ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিন মাসে দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ ॥ তুলার বিশ্ববাজার অস্থির

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ৩০ মার্চ ২০১৭

তিন মাসে দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ ॥ তুলার বিশ্ববাজার অস্থির

কাওসার রহমান ॥ তুলার বিশ্ববাজার অস্থির। কয়েক মাস ধরেই তুলার দাম উর্ধমুখী। গত তিন মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়েছে প্রায় ২০ থেকে ২২ শতাংশ। বস্ত্রশিল্পের অন্যতম এই কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন তুলার শীর্ষ আমদানিকারক বাংলাদেশের সুতাকল মালিকরা। আমদানিকারকরা বলছেন, আগামী আগস্ট মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ান তুলা বাজারে আসবে। তার আগে দাম কমার কোন সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় আগামীতে আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশে তুলার উৎপাদন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। দেশে বস্ত্রশিল্পের চাহিদা মেটাতে উৎপাদনে রয়েছে প্রায় ৫ শ’ সুতাকল। যেখানে প্রতিবছর প্রয়োজন হয় গড়ে প্রায় ৫৫ লাখ বেল তুলা। বাংলাদেশ কটন এ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএ) তথ্য বলছে, ২০২১ সাল নাগাদ দেশে তুলার চাহিদা বেড়ে হবে ৭৬ লাখ বেল। বর্তমানে বিপুল চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ তুলার যোগান আসে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। ফলে বাধ্য হয়েই প্রায় শতভাগ আমদানি নির্ভর দেশের সুতাকলগুলো। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম বড় তুলা আমদানিকারক দেশ। গত বছর বাংলাদেশ প্রায় ৬১ লাখ বেল তুলা আমদানি করেছে। আমদানিকৃত এ তুলার অর্ধেকই আসে প্রতিবেশী ভারত থেকে। তুলা আমদানির ক্ষেত্রে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে বলে মনে করছেন এ দেশের তুলা আমদানিকারক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলছেন, অনেক সময় আমদানিকৃত তুলা যথাযথ গুণগত মান অনুযায়ী পাওয়া যায় না। এমন অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে হলে ইন্টারন্যাশনাল কটন এ্যাসোসিয়েশন (আইসিএ) নির্ধারিত জার্মানির ব্রেমেনের ল্যাবে তুলার নমুনা পাঠাতে হয়। এটি সময়সাপেক্ষ। এ ধরনের বিরোধের রায় আমদানিকারকের পক্ষেও আসে না। আবার অনেক সময় আমদানিকারককে তুলার দাম সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়। ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু এ জাতীয় ক্ষতি কমাতে রফতানিকারকের সহযোগিতাও পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘এছাড়া আমদানিকারক কর্তৃপক ঋণপত্র (এলসি) খোলার পর রফতানিকারক সঠিক সময়ে তুলা পাঠাতে ব্যর্থ হন। আইসিএর বিধি অনুযায়ী কোন ক্ষতিপূরণ পান না আমদানিকারক। অথচ এলসি খুলতে দেরি হলে আমদানিকারককে বাড়তি অর্থ গুনতে হয়।’ সম্প্রতি চীনে তুলার মজুদ কমে গেছে, আর চাহিদা বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেই সঙ্গে ভারতের বাজার থেকে ৫ শ’ ও ১ হাজার রুপির নোট তুলে নেয়ায় গত ডিসেম্বর থেকে সেখানেও উর্ধমুখী তুলার দাম। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের এই সঙ্কটের ধাক্কা এসে লেগেছে দেশের তুলার বাজারেও। গত ডিসেম্বরে তুলার যে দাম ছিল বর্তমানে তা আরও প্রায় ২০ থেকে ২২ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কাপড়ের ওপর। আবার কাপড়ের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে গার্মেন্টসের ওপর। তবে ব্যবসায়ীরা একে নিয়েছেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। তুলা আমদানিকারকরা বলছেন, দেশে প্রতিবছর চাহিদা বাড়ছে প্রায় তিন লাখ বেল হারে। যেখানে দেশের উৎপাদন বাড়ছে মাত্র ১৫ হাজার বেল হারে। এ অবস্থায়, বস্ত্রশিল্পের স্বার্থে দেশে তুলার চাষ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। আমদানিকারকরা বলছেন, চলতি বছরের মে মাস নাগাদ অস্ট্রেলিয়ান তুলা বাজারে আসার আগে দাম কমার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশ কটন এ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএ) সাধারণ সম্পাদক মেহেদী আলী বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে তুলা উৎপাদন হয় তা চাহিদার মাত্র এক শতাংশ পূরণ করতে পারছে। এই উৎপাদন চাহিদার ১০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা বাংলাদেশ কটন ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের সঙ্গে কাজ করছি। তবে, চাহিদা বাড়লেও বিশ্ববাজারে তুলার সঙ্কটের আশঙ্কা নেই উল্লেখ করে, তুলা চাষে জমির পরিমাণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। সেন্টার ফর পালিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্ববাজারে বর্তমানে তুলার সরবরাহ পর্যাপ্ত আছে। