ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে রাখাইন জনপদ

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২২ মার্চ ২০১৭

বিলুপ্তির পথে রাখাইন জনপদ

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ২১ মার্চ ॥ ১৯৯১ সালের আদমশুমারি কমিউনিটি সিরিজ পটুয়াখালী জেলার বইয়ের ৭৫ নম্বর পৃষ্ঠায় এখনও গ্রামটির নাম লেখা রয়েছে হুইচ্যানপাড়া। তখনকার তথ্যমতে গ্রামটিতে মোট ১০৫টি পরিবারের বসবাস ছিল। লোকসংখ্যা ছিল ৬০০। অথচ এখন গ্রামটির নাম করা হয়েছে হোসেনপাড়া। কবে, কারা, কিভাবে এমনটি করেছে তা কেউ বলছে না। আদি বাসিন্দা রাখাইনদের সৃজিত এ জনপদে তাদের পাড়ার মাদবরদের অর্থাৎ হেডম্যানদের নামানুসারে হয়েছে গ্রাম কিংবা এলাকার নামকরণ। যেমন কলাউ মগের নামানুসারে কলাপাড়া। কিন্তু এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু গভীর চক্রান্ত করে সাগরপারের এ জনপদের সঠিক ইতিহাস বিকৃত করে পাল্টে দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ গ্রামটির পূর্বদিকের গ্রামটির নাম এখনও মম্বিপাড়া। এটিও রাখাইনদের নামানুসারে। এ গ্রামের নাম পাল্টে দেয়া না হলেও রাখাইনপাড়ার দেবোত্তর সম্পত্তি জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল করে নেয়া হয়েছে। একই ভাবে নাচনাপাড়া এবং চইয়াপাড়ার নামটি পাল্টে রাখা হয়েছে উলামানগর। লটকে দেয়া হয়েছে একটি সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটির উল্টোদিকে দোকানপাটের সাইনবোর্ডে এখনও নাচনাপাড়া লেখা রয়েছে। এ অবস্থায় থেমে নেই। সাইনবোর্ডটির উল্টোদিকে বেড়িবাঁধের বাইরে রাখাইনদের শ্মশানের সামনের এবং আশপাশের জমি দখল করে স’মিল, বাড়িঘর করা হয়েছে। এখনও বন বিভাগের ছইলা-কেওড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে সাক্ষীর মতো। সব কেটে সাবাড় করা হয়েছে। যেন সব পাল্টে দেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। এছাড়া জমিজমা দখল তো নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পায়রা বন্দরসংলগ্ন ছ-আনি রাখাইনপাড়া ও তাদের জমিজমা এবং চলাচলের রাস্তার সামনের জমি দখল করে তোলা হচ্ছে স্থাপনা। এ নিয়ে রাখাইনরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। কিন্তু দখল থেমে থাকছে না। কলাপাড়ায় আদি বাসিন্দা রাখাইনদের এভাবেই বঞ্চনা করা হয়নি, নানাভাবে প্রতারিত করা হয়েছে। চরধুলাসার গ্রামে এখনও রাখাইনদের সমাধিস্থল এবং শ্মশান দৃশ্যমান। কিভাবে শ্মশান কিংবা পাড়ার সম্পত্তির মালিকানা বদলে গেল তা উদ্ঘাটন করা বেশ কঠিন। তবে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, ভূমি অফিসের কর্মীদের যোগসাজশে লুজ খতিয়ান খুলে এসব জমির মালিকানা পাল্টে দেয়া হয়েছে। লতাচাপলী ইউনিয়নের কালাচানপাড়ায় রাখাইনদের সবচেয়ে বড় শ্মশান রয়েছে। ওই শ্মশানের চারদিকে দখল করে তোলা হয়েছে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা। যতটুকু জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে তা এখন পানিবন্দী হয়ে থাকে। এমনকি শ্মশানঘেঁষে ল্যাট্রিন করা হয়েছে। এখন শ্মশানটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রাখাইনদের কেউ প্রয়াত হলে সৎকার পর্যন্ত করা যায় না। বর্তমানে রাখাইনদের এমন স্পর্শকাতর বেদনার কথা কেউ শোনারও নেই। এসব নিয়ে বহুবার দেন-দরবার করে