ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা জড়িত বলে পুলিশের টালবাহানা

দালালের কবলে কিশোরী ॥ ঢাকায় কাজের কথা বলে কলকাতার বাজারে বিক্রি

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২২ মার্চ ২০১৭

দালালের কবলে কিশোরী ॥ ঢাকায় কাজের কথা  বলে কলকাতার  বাজারে বিক্রি

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ ॥ দালালদের খপ্পরে পড়ে ১৪ বছরের কিশোরী জেসমিন আক্তার ভারতে পাচার হয়ে গেছে। বাসায় কাজের কথা বলে ঢাকায় নিয়ে সংঘবদ্ধ নারী পাচারকারী চক্র জেসমিন আক্তারকে পাচারের পর কলকাতার যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের। জেসমিন আক্তার বর্তমানে ভারতের কলকাতায় রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা। তবে গত দুই বছরেও পুলিশ সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের কোন সদস্যকে গ্রেফতার কিংবা জেসমিনকে উদ্ধার করতে পারেনি। উল্টো পুলিশ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইর কর্মকর্তা মোহসিন হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, যশোরের স্থানীয় এনজিও সংস্থার সহায়তায় জেসমিনকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এদিকে জেসমিনকে উদ্ধার ও নারী পাচারকারীদের গ্রেফতার দাবিতে ময়মনসিংহ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে আজ বুধবার সকালে স্থানীয় বিদ্যাগঞ্জ স্কুলের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসূচী পালনের ডাক দেয়া হয়েছে। পুলিশ ও জেসমিনের পারিবারিক সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরদড়ি কুষ্টিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক বিল্লাল হোসেনের মেয়ে জেসমিন আক্তার। অভাব অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠা ১৪ বছরের কিশোরী জেসমিনকে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার বাসায় কাজের কথা বলে নিয়ে যায় ময়মনসিংহ সদরের বাজার কুষ্টিয়া গ্রামের কাশেম আলী ও জগন্নাথপাড়া গ্রামের গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মী জুয়েল মিয়া। পরবর্তীতে কাশেম আলী ও জুয়েল জানায়, ঢাকার মীরপুরের ২৬৬ নম্বর মনিপুর হোল্ডিংয়ের আব্দুল মান্নানের বাসায় ভাল আছে জেসমিন আক্তার। কিন্তু ২/৩ মাসেও জেসমিনের কোন খোঁজ খবর না পেয়ে বিল্লাল ও তার ছেলে মাহবুব রহমান ঢাকার মনিপুরের ঠিকানায় খুঁজতে যান। এ সময় ২৬৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের মালিক আব্দুল মান্নান পরিচয়ে বিল্লাল ও তার ছেলে মাহবুবকে জানান হয়, এই ঠিকানায় জেসমিন নামে কেউ নেই। এক পর্যায়ে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিল্লাল ওই দিন স্থানীয় লোকমারফত জানতে পারেন বাসার মালিক আব্দুল মান্নান গ্রামীণ ব্যাংকের এজিএম পদ মর্যাদার কর্মকর্তা। সেদিন জীবননাশের ভয়ে প্রভাবশালী আব্দুল মান্নানকে কিছুই বলতে পারেনি বিল্লাল। ঢাকা থেকে জেসমিনের সন্ধান না পেয়ে বিল্লাল ও তার ছেলে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। এলাকায় ফেরার পর কাশেম ও জুয়েল মিয়াও জেসমিনকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে টালাবাহানা শুরু করে। অবশেষে বিল্লাল হোসেন বাদী হয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় কাশেম আলী, জুয়েল মিয়া ও আব্দুল মান্নানকে আসামি করে অপহরণ ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন। কোতোয়ালি থানা পুলিশের এসআই মাহবুবুল আলম মামলাটি তদন্তকালে প্রশিক্ষণে চলে যাওয়ায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মামলাটি তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ ফাইনাল রিপোর্ট দেয় এসআই ফারুক আহমেদ। অথচ গ্রেফতার করে কোন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হয়নি। প্রচার রয়েছে, গোয়েন্দা পুলিশের এসআই ফারুক আসামি আব্দুল মান্নানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে চাঞ্চল্যকর নারী পাচার মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছেন। এর আগে এই মামলার আসামি কাশেম আলীর শাশুড়ি, শ্যালক ও শ্যালকের স্ত্রী এই তিনজনের মিথ্যা সাক্ষ্যগ্রহণ করে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়। ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ২০১৬ সালে মামলা করেন বিল্লাল হোসেন। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই তদন্ত করছে। বিল্লালের অভিযোগ কেবল থানা পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা পুলিশই নয়, এবার পিবিআইর তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। মামলার আসামিরা এলাকায় প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ালেও তাদের আটক কিংবা গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদের কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। প্রভাবশালী আসামি আব্দুল মান্নানকে বাঁচাতে এসআই মোহসিন হোসেন এখন নানা ফন্দিফিকির করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। জেসমিনের বাবা বিল্লাল হোসেন জানান, গত বছরের বাংলা অগ্রহায়ণ মাসে কলকাতা থেকে জেসমিনের ফোন আসে। এই মোবাইল ফোনের সূত্র ধরেই তিনি জানতে পারেন জেসমিন আক্তারের পাচার হয়ে কলকাতার বাজারে বিক্রি ও পরে লীলুয়া হোমে অবস্থানের কাহিনী। মোবাইল ফোনে জেসমিন তার বাবাকে জানিয়েছে, ঢাকার মনিপুরের আব্দুল মান্নানের বাসায় ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। জ্ঞান ফেরার পর জেসমিন বুঝতে পারে সে পাচার হয়ে বিক্রি হয়ে গেছে কলকাতার বাজারে। এ সময় তাকে বাধ্য করা হয় যৌনকর্মীর কাজে। মাসের পর মাস কেটেছে জেসমিনের কলকাতার যৌনপল্লীর ভেতর। একদিন কৌশলে জেসমিন পালিয়ে হাওড়া পুলিশ স্টেশনে গেলে সেখান থেকে ঠাঁই হয় লীলুয়া হোমে। সর্বশেষ গত ১১ মার্চ জেসমিন বাবা বিল্লালের কাছে মোবাইল ফোনে দেশে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়েছে। ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির গত ১৯ মার্চের মাসিক সভায় জানান, জেসমিনকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
×