ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মগজের নির্ভুল সাক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত মহিমা

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১০ মার্চ ২০১৭

মগজের নির্ভুল সাক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত মহিমা

আমরা, যাদের জন্ম আশি বা নব্বইয়ের দশকে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধেরও এক বা দেড় দশক পর, বড় হয়েছিলাম ইতিহাস নিয়ে ছল-চাতুরিপূর্ণ রাজনীতির কঠিন সময়ে। আমাদের শেখানো হয়েছিল আমাদের কোন অতীত নেই, কোন বঙ্গবন্ধু নেই, জাতীয় চার নেতার প্রবাদপ্রতিম যূথবদ্ধতার ইশতেহার নেই; সুতরাং আমাদের কোন ভবিষ্যতও নেই। আমরা এই জেনে বড় হচ্ছিলাম যে, খঞ্জ বর্তমানটুকু ছাড়া আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। একটি প্রজš§কে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংগ্রামের দীর্ঘ ব্যাপ্ত পথ থেকে সরিয়ে কৌশলে বড় করা হচ্ছিল গৃহপালিত বনসাই ব্যাকরণে। সে প্রজš§ মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখবে না, ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করবে না; কেবল টেলিভিশনচর্চিত মেদবহুল কিছু মিথ্যে কথা জানবে কেননা রাষ্ট্র ও রাজনীতি তখন সেটাই চাইতো। ষাটের দশকের রাজনীতি তখন আমাদের কাছে গল্পের আখ্যান, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর অদৃষ্টপূর্ব সাহসিকতার অনুপুঙ্খ ইতিহাস আমাদের কল্পনারও অতিরিক্ত। দু’একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখানো হতো জাতীয় দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে এবং সেগুলোই আমাদের কাছে ছিল মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র স্মারক। চলচ্চিত্রের ফুটেজ কেটে রাখা বা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পুনর্উচ্চারণ থেকে সুকৌশলে “... ড়হ নবযধষভ ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ হধঃরড়হধষ ষবধফবৎ, ঃযব ংঁঢ়ৎবসব পড়সসধহফবৎ ড