এরা এখন কাহিল। লতাচাপলী মৌজার ২৬১নং খতিয়ানের ৫৪১৯ দাগের জমি ভূমি অফিসের মূল রেকর্ড বইয়ে এখনও দেবালয় লেখা রয়েছে বৌদ্ধবিহার। ৫৪১৮নং দাগে লেখা রয়েছে ইন্দিরা (কুয়া)। অর্থাৎ খাবার ও ব্যবহারের পানির জন্য পাড়ার রাখাইনরা কুয়া খনন করেছিল। এখানে মোট ২৫ শতক জমি রয়েছে। মূল মালিক ছিলেন ক্রাউনসে মগসহ অন্যরা। কিন্তু জালিয়াতচক্র বৌদ্ধবিহার ও ইন্দিরার ওই জমিসহ সব রেকর্ড সংশোধন করে দেয়। ১৯৭৫ সালের ১৪ অক্টোবর এ অপকর্মটি করা হয়েছে। বয়োবৃদ্ধ রাখাইনদের ভাষ্যমতে, ক্রাউনসে মগ ১৯৪৮ সালে দেশ ছাড়েন। তারপরও কিভাবে ’৭৫ সালে তার নামের রেকর্ডীয় জমি ভিনজাতির নামে চলে গেছে- এমন প্রশ্ন রাখাইনদের। কলাপাড়া ভূমি অফিসের বইয়ে ৬৩৬৩ নম্বর দাগের জমি এখনও রাখাইনপাড়া ও বাড়ি লেখা রয়েছে। অথচ এ জমিও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে দখল করে নেয়া হয়েছে। অথচ নিয়মানুসারে এসব জমি কখনও হস্তান্তর করার কথা নয়। ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ চক্র নির্দিষ্ট দালালের মাধ্যমে অন্য খতিয়ানের কেস রেফারেন্স দেখিয়ে মালিক সাজানো হয়েছে। এমনকি অন্য এলাকার দলিল নম্বর দিয়ে পর্যটন এলাকার জমি পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ১০২৩ নম্বর খতিয়ান খুলে কুয়াকাটার চার একর ৮৫ শতক জমি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সুইচাপাড়ায় এ জমির অবস্থান, যা পাড়ার মগগণের পক্ষে সুইথয় মগের নামে রেকর্ড সংরক্ষণ করা রয়েছে। অথচ মিস কেস নং ৬২-কে/১৯৯৬-১৯৯৭-এর মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের ২০ আগস্টের সম্পাদিত ১১৮৪ নম্বর দলিলের মাধ্যমে এ জমির মালিকানা পাল্টে নেয়া হয়েছে। ওই দলিলের বর্ণিত জমির অবস্থান কুয়াকাটা থেকে আট কিলোমিটার দূরে, মাইটভাঙ্গা গ্রামে। এ জমি থেকে আবার ৬২-কে (ঢ়-২) নামজারি কেসের মাধ্যমে ১৯৯৬-৯৭ সালে মোট জমি থেকে তিন একর ৩৩ শতক জমি এএম রফিকউল্লাহসহ অন্যান্যের নামে রেকর্ড সংশোধন করা হয়েছে। এমন জালিয়াতির অসংখ্য ঘটনা রয়েছে সাগরপারের এ জনপদে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী রাখাইন মেইনথীন প্রমীলা জানান, ১৭৮৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা থেকে রাখাইন অধ্যুষিত ১৯০টি পাড়া বা গ্রাম বিলুপ্ত হয়েছে। এসব পাড়ার হাজার একর জমি কাদের দখলে রয়েছে প্রশ্ন করে তা উদ্ধারে সরকারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে প্রমীলার দাবি। তাদের হিসাব অনুসারে পটুয়াখালীতে মোট রাখাইনপাড়া ছিল ১৪৪টি এবং বরগুনায় ছিল ৯৩টি, যার মধ্যে পটুয়াখালীতে রয়েছে মাত্র ৩৩টি আর বরগুনায় রয়েছে ১৪টি। পটুয়াখালী জেলায় যেসব রাখাইনপাড়া রয়েছে তার অধিকাংশ কলাপাড়া উপজেলায়। দুই-তিনটি গলাচিপা উপজেলায়। বর্তমানে কলাপাড়ায় রাখাইন পরিবারের সংখ্যা ৩২৫টি। কলাপাড়ার পর্যটন এলাকার অলঙ্কার রাখাইন জনগোষ্ঠী এভাবে নানা বঞ্চনায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। সাগরপারের আদিবাসী এ সম্প্রদায়ের দাবি, তাদের পাড়াগুলো রক্ষার্থে এখনই সরকারীভাবে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ঐক্য ন্যাপের নেতা দেশের বিশিষ্ট নাগরিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাখাইনদের সমস্যা তাদের চোখে দেখতে হবে।’ তখনই প্রকৃত সমাধান দেয়া যাবে।
×