ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে আহ্বান

আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়...

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১১ মার্চ ২০১৭

আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়...

মোরসালিন মিজান ॥ দীর্ঘদিনের পথচলা। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ শুরুটা করেছিল ১৯৭৯ সালে। এখন ২০১৭। এ সময়ের মধ্যে দেশে কম কিছু ঘটেনি। কিন্তু কাজ অব্যাহত ছিল। আছে। সারাদেশ ঘুরে অনন্য সাধারণ কণ্ঠ খুঁজে বের করা কিংবা বাঁচিয়ে রাখা নয় শুধু, সমাজ এবং সমাজের মানুষের মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার লক্ষ্য কাজ করছে পরিষদ। সারাদেশেই কাজ হয়। তবে এখন দৃষ্টি ঢাকার দিকে। রাজধানী শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন। ষড়ত্রিংশতম বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে মুখর সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ। সারাদেশের ৭৫টি শাখা থেকে আসা শিল্পীদের মিলনমেলা বদলে দিয়েছে গোটা এলাকার চিত্র। শুক্রবার সকালে শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে তিনদিনব্যাপী আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। বোধনসঙ্গীতে শুরু হয় মূল প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতা। প্রার্থনার মতো করে শিল্পীরা গেয়ে যান, ‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহÑ/হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো/দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র/মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ...।’ জীবনের জয়গান গাওয়া শিল্পীদের সঙ্গে পরে যোগ দেন বাঙালী সংস্কৃতির অফুরান আলো সন্জীদা খাতুন। সম্মেলনের উদ্বোধক দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী ও পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমেদ লিসা ওঠে আসেন মঞ্চে। মঙ্গল কামনায় শুরু। সবাই মিলে প্রদীপ প্রজ্বালন করেন। সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে সম্মেলক কণ্ঠ। মঞ্চে হাঁটু ভাঁজ করে বসা শিল্পীরা গেয়ে যানÑ নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো,/যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো...। এর পর আলোচনা। উদ্বোধক কিছু কথা বলেন। তারও আগে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। সভাপতির ভাষণ নিয়ে সাধারণত শ্রোতাদের তেমন আগ্রহ থাকে না। কিন্তু সন্জীদা খাতুনের ভাষণ হয়ে ওঠে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বড় পাওয়া। ছোট্ট ভাষণে আজকের বাংলাদেশকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন অহর্নিশ সংগ্রামী। এর আলোকে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদকে করণীয় ঠিক করার পরামর্শ দেন। মৌলবাদ জঙ্গীবাদ যখন সাপের মতো ফণা তুলছে, যখন ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্মকে, তখন সন্জীদা খাতুন অভয় বাণী শোনান। বলেন, ধর্মের নামে ক্ষমতা দখলদারদের হাত থেকে আমাদের সংস্কৃতিকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে। মনে প্রাণে বাঙালী হয়ে ওঠা চাই। আর পরিপূর্ণ বাঙালী হওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। এবারের সম্মেলনের সেøাগানÑ মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ। এই সেøাগানের স্বপক্ষে তিনি বলেন, প্রাণের ভেতর দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। সে উৎসাহেই আমরা সকল প্রতিকূলতাকে জয় করব। সম্মেলনকে এগিয়ে নিয়ে যাব। রবীন্দ্রনাথই আমাদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস। তবে রবীন্দ্রচর্চা যেন কেবল উৎসব নির্ভর না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখার আহ্বান জানান কবিগুরুকে বোধের গভীরে লালন করা সন্জীদা খাতুন। অনুষ্ঠানে সম্মেলনের উদ্বোধক রফিকুন নবী বলেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের চলার উপায় নেই। ষাটের দশক থেকে এই মহামানবকে আঁকড়ে ধরেই এ পর্যন্ত আসা। সঙ্গীত, চিত্রকলাসহ জীবনের প্রতিটি পর্বে রবীন্দ্রনাথ তার অনুপ্রেরণা বলে জানান শিল্পী। আলোচনা শেষে শুরু হয় গান শোনার শুভ সকালটি। চোখ কচলে ঘুম থেকে ওঠা শ্রোতার যেটুকু যন্ত্রণা ছিল, মুহূর্তেই দূর করে দেয় পরিশিলীত কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিল্পীরা মঞ্চে পাশাপাশি বসেছিলেন। হারমোনিয়াম হাতে সামনে ছিলেন লাইসা আহমেদ লিসা। বিভিন্ন সময় প্রথম মান অর্জন করা বেশ কয়েকজন শিল্পী চমৎকার একক গান পরিবেশন করেন। এ তালিকায় ছিলেন মাকসুরা আক্তার, সুশান্ত রায়, অভয়া দত্ত, সুদীপ সরকার ও রিমা সাহা। ছিল সম্মেলক। গানের সঙ্গে নৃত্য যোগ হওয়ায় দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে প্রথম পর্বটি। তবে গান নৃত্য উভয় পরিবেশনায় প্রতিবাদ প্রতিরোধের ডাক দিয়ে যান শিল্পীরা। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা’ পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালানোর আহ্বান জানান। সুরে সুরে বলেনÑ মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়...। গানগুলোর সঙ্গে সুন্দর নাচেন শিল্পীরা। নৃত্য পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজে নাচেন ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, ‘জয় মা’ ব’লে ভাসা তরী’ গানটির সঙ্গে। এভাবে আনন্দধ্বনি জাগিয়ে শেষ হয় উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। দুপুরে দলীয় পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসে রবিরশ্মি। সম্মেলক গান পরিবেশন করেন সিলেটের শিল্পীরা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন জহিরুল হক। সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে ধৃতি নর্তনালয় ও নৃত্যাম নৃত্যশীলন কেন্দ্র। সন্ধ্যায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন মোহাম্মদ সিফায়েতউল্লাহ, মহাদেব ঘোষ, ফাহমিদা খাতুন, বিশ্বজিৎ সেন, কৃষ্টি হেফাজ, সুপ্রিয়া দাশ, তন্বী দত্ত, নাঈমা নাজ প্রমুখ। এসবের বাইরে উল্লেখযোগ্য আয়োজন প্রতিযোগিতা। প্রতি বছরের মতো এবারও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে সম্মিলন পরিষদ। দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় কিশোর বিভাগের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। আজ শনিবার সকালে অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ বিভাগের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। রবিবার সমাপনী দিনে প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হবে। এছাড়াও আজ বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে প্রতিনিধি সম্মেলন। বিকাল ৫টায় সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে ‘সভ্যতার সঙ্কট ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক সেমিনার। সন্্জীদা খাতুনের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ভুঁইয়া ইকবাল। সমাপনী আয়োজনে প্রধান অতিথি থাকবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রদান করা হবে রবীন্দ্র পদক ও গুণীজন সম্মাননা। এ বছর গুণীজন সম্মাননা পাচ্ছেন তবলাশিল্পী মদন গোপাল দাস ও পটশিল্পী শম্ভু আচার্য। সব মিলিয়ে বড় আয়োজন। রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করে এই এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত থাকুকÑ সকলের তাই প্রত্যাশা।
×