ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্নবস্তুর বিশেষ প্রদর্শনী

মৃৎপাত্র পোড়ামাটির ফলক ভগ্নাংশ থেকে ইতিহাসের খোঁজ

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২০ এপ্রিল ২০১৭

মৃৎপাত্র পোড়ামাটির ফলক ভগ্নাংশ থেকে ইতিহাসের খোঁজ

মোরসালিন মিজান ॥ নানা আকার-আকৃতির মৃৎপাত্র। পোড়ামাটির ফলক। মূর্তি। ভগ্নাংশ। সাদা চোখে দেখলে দ্বিতীয়বার হয়তো কেউ তাকাবেন না। কিন্তু সাদা চোখে দেখার সুযোগ কোথায়? সবই যে প্রতœবস্তু। বহু পুরনো ইতিহাসের অমূল্য স্মারক। সঙ্গত কারণে কৌতূহলী চোখেই দেখলেন দর্শনার্থীরা। লালবাগ কেল্লায় বিশেষ এই দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার আয়োজিত প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ২০১৬-১৭ সালে পরিচালিত উৎখনন কার্যক্রমের মাধ্যমে পাওয়া প্রতœবস্তু রাখা হয় প্রদর্শনীতে। দেশের বিভিন্ন প্রতœস্থল খননের এই কাজ করে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। সাম্প্রতিক সময়ে হওয়ায় নিদর্শনগুলো নিয়ে আগ্রহ ছিল দর্শনার্থীদের মধ্যে। প্রথম দিন প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি টেবিলে সাজানো হয়েছে প্রতœ নিদর্শন। অধিকাংশ বস্তু নিদর্শনের ভাঙ্গা গড়ন। বিবর্ণ চেহারা। যারপর নাই ক্ষয়প্রাপ্ত। এরপরও যা আছে, যেটুকু আছে, তার মূল্য অনেক। প্রতিটি বস্তু নিদর্শন তার সময়কে ধারণ করে আছে। নিদর্শনগুলো দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতœস্থল থেকে পাওয়া। বাংলাদেশের খুব উল্লেখযোগ্য প্রতœস্থল উয়ারি-বটেশ্বর। নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার দুটি গ্রাম এই প্রতœস্থলের অন্তর্গত। এখানে বিভিন্ন সময়ের খননে আবিষ্কৃত হয় প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গ নগরী। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালে এখানে উৎখনন কার্যক্রম পরিচালনা করে। খননে পাওয়া প্রতœ নিদর্শন রাখা হয় প্রদর্শনীতে। নিদর্শনগুলোর মধ্যে ছিল বিভিন্ন রকমের মৃৎপাত্র ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ। পাশাপাশি রাখা ছিল টেবিল ওয়্যার। প্লেট, গ্লাস কাপ, ডেকোরেটেড জারসহ বিভিন্ন তৈজসপত্রে আভিজাত্যের ছোঁয়া। একটি টেবিলে ছিল সঞ্চয় পাত্রের ভগ্নাংশ। ফ্রাইপেনের হাতল। সবই উয়ারি-বটেশ্বরের আদি ইতিহাসকে তুলে ধরছিল। নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার দুটি স্থানে প্রতœতাত্ত্বিক খননের কাজ করা হয়। সতীশের ডাঙ্গা ও ধর্মপালের গড় থেকে পাওয়া নিদর্শন রাখা হয় প্রদর্শনীতে। ছিল টিসি টয়, পোড়ামাটির প্রদীপ, কলসের ভগ্নাংশ, পোড়ামাটির নকশাযুক্ত ইট। ধারণা করা হয়, ধর্মপালের গড়কেন্দ্রিক প্রতœবস্তু একাদশ দ্বাদশ শতকের। সতীশের ডাঙ্গা থেকে পাওয়া নিদর্শন পনের শতকের। বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রতœতাত্ত্বিক স্থানগুলোর অন্যতম একটি ভরত ভায়না। যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার পরিত্যক্ত এই জনপদ খনন করে প্রচুর প্রতœবস্তু পাওয়া গিয়েছে। ১৯৮৫ সালে প্রথম এই ঢিবি খনন করে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর। এরপর বিভিন্ন সময় হয়েছে খননের কাজ। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খননের কাজ করা হয়। খননের ফলে একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের অংশবিশেষ উন্মোচিত হয়। প্রধান অট্টালিকাটি ছিল বৌদ্ধ মন্দির। আনুমানিক পঞ্চম শতকের ভরত ভায়না বৌদ্ধ মন্দির থেকে সম্প্রতি প্রাপ্ত প্রতœ নিদর্শন উপস্থাপন করা হয় প্রদর্শনীতে। অধিকাংশই বিভিন্ন মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ। সানকি বা থালার মতো দেখতে। এর আগে এ ধরনের মৃৎপাত্র বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœস্থানে পাওয়া গিয়েছে। গবেষণা মতে, এগুলো আদি মধ্য যুগের স্মারক। পাশের টেবিলে রাখা হয়েছিল মাটির হাঁড়ি ধূপদানী বাটি কলস এবং সংরক্ষণ পাত্র। একই খননে পাওয়া পোড়ামাটির ফলকচিত্রের ভগ্নাংশ সে সময়ের মানুষের রুচি শিল্পবোধের প্রমাণ। ধারণা করা হয়, স্থাপত্য কাঠামোতে পোড়ামাটির ফলকচিত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। ক্রসিফর্ম আকৃতির কাঠামোর চারদিকের উইংগুলোর প্যানেলে পোড়ামাটির ফলক লাগানো ছিল। প্রদর্শনীতে ছিল মানব মূর্তির মস্তক হাত-পাসহ শরীরের ভগ্নাংশ। প্রাণীমূর্তির মধ্যে ছিল একটি ষাঁড়ের মস্তক। একই রকম টেবিলে প্রদর্শন করা হয় বাগেরহাটের খান জাহান আলীর বসতভিটা থেকে প্রাপ্ত প্রতœ নিদর্শন। এখানেও বহু বছর ধরে চলছে খনন কাজ। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছর পাওয়া যায় সুলতানী যুগে ব্যবহৃত অলঙ্কৃত রঙিন টালি। ষড়ভূজাকৃতি চতুষ্কোণাকৃতি ও ত্রিকোণাকৃতি টালির কয়েকটি প্রদর্শনীতে আনা হয়। ছিল ফুল লতাপাতার নকশাকৃত রঙিন টালি। গবেষকদের মতে, এইসব টালি সাধারণত মেঝে ও দেয়াল অলঙ্করণের জন্য ব্যবহার করা হতো। এ ধরনের রঙিন টালি ও অলঙ্কৃত ইট সুলতানী যুগের রাজধানী গৌড়সহ বিভিন্ন প্রতœস্থানে পাওয়া গিয়েছে। গৌড় ও পা-ুয়ায় এ ধরনের রঙিন টালি ব্যবহার করে মেঝে নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই খননেও পাওয়া গেছে মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ। সুলতানী যুগের বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয় থালা, লযুক্ত মৃৎপাত্র, পানি ছিটানোর পাত্রের ভগ্নাংশ, তৈল প্রদীপ, সাদা ওয়াশযুক্ত মৃৎপাত্র, চুন দিয়ে তৈরি স্টোন ওয়্যার, পলিক্রম ওয়্যার, গ্লেইজড ওয়্যার, সিøপযুক্ত ওয়্যার, সেলাডন, চাইনিজ পোরসেলিন, এগ-শেল ওয়্যার, সিøপযুক্ত ওয়্যার, স্টোরেজ জার। সাম্প্রতিককালে পাওয়া এমন বেশকিছু প্রতœবস্তু দিয়ে সাজানো প্রদর্শনী বিস্ময় নিয়েই দেখেন দর্শনার্থীরা। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর আয়োজিত প্রদর্শনী বুধবার শেষ হয়েছে।
×