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে তুলার উৎপাদন বেশি বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারণ তুলা উৎপাদনে জমি চলে গেলে উল্টো আমাদের বিশ্ববাজার থেকে চাল কিনতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। অতীতে দেখা গেছে, ডলার নিয়ে ঘুরেই আন্তর্জাতিক বাজারে পর্যাপ্ত চাল পাওয়া যায়নি। ইন্টারন্যাশনাল কটন এ্যাডভাইজরি কমিটি (আইসিএসি) পূর্বাভাস দিয়েছে, উৎপাদন পুনরায় বাড়লেও এ বছর বৈশ্বিক তুলার মজুদ কমতে পারে। এ পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যটি মজুদে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ব্যবসায়ীরা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সম্প্রতি তুলার দাম ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। নিউইয়র্কের আইসিই ফিউচার্সে আগামী মে মাসে সরবরাহের জন্য প্রতি পাউন্ড তুলা লেনদেন হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৭ সেন্টে। অথচ মার্চ মাসে সরবরাহের তুলা বিক্রি হয়েছিল ৭৭ দশমিক ৩৫ সেন্টে। এ দর ২০১৪ সালের জুনের পর সবচেয়ে বেশি। ভারতের বাজারেও ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল ৮০ সেন্ট। বর্তমানে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ সেন্টে। তবে চীনের বাজারে তুলার দাম স্থিতিশীল আছে। আইসিএসি সম্প্রতি ২০১৭-১৮ মৌসুমের জন্য তুলা সরবরাহ ও চাহিদা-সংক্রান্ত প্রথম পূর্বাভাস সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। চলতি বছরের আগস্টে শুরু হতে যাচ্ছে তুলার নতুন মৌসুম। আইসিএসির পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী মৌসুমে তুলার মজুদ তৃতীয়বারের মতো কমবে। এ সময় বিশ্বব্যাপী পণ্যটির মজুদ দাঁড়াবে ১ কোটি ৭১ লাখ ৩০ হাজার টন, যা ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে কমিটি। আগামী মৌসুমে বিশ্বজুড়ে তুলা আবাদে জমির পরিমাণ এবারের তুলনায় ৫ শতাংশ বেড়ে পৌঁছবে ৩ কোটি ৬ লাখ হেক্টরে। বিশ্বের শীর্ষ তুলা উৎপাদনকারী দেশ ভারতে এর আবাদ চলতি মৌসুমের তুলনায় ৭ শতাংশ বেড়ে ১ কোটি ১২ লাখ হেক্টরে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাসে জানিয়েছে আইসিএসি। তুলার স্থানীয় মূল্য বৃদ্ধিতেই ভারতীয় চাষীরা আগ্রহী হচ্ছেন এর উৎপাদনে। ফলে ভারতে আবাদ বেড়েছে তুলার। ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও ২০১৭-১৮ মৌসুমে তুলা উৎপাদন বাড়বে। কমিটির তথ্যানুযায়ী, এ সময় দেশটিতে পণ্যটির উৎপাদন ৪ শতাংশ বেড়ে ঠেকবে ৪০ লাখ টনে। এ সময় ৪২ লাখ হেক্টরে এর আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। এ হার চলতি মৌসুমের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। চীনে আগামী মৌসুমে মজুদ কমবে বলে ধারণা আইসিএসির। বিশ্বে তুলার শীর্ষ ভোক্তা দেশটি এ সময় ১ কোটি ৭১ লাখ ৩০ হাজার টন পণ্য মজুদে সক্ষম হবে। যা দেশটির তুলার সর্বোচ্চ মজুদ থেকে ৫০ লাখ টনের মতো কম। তিন বছর আগে দেশটিতে তুলার মজুদ রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছিল। চীন ৯৩ লাখ টন তুলা মজুদে নিয়ে চলতি মৌসুম শেষ করবে বলে জানিয়েছে আইসিএসি। বাংলাদেশে তুলার চাহিদা ॥ আগামী দশ বছরে চাহিদার অন্তত দশ শতাংশ তুলা উৎপাদন করতে চায় বাংলাদেশ। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। চলছে উপযুক্ত জমি নির্বাচনও। আর এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, প্রায় ৯৫ শতাংশ আমদানি নির্ভর হওয়ায় ঝুঁকিও থাকে বড়। তাই দেশীয় উৎস শক্তিশালী হলে বাড়বে এই খাতের মূল্য সংযোজন। দেশে বস্ত্রশিল্পের চাহিদা মেটাতে উৎপাদনে রয়েছে প্রায় ৫ শ’ স্পিনিং মিল। এসব মিলে সুতা তৈরিতে বছরে তুলার প্রয়োজন হয় প্রায় ৬০ লাখ বেল। অথচ উৎপাদন দেড় লাখ বেলের মতো। বাংলাদেশের সবেচেয় বড় রফতানি খাত তৈরি পোশাকের কাঁচামালের জন্য আমদানি নির্ভরতা তাই ৯৫ ভাগের বেশি। অন্যদিকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তুলা উৎপাদনকারী দেশ চীনকেও আমদানি করতে হয় চাহিদার বড় একটি অংশ। তবে চীনের তুলা আমদানির পরিমাণ ২-৩ বছর ধরে কমছে। ফলে এত দিন তুলা আমদানিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশ এখন শীর্ষ আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বস্ত্র রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে তুলার চাহিদাও বাড়ছে। আগামী ২০২১ সাল নাগাদ দেশে তুলার এই চাহিদা দাঁড়াতে পারে প্রায় ১ কোটি বেলে। এই বিশাল চাহিদাকে সামনে রেখে দেশের উদ্যোক্তারা এখন বাড়তি সতর্ক নিয়েছেন। প্রতিনিয়তই যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন তুলার নতুন উৎসের খোঁজে।
×