ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানবপাচার রোধে মৃত্যুদ-ের মতো আইন করার তাগিদ

মানবপাচার ॥ সিরিয়া ফেরত এক নারীর করুণ কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১২ মার্চ ২০১৭

মানবপাচার ॥ সিরিয়া ফেরত এক নারীর করুণ কাহিনী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবপাচার ঠেকাতে মৃত্যুদ-ের মতো আইন প্রণয়ন দরকার বলে মনে করেন র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। বর্তমানে এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ১২ বছর সাজা হওয়ায় মানবপাচারকারীরা আইনের প্রতি এতটা তোয়াক্কা করছে না। রাজধানীতে মানবপাচাররোধে র‌্যাব ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ‘নিরাপদ অভিবাসন ও মানবপাচার প্রতিরোধ’ শীর্ষক এক সেমিনারে আলোচকরা এ খাতের সমস্যা ও সমাধানের ওপর মতামত তুলে ধরেন। সেমিনারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার নুরুল ইসলাম বিএসসি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সচিব বেগম শামছুন্নাহার, বায়রার সভাপতি বেনজীর আহমেদ ও বায়রার সাবেক সভাপতি নূর আলী। সেমিনারে বিদেশ গিয়ে প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার ১০ জনকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ফরিদপুরের মহিদুল মোল্লা ও পটুয়াখালীর গৃহবধূ শাহীনূর নিজের করুণ কাহিনী তুলে ধরেন। র‌্যাব ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, যদি নিবন্ধিত কোন কোন বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশে গিয়ে প্রতারণার ও নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে তাকে ওই দেশেই বিশেষ ব্যবস্থায় চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য এ মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনে যা যা করা দরকার সবই করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেনÑ মানবপাচারের মতো অপরাধের ঘটনা যখনই ফাঁস হয় কিংবা মিডিয়ায় আসে তখনই প্রশ্ন ওঠে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি করছে। ভুক্তভোগী মানুষের প্রয়োজনেই সাড়া দিতে হচ্ছে। প্রায়ই অভিযোগ আসে আমার কাছে, আমি তখন র‌্যাবকে বলি। সেভাবেই ব্যবস্থা নেয়ার পর অনেক ভুক্তভোগীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। শাহীনূর বেগম তাদেরই একজন তার মুখ থেকেই তো আপনারা একটু আগে শুনেছেন কিভাবে তাকে সিরিয়ায় পাচারের পর সাত মাস ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত র‌্যাবই তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছে। এ ধরনের কাজ করলেও কেন সমালোচনা চলে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিনি ইস্তান্বুলে গিয়ে দেখেন ৮০০ বাংলাদেশী বন্দী রয়েছে। তারা ভাগ্য অন্বেষণে ইউরোপে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়। এসব মানুষ লাখ লাখ খরচ করে দালালের মাধ্যমে গেছে। তারা আর দেশেও ফিরতে চায় না। জেল থেকে মুক্তি পেলে তারা ইউরোপে যে কোনভাবে পৌঁছাবে বলে তারা মনে করে। অসচেতনার অভাবে সাধারণ মানুষ এইভাবে বিপদে পড়ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেনÑ মানবপাচার ঘটছে কতিপয় অসাধু রিক্রটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের সহায়তায়। গ্রামের বেকার তরুণ-তরুণীরা না জেনে না শুনে মোটা অংকের টাকায় বিদেশে গিয়ে প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তখন তারা কোথাও আশ্রয় না পেয়ে র‌্যাবের কাছেই আসে। তাদের ডাকে সাড়া দিতেই র‌্যাব তার নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের জিম্মিদশা থেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। এ নিয়েও অনেক রিক্রুটিং এজেন্সি প্রশ্ন তুলেÑ কেন এ সেক্টরে র‌্যাব নাক গলাবে? র‌্যাব মহাপরিচালক আরও বলেন, মানবপাচার জঘন্য অপরাধ। একবার ভুক্তভোগীরা ৭/৮ লাখ টাকায় দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে আরও ভয়াবহ অবস্থার শিকার হয়। তাদের সেখানে জিম্মি করে মারপিট করে কান্না শুনিয়ে অভিভাবকের কাছ থেকে দ্বিতীয় দফা আরও ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে। এ ধরনের জিম্মিদশা থেকে উদ্ধারের পর দেখা গেছে মূলনায়করা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। ধরা পড়লেও সাজা হয় না। সাজা হলেও সেটা ১২ বছরের বেশি নয়। আমি মনে করি এ অপরাধের জন্য মৃত্যুদ-ের মতো আইন দরকার। সাবেক বায়রা সভাপতি নূর আলী অভিযোগ করেন, মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য সরকারীভাবে ১৪ লাখ লোক নিবন্ধন করেন। কিন্তু মাত্র ৭ হাজার লোক মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছে। বাকি লোক নিবন্ধন করেও কেন যেতে পারল না। এর দায় কে নিবে। যদি প্রতি বছর তিন লাখ করে লোক পাঠানো হতো তাহলে এত দিনে ২৭ লাখ লোকের চাকরি হতো বৈধ পথে। কিন্তু বৈধ পথ না পেয়ে অবৈধভাবে গিয়ে পাানিতে পড়ে মরে জঙ্গলে মরে। নূর আলী এ ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দায়ী করেন। জবাবে প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম শামছুন্নাহার বলেন, জিটুজি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের দুটো প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আন্ডারটেবিল ডিল করতে গিয়ে এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যর্থতার দায় সরকারকে দেয়া যাবে না। এ জন্য দায়ী বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো। সেমিনারে পাচার হয়ে যাওয়ার পর র‌্যাবের মাধ্যমে দেশে ফিরে আসা ১০ জন ভুক্তভোগীকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। বিদেশে থাকাকালীন এসব মানুষের প্রতি নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা করেন ভুক্তভোগীরা। অনুষ্ঠানে মানব পাচার রোধে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও বায়রার বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি তাদের অবহেলাও ফুটে উঠে। সেমিনারে সিরিয়া থেকে ফেরত শাহিনুর বেগম নামে এক নারী তার ওপর নির্যাতনের মর্মস্পর্শী বর্ণনায় বলেন, ভিটেমাটি বিক্রি করে দালালের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়ার জন্য দুই লাখ টাকা দেন। দালাল তাকে চট্টগ্রাম থেকে দুবাই হয়ে সিরিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে একজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। তাকে ভোর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। এর মধ্যে কাজে বিভিন্ন সময় ধরে প্রায়ই চাবুক দিয়ে মালিক তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পেটাত। মালিক এবং তার লোকজন যখন ইচ্ছা যৌন নির্যাতন করত। নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার সারা শরীর ফুলে যায়। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দুটি হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দেয় তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলে তাকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। সেখানে তিনি চিৎকার কান্নাকাটি করলে তাকে আবার আগের মালিকের কাছে ফেরত দেয় পতিতালয়ের লোকজন। ফেরত আসায় তার ওপর নেমে আসে আরও অমানবিক নির্যাতন। তাকে তিনদিন পর্যন্ত না খাইয়ে রাখা হতো। একদিন ইন্দোনেশিয়ার এক নারীর মাধ্যমে তার মায়ের কাছে ফোন করেন। তার মা র‌্যাবে জানালে তাকে উদ্ধার করা হয়। দেশে এসে চিকিৎসা করা হয়। তার দুই সন্তান রয়েছে। অসুস্থ’ শরীর আর দুই সন্তান নিয়ে এখন তিনি না খেয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অনুষ্ঠানে বায়রা নেতারা বলেন, তাদের নিবন্ধিত এজেন্সি কোন ধরনের অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। বেশির ভাগ সমস্যা সৃষ্টি হয় অনিবন্ধিত এজেন্সির দ্বারা। তারা বিদেশে পাঠানোর নামে সাধারণ লোকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হয়রানি করে। বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে বিদেশগামী পুরুষদের ৯০ শতাংশই দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হচেছ বলে সম্প্রতি টিআইবি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বায়রা বক্তারা। বায়রার সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমদ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন।
×