ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সালিশে বাল্যবিয়ে দিয়ে প্রেমিক প্রেমিকাকে গ্রামছাড়া

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২১ এপ্রিল ২০১৭

সালিশে বাল্যবিয়ে দিয়ে প্রেমিক প্রেমিকাকে গ্রামছাড়া

নিজস্ব সংবাদদাতা, কেশবপুর, ২০ এপ্রিল ॥ প্রেমের সম্পর্কের অপরাধে জোরপূর্বক বিয়ে দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কিশোর-কিশোরীকে। শুধু তাই নয় ছেলের পিতাকে করা হয়েছে সমাজচ্যুত। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের উপস্থিতিতে সম্প্রতি এক সালিশ বসিয়ে এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেছে কেশবপুরের বাগডাঙ্গা গ্রামের হিন্দু পল্লীর কতিপয় সমাজপতি। সরেজমিন কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া ইউনিয়নের বাগডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, বাগডাঙ্গা গ্রামের মৃনাল সরকারের মেয়ে ও মনোহর নগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুইটি রানী এবং একই গ্রামের রাস মোহন সরকারের ছেলে গোপাল সরকারের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে মেয়ের পিতা মৃনাল সরকার সুইটির অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে। গত ২ মার্চ জোরপূর্বক সুইটির বাল্যবিয়ের আয়োজন করা হয়। ওই বিয়েতে রাজি না থাকায় বিয়ের অনুষ্ঠানে বর হাজির হলে সুইটি বিষপান করে। পরিমাণে কম হওয়ায় মারাত্মক অসুবিধা হয়নি। এক পর্যায়ে বরপক্ষ বিয়ে না করে চলে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সুইটির পিতা এবং এলাকার লোকজন সুইটিকে মারধর করে। ওই রাতেই এলাকার শতাধিক যুবক সুইটিকে তার প্রেমিক গোপালের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং ওই যুবকরা গোপালকে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে মেয়ের পিতার বাড়িতে তাদের মালা বদল করে বিয়ে দেয়। এরপর আবারও গোপালের বাড়িতে সুইটিকে তুলে দেয় ওই যুবকরা। বিয়ের কিছুদিন পর মৃনাল সরকার তার মেয়েকে ফেরত চেয়ে নানা রকম হুমকি দিতে থাকে। ছেলের পিতা রাস মোহন সরকার এ ঘটনায় পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদে গত ২৮ মার্চ একটি লিখিত অভিযোগ করেন। মেয়ে পক্ষের সমাজপতিরা ওই অভিযোগের বিচার ইউনিয়ন পরিষদে না করে গ্রামের করার প্রস্তাব দেয়। সে অনুযায়ী গত ২৮ মার্চ গ্রামের মাতব্বর ললিত মোহন সরকার, মনোরঞ্চন সরকার, দুর্গাপদ সরকার, পরেশ ম-ল, মেম্বর বৈদ্যনাথ সরকার, মহিলা মেম্বর অনিমা রায়সহ উভয়পক্ষের লোক নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মুকুলের উপস্থিতিতে গ্রামের পূজা ম-পের সামনে এক বিচার বসে। গ্রামের মাতব্বররা প্রেম করার অপরাধে সুইটি ও গোপালকে গ্রাম থেকে চলে যেতে হবে এবং গোপালের পিতা রাস মোমনকে সমাজচ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিচারের সভাপতি গ্রামের বড় মাতব্বর ললিত মোহন এ সাজা ঘোষণা করেন। সেখান থেকে সুইটি ও গোপাল গ্রামের বাইরে চলে গেছে। গোপাল জানায়, আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল। মেয়ের বিয়ের বয়স হওয়ার পর বিয়ে করব এমন পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু উল্লিখিত মাতব্বররা জোর করে বিয়ে দিয়ে আমাদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামে গেলেই মারধর করবে। আমার টেলার্সের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুইটি রানী জানায়, লেখাপড়া শেষ করে আমরা বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। জোর করে আমাদের বিয়ে দেয়া হয়েছে এবং গ্রাম থেকে নির্বাসনে দেয়া হয়েছে। ছেলের পিতা রাস মোহন জানান, আমার ছেলেকে বাড়ি থেকে জোর করে ধরে নিয়ে বিয়ে দিয়েছে এবং তাদের মেয়েকে আমার বাড়ি তুলে নিয়েছে। আবার তারাই সালিশ করে আমাকে একঘরে এবং আমার ছেলে-বউকে গ্রামছাড়া করেছে। এবার চড়ক পূজার চাঁদা দিতে গিয়ে হাতে পায়ে ধরলেও চাঁদ নেয়নি মেম্বর বৈদ্যেনাথ। মেয়ের পিতা মৃনাল জানান, বহুকাল ধরে ওপাড়ার সঙ্গে আমাদের পাড়ার লোকদের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। সম্পর্কের কথা জানতে পেরে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চাইলে সে রাজি না হয়ে বিষ পান করে এবং বিয়ে ভেঙ্গে যায়। সে কারণে এলাকার লোক জোর করে গোপালের সঙ্গে সুইটির বিয়ে দিয়ে তার বাড়ি তুলে দিয়েছে। এ বিষয়ে মাতব্বর ললিত মোহন সরকার জানান, ধর্মীয়, সামাজিক এবং গোষ্ঠীর নিয়মনীতি না মেনে তারা একই গোত্রের ভেতর সম্পর্ক অন্যায় করেছে। একই গোত্রের মধ্যে বিয়ের কোন বিধান না থাকায় সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এলাকাবাসী তাদের বিরুদ্ধে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা ও ছেলের বাবাকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগেও এমন অপরাধে কয়েকজনকে গ্রামছাড়া করা হয়েছে। তারা এখনও গ্রামে আসতে পারে না। বিচার সভায় আমি এলাকাবাসীর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছি তবে ওই সিদ্ধান্ত এখনও কার্যকর করা হয়নি। যদি ছেলের পিতা এবং ছেলেমেয়ে অন্যায় স্বীকার করে তাহলে পুনরায় ওই সাজা বিবেচনা করা হবে। পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম মুকুল জানান, ওই বিচারে আমার সামনে তারা ছেলেমেয়েকে গ্রামছাড়া এবং ছেলের পিতাকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ললিত মোহন ঘোষণা করেন। এমন মানবতা বিরোধী সাজার বিষয়ে আমি মত দেইনি। তাদের সমাজের নিয়ম অনুযায়ী বিচার করেছে।
×