ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যারিস্টার আলী আসিফ খান

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে-

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে-

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বধীনতার সংগ্রাম’Ñ এটি বাঙালীর প্রাণের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার বাণী। মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইকস ৫ এপ্রিল ১৯৭১-এর সংখ্যায় একটি নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং বা রাজনীতির কবি হিসেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের পূর্বেই বঙ্গবন্ধুকে এমন সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন আন্তর্জাতিক মহল। তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। একটি রাষ্ট্রকে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থাকার প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি ছিল বঙ্গবন্ধুর। যিনি দেশকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে রেখে প্রতি বাঙালীর মুখে হাসি ফোটাতে বহুবার জেল-জুলুম সহ্য করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব না চেয়ে যে মহান নেতা শুধু বাঙালী জাতির অধিকারের জন্য পাকিস্তানের শোষণের কালো হাত থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। অর্জিত স্বাধীনতা বিজয় পরবর্তী বাংলাদেশ যখন দৃঢ় পদে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারসহ আমার নানা আবদুর রব সেরনিয়াবাত (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি), বড় খালা শেখ আর্জু মণি, ছোট খালা বেবী সেরনিয়াবাতকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সেই ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ছোট্ট শিশু সুকান্ত বাবু, ছোট মামা আরিফ সেরনিয়াবাত ও শেখ রাসেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আমার মা হামিদা সেরনিয়াবাত সেইদিন ঘাতকের ১১টি গুলির যন্ত্রণা সহ্য করে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় আমার মা দিল্লীতে চিকিৎসা করালেও একটি পা হারিয়ে এখনও যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করছেন যা আমাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে। জার্মানিতে থাকার সুবাদে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৭৫ পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবায়নকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ১৯৯৬, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে সরকার গঠন করে। জ্বালাও-পোড়াও প্রতিহিংসার কর্মকা- রুখে দিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের ফল ছিল জনগণের রায়। দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাবিরোধী দোসর এবং গণহত্যাকা-ে জড়িত রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ সকল যুদ্ধাপরাধীকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা কুড়ায়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারকে অনুসরণ করে রুয়ান্ডার সরকার সে দেশের গণহত্যায় জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যেখানে ইউরোপের মতো দেশগুলোতে মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দায় বিপর্যস্ত সে সময় শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল সুদক্ষ কৌশলে এ দেশের ওপরে অর্থনৈতিক মন্দার কোন প্রভাব পড়েনি। যার ফলে এ দেশের মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়নি এবং চ্যালেঞ্জের সঙ্গে ২০১৫ সালে সরকারী চাকরিজীবীদের দ্বিগুণ বেতনের পে স্কেল ঘোষণা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জিডিপি ৭.১১ এবং ১৪৬৫ ডলার মাথাপিছু আয় অর্জন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ২০১৭ সালে জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ ধরা হয়েছে। যানজট নিরসনে রাজধানীতে মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নিয়ে এবং বিভিন্ন স্থানে উড়াল সেতু ও হাতিরঝিল প্রকল্প সমাপ্ত করে নান্দনিক শহরে রূপান্তর করা হয়েছে। শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে¡ মিয়ানমার ও ভারতের আওতা থেকে বিশাল সমুদ্রসীমা উদ্ধার বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক বিজয়। ভারতের সঙ্গে বন্দী বিনিময় চুক্তি এবং মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়ন করে বাংলাদেশের শ্রমবাজার পুনরুদ্ধার করে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের ব্রেইল পদ্ধতির বই বিনামূল্যে বিতরণ করে শিক্ষার হার ৪৪ থেকে ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ প্রণয়ন করা হয় এবং নারী জনশক্তিনির্ভর তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয়। একটি বাড়ি একটি খামার, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধায় নিম্নœ আয়ের পরিবারের সংখ্যা ১৫% থেকে কমে ৩%-এ দাঁড়িয়েছে। শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, অপরাধী যেই হোক তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ বিচার বিভাগ ও দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, এ দেশের মানুষকে দাবায় রাখতে পারবা না। তাঁর এ ভবিষ্যদ্বাণী আজ সত্যি হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সঠিক প্রচেষ্টা, কর্মদক্ষতা ও সুদৃঢ় পদক্ষেপে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যাদের ঘর ঠিক করে দিয়েছিলেন আজ তাদের কেউ কেউ তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে হিংসার ফানুস উড়াচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনার প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তারা গভীর ষড়যন্ত্র করে আসছেন। এমনকি কতিপয় গরিবের রক্তচোষা লেবাসধারী দালাল যারা দেশী ও বিদেশী চক্রান্তকারীর দোসর। যারা স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে বিমুখ করে বহুল কাক্সিক্ষত প্রকল্পটির বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যা ছিল এদেশের জনগণের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, যা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। বঙ্গবন্ধু যেমন পরাশক্তির কাছে মাথা নত করেননি ঠিক তেমনি তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা অশুভ শক্তির কাছে মাথা নত না করে বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে নিজেদের অর্থায়নে বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন, যার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকে অগ্রাধিকার দেয়ায় বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ডিজিটালাইজড করতে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও তার সুযোগ্য সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে আইসিটি খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে ‘লার্নিং এ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষিত যুব সমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করে দেশের প্রবৃদ্ধি উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে বর্তমান সরকার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছানোর লক্ষ্যে সৌরবিদ্যুত, কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুত প্রকল্পসহ ১৫ হাজার ৩৭৯ মেগাওয়াট উৎপাদন করে ২০২১ সালে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ভ-ূউপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু-১’ ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর উৎক্ষেপণ করা হবে। টেন্ডারবাজি বন্ধে ই-টেন্ডার, ২য় সাবমেরিন কেবল স্থাপন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মোবাইল ফোন ও কলরেট এবং ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং, ৯টি নতুন বেসরকারী ব্যাংক অনুমোদন দেয়ায় জনগণ ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। সার্বিক তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গত বিশ্বকাপে ফাইনালে চ্যালেঞ্জিং খেলায় ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে শততম টেস্ট খেলা ঐতিহাসিক বিজয় ছিনিয়ে আনে। প্রতি উপজেলায় একটি করে মিনি স্টেডিয়াম গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সাবমেরিন ক্রয়সহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা হয়েছে। ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক পর্যায় প্রশংসার সঙ্গে ‘চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ’, ‘সাউথ-সাউথ’, এবং ‘আইসিটি’ এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে¡ উগ্র জঙ্গীবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার তার ঐতিহ্যের ধারাকে অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শোষণ, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ তথা শক্তিশালী, সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে দাঁড়াবে। লেখক : আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ
×