ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধীর শাস্তির বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

অপরাধীর শাস্তির বিরুদ্ধে কিছু বলার নেই

নিজস্ব সংবাদদাতা, গোপালগঞ্জ, ১২ এপ্রিল ॥ মুফতি হান্নানের সঙ্গে দেখা করতে যাননি তার মা রাবেয়া খাতুন। স্বামীর ভিটাবাড়িতে বসে তিনি শুধু চোখের জল ফেলেন। ঘরের বাইরে আসেন না, কারও সঙ্গে কথা বলতেও চান না। শেষ মুহূর্তে মঙ্গলবার বিকেলে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হিরণ গ্রামে মুফতি হান্নানের বাড়িতে গেলে কথা হয় রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে। রাবেয়া খাতুন বলেন, মেঝ সন্তান হান্নানের সঙ্গে তার সর্বশেষ দেখা হয় ১২ বছর আগে। নিজের অসুস্থতাসহ নানা কারণে দেখা হওয়ার সুযোগও ছিল না। সেদিন হান্নান শুধু এটুকুই বলেছে, ‘মা, আমার জন্য দোয়া করবেনÑ আপনার ছেলে নির্দোষ। আপনার ছেলে যদি দুনিয়াতে আপনার খেদমত করতে না পারে, আখেরাতে আপনার খেদমত করবে’। কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, আমার এ সন্তান হওয়ার পর আমি ও আমার শাশুড়ি নিয়ত করেছিলাম সন্তানকে আরবি পড়াব। সে কারণে তাকে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়িয়েছি। টুঙ্গিপাড়ার গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় সে পড়াশোনা করেছে। এরপর সেখান থেকে ভারতের দেওবন্ধ মাদ্রাসায় সে লেখাপড়া করেছে। ঠিকই আল্লাহ্্ তাকে হাফেজ আলেম বানিয়েছেন। সে মুফতি হয়েছে, আমিও গর্ব করেছি। কিন্তু দুনিয়াতে কি শান্তি পেলাম তা আল্লাহ্্ই জানেন, আর আখেরাতে কি পাবÑ তাও আল্লাহ্্ জানেন। আমি মা হিসেবে সন্তানের জন্য এটুকুই দোয়া করি, আল্লাহ্্ যেন ওকে ক্ষমা করে দেন। তিনি বলেন, সরকারের দৃষ্টিতে ও অপরাধী, তাই অপরাধীর শাস্তির বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। মুফতি হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভীন রুমা কথা বলতে চাননি। পর্দার আড়ালে থেকে তিনি শুধু জানিয়েছেন, তার ৪ ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে নাছরুল্লাহ (১৯) যশোর কলেজে ডিপ্লোমা পড়ছে। ছোট ছেলে নূরুল্লাহ্্ (১৫) ঢাকায় মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে এবং বড় মেয়ে নিশি (১৭) ও ছোট মেয়ে নাজনীন দু’জনই মহিলা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। তিনি বলেন, আমি বাড়িতেই থাকি। ছেলেমেয়ে নিয়ে ভীষণ কষ্টে জীবন কাটছে। এদিকে, কোটালীপাড়ার হিরণ ইউনিয়নের বাসিন্দারা ক’দিন ধরেই বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে মুফতি হান্নানের ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর এবং তার লাশ যেন হিরণ ইউনিয়নে আনা না হয় এমন দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা মনে করেন, মুফতি হান্নানের ফাঁসি হলে হিরণ গ্রাম তথা কোটালীপাড়া কলঙ্ক থেকে মুক্ত হবে। এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশ স্বাধীনের পরপরই মুক্তিযোদ্ধারা মুফতি হান্নানের বাবা মুন্সী নূরুদ্দিনকে মেরে ফেলে। এরপর হান্নান ওরফে আবদুুল হান্নান মুন্সি এলাকা ছাড়েন এবং পরবর্তী সময়ে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও দেওবন্ধ মাদ্রাসা এবং সেখান থেকে চলে যান পাকিস্তানে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে অংশ নেন আফগানিস্তানের যুদ্ধে, যেখানে তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং হরকাতুল জিহাদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং নেতৃত্ব দেন। পাশাপাশি কোটালীপাড়ার বিভিন্ন মাদ্রাসায় যুবকদের সংগঠিত করে তাদের জঙ্গী প্রশিক্ষণ দিতেন এবং একটি ক্যাডেট মাদ্রাসাও গড়ে তোলেন। গোপালগঞ্জ শহরের বিসিক শিল্প এলাকায় গড়ে তোলেন সোনার বাংলা সাবান ফ্যাক্টরি। তখনও তার কোন পরিচিতি ছিল না। এরপর ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীসহ অন্যান্যদের বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা প্রচেষ্টার ঘটনার পরই মূলত মুফতি হান্নানের নাম সকলের সামনে উঠে আসে। বছর ঘুরতেই ২০০১ সালের ৩ জুন গোপালগঞ্জের মুকসুদপর উপজেলার বানিয়ারচর ক্যাথলিক গির্জায় সাপ্তাহিক প্রার্থনা চলাকালে ভয়াবহ বোমা হামলায় ১০ ধর্মপ্রাণ খ্রীস্টান নিহত এবং অর্ধশত আহত হয়। এ দুটি ঘটনায় চারটি মামলা হয়, এসব মামলার প্রধান আসামি মুফতি আবদুল হান্নান মুন্সি।
×