ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী

যিশু খ্রিস্টের গৌরবদীপ্ত পুনরুত্থান

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৬ এপ্রিল ২০১৭

যিশু খ্রিস্টের গৌরবদীপ্ত পুনরুত্থান

৯৪ খ্রিস্টাব্দ। যিশু খ্রিস্টের সর্বকনিষ্ঠ শিষ্য যোহন তখন একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসের কারণে ভূমধ্যসাগরের পাটমস দ্বীপে দ্বীপান্তরের শাস্তি ভোগ করছেন। ডমিশিয়ান তখন রোমের সম্রাট। খ্রিস্টিয়ানদের উপরে তাঁর এক পূর্বসূরি নীরোর ভয়ঙ্কর নিধনযজ্ঞের কথা কে না শুনেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ডমিশিয়ানের পৈশাচিকতা তাকেও হার মানিয়েছে। তিনিই প্রথম রোম সম্রাট যিনি নিজেকে ‘প্রভু ও ঈশ্বর’ বলে ঘোষণা করে প্রজাদের কাছ থেকে পূজা দাবি করেছেন। কিন্তু খ্রিস্টিয়ানদের বিশ্বাস, যেহেতু ঈশ্বরপুত্র পুনরুত্থিত খিস্টই প্রভু, তাই তারা জাগতিক কোন শাসককে ‘প্রভু ও ঈশ্বর’ বলে স্বীকার করতে রাজি নয়। ফলে খ্রিস্টিয়ানদের উপরে নেমে আসে অকথ্য অত্যাচার। নির্বাসিত যোহন যখন একদিন ঐশধ্যানে মগ্ন, তখন তিনি পান এক অদ্ভুত দিব্যদর্শন। খ্রিস্টের এই বাণী শুনতে পেলেন তিনি : ‘ভয় করিও না, আমি প্রথম ও শেষ ও জীবন্ত; আমি মরিয়াছিলাম, আর দেখ, আমি যুগপর্যায়ের যুগে যুগে জীবন্ত; আর মৃত্যুর ও পাতালের চাবি আমার হস্তে আছে’ (প্রকাশিত বাক্য ১ঃ১৭-১৮)। খ্রিস্টের পুনরুত্থান সেই শাশ্বত জীবনেরই মৃত্যুহীন উচ্চারণ। যুগে যুগে এই অভয়ও অমিয় বাণীই খ্রিস্টের অনুসারীদের সকল প্রেরণা ও আশার উৎস হয়ে রয়েছে। খ্রিস্টের পুনরুত্থানই তাদের কেন্দ্রীয় বিশ্বাস, তাদের সমস্ত বিশ্বাস সূত্র তারই প্রতিধ্বনি। ছোট-বড় নানা কারণে চার্চ শতধাবিভক্ত হলেও পৃথিবীর সকল খ্রিস্টিয়ানের একমাত্র ঐশতাত্ত্বিক নির্ভরবিন্দু ও প্রচারের সারমর্ম মৃত্যু থেকে খ্রিস্টের পুনরুত্থান। সাধু পৌলের কথায় ‘খ্রিস্ট যদি উত্থাপিত না হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তো আমাদের প্রচারও বৃথা, তোমাদের বিশ্বাসও বৃথা’ (১ করিন্থীয় ১৫:১৪)। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে খ্রিস্টের পুনরুত্থান কিভাবে এলো? পুনরুত্থান তাঁর ক্রুশীয় মৃত্যুর দান। ক্রুশের নাটকে আপাত পরাজিত খ্রিস্ট মৃত মানুষ; কিন্তু পুনরুত্থানের গৌরবে তিনি বিজয়ী বীর, শাশ্বত জীবন্ত ঈশ্বরপুত্র। তিনি কেবল একজন মহামানবই নন। ঈশ্বরের অবতাররূপে তিনি মানুষের ইতিহাসে ও অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। ঈশ্বর তাঁর মধ্য দিয়ে মানুষের জন্য স্বর্গীয় প্রেমকে চূড়ান্তভাবে মূর্ত করেছেন। তাঁর অলৌকিক জন্ম, অপমানজনক মৃত্যু ও আলোকদীপ্ত পুনরুত্থানের সকল ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত সাধন করেছেন। মানুষ কোন সৎকর্ম ও সাধনার বলে ঈশ্বরের কাছে ধার্মিক হতে পারে না। ঈশ্বরে বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণই চাবিকাঠি কারণ সৎকর্ম, সাধনা ও জ্ঞান যে সকলের সাধ্যের মধ্যে থাকে না! পাপী মানুষের প্রতি প্রসন্নতায় ঈশ-মানব খ্রিস্ট মৃত্যুর রাজ্যে প্রবেশ করে মৃত্যুকে জয় করলেন। কারণ মানুষের পরিত্রাণের জন্য ঈশ্বরের প্রেমের কারণেই তিনি তাঁর বাধ্য ছিলেন। ‘পিতা আমাকে এই জন্য প্রেম করেন, কারণ আমি আপন প্রাণ সমর্পণ করি, যেন পুনরায় তাহা গ্রহণ করি। কেহ আমা হইতে তাহা হরণ করে না, বরং আমি আপনা হইতেই তাহা সমর্পণ করি। তাহা সমর্পণ করিতে আমার ক্ষমতা আছে এবং পুনরায় তাহা গ্রহণ করিতেও আমার ক্ষমতা আছে; এই আদেশ আমি আপন পিতা হইতে পাইয়াছি’ (যোহন ১০:১৭-১৮)। যেহেতু খ্রিস্ট ছিলেন নিষ্পাপ, তাই মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাঁর মৃত্যুই ছিল একমাত্র ঈশ্বর নিরুপিত ব্যবস্থা। পাপের কোন অভিজ্ঞতা যাঁর মধ্যে ছিল না তাঁকেই ঈশ্বর মানুষের পাপের জন্য যজ্ঞরূপে হত হতে দিলেন। তাই নিষ্পাপ-নিষ্কলঙ্ক যিশুর যজ্ঞই পাপমুক্তির জন্য পবিত্র ঈশ্বরের কাছে একমাত্র শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ। খ্রিস্টের পুনরুত্থানে বিশ্বাসের অর্থ হলো পবিত্র আত্মায় জীবনকে নতুন করার আহ্বানে সাড়া দেয়া। পাপের পুরনো জীবনকে কবর দিয়ে জগত ও জীবনকে নতুনভাবে গ্রহণ করা। এর জন্য প্রথমে চাই এ জগতে বিশ্ববাসীর প্রকৃত মানবীয় মূল্যবোধ ও চেতনার পুনরুত্থান। পাপের ভয়াবহ বাস্তবতা বুঝে খ্রিস্টের আত্মত্যাগকে মেনে নিতে না পারলে তাঁর পুনরুত্থানের আনন্দ লৌকিকতায়ই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। খ্রিস্টের মৃত্যুর সঙ্গে যদি আমাদের লোভ ও স্বার্থ চিন্তার মৃত্যু না হয়, তাহলে তাঁর পুনরুত্থান আমাদের কোন নতুনত্ব এনে দিতে পারে না। সেই প্রথম যুগের বিশ্বাসীরা খ্রিস্টের মৃত্যুর জন্য নিজেদের পুরনো জীবনকে, অর্থাৎ তাদের পুরনো মানুষকে মৃত্যুসাৎ করেছিল বলেই পুনরুত্থানের আনন্দকে প্রকৃত অর্থেই উপলব্ধি করেছে। সকল সঙ্কীর্ণতাকে বিসর্জন দিতে পারলেই তো প্রকৃত মনুষ্যত্বের জন্ম। ঞ.ঝ. ঊষষরড়ঃ- এর কথায়, “চধরহ রং ঃযব ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃব ড়ভ লড়ু, ইঁঃ লড়ু রং ধ শরহফ ড়ভ ঢ়ধরহ. ও নবষরবাব ঃযব সড়সবহঃ ড়ভ নরৎঃয ওং যিবহ বি যধাব শহড়ষিবফমব ড়ভ ফবধঃয.” খুব সহজভাবে বলতে গেলে বাইবেলে মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে দু’ভাবে ভাগ করা হয়েছে: ১. ধূলি বা মাটি, ২. ঈশ্বরের আত্মা। ধূলি হচ্ছে ইহজাগতিক, শারীরিক সত্তা; ঈশ্বরের আত্মা হচ্ছে মানুষের প্রাণবায়ু, অনন্তকালীন সত্তা, যার বলে মানুষ ঈশ্বরের বিষয়ে চিন্তা করতে পারে, তার সঙ্গে কথা বলতে পারে ও সম্পর্ক রাখতে পারে। এখানেই প্রকাশ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের নৈতিক গুণাবলীর অর্থাৎ যে সমস্ত গুণ তিনি মানুষকে দান করেছেন, যেমন : প্রেম, পবিত্রতা, সততা, ন্যায্যতা, ধার্র্মিকতা ইত্যাদি। এসব থেকেই মানুষের হয় মূল্যবোধ ও চেতনা। বাস্তব জীবনে খ্রিস্টের পুনরুত্থানে আমাদের সেই মূল্যবোধ ও চেতনার পুনরুত্থান হওয়ার আহ্বান আজ। মানুষ প্রকৃত মানুষ হয় তার চৈতন্য ও মূল্যবোধে। বাইবেলে ‘ভয় করিও না’- কথাটি ৩৬৬ বার ব্যবহার করা হয়েছে, যেন বছরের প্রতিদিনের জন্য ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের একটি করে অভয়বাণী দিয়েছেন। লিপইয়ারেও প্রতিটি দিনের জন্য! আমাদের নিত্যদিনের বাস্তবতায় সুখ-দুঃখ ও আশা-নিরাশার অভিজ্ঞতায় যিশু খ্রিস্টের সেই অভয়বাণী সার্থক হোক। আজ আমার মনে পড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের একটা কথা : ‘আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি চাই বাংলার মানুষের অধিকার।’ কথাগুলো সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন স্বাধিকার বঞ্চিত এদেশের সমস্ত শোষিত-নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসায় ও দেশপ্রেমের মূল্যবোধ এবং চেতনায়। তাঁর দেহ, মন ও অন্তরাত্মার সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি বলেছিলেন ঐ কথাগুলো। দিকে দিকে আজ আমরা দেখতে পাই অন্যায় ও অশুভ শক্তির বড় আস্ফালন এবং পাঁয়তারা। স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের সেই মূল্যবোধেরও পুনরুত্থানের আজ বড় প্রয়োজন। ব্যক্তি ও সমষ্টিগত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগ এবং আত্মদানের সেই মূল্যবোধ আবারও নতুন করে জেগে উঠুক, হোক এখন তারও পুনরুত্থান, এমন প্রার্থনা করি সকল মানুষের জন্য। সবাইকে জানাই ‘শুভ পুনরুত্থান’! লেখক : খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক ও সমাজকর্মী
×