময়ে সবুজের নগরীতে পরিণত হয়েছিল, সেই চট্টগ্রাম বর্তমানে ময়লা, আবর্জনার ভাগাড় ও জলজটের বড় একটি এলাকায় রূপ নিয়েছে। যে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষুব্ধদের পক্ষ থেকে পুরো চট্টগ্রামকে সুইমিংপুল নাম দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে নগরবাসি ক্ষুব্ধ, ত্যক্ত বিরক্ত। বর্ষণ হলেই যান চলাচল থমকে যায়। শনিবারের বর্ষণে দেখা গেছে, নৌ চলাচলের ঘটনাও। বাড়ি-ঘরগুলোতে পানি ঢুকে মূল্যবান সরঞ্জামাদি নষ্ট করে দিয়েছে। মোট কথা স্বাভাবিক জীবন থমকে গিয়েছিল। শনিবারও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। ভাগ্যিস জোয়ার না থাকায় পুনরায় পানির নিচে তলিয়ে যায়নি শহরের নিম্নাঞ্চলগুলো। এ দুঃখজনক পরিস্থিতিতে পরিত্রাণ পেতে মানুষের মাঝে চলছে শুধু হাহাকার। আর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন রয়েছে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রশ্ন উঠেছে, এ অনুমোদন পেতে কত সময় লাগতে পারে। আর প্রকল্প অনুমোদন হলে তা বাস্তবে কাজ হবে কিনা। এছাড়া প্রকল্পের অর্থ পুরোপুরিভাবে ব্যয় হবে কিনা। নাকি তা নিয়ে লুটপাটের টানাহ্যাঁচড়ায় পড়ে যায়- এ নিয়েও শঙ্কার কমতি নেই।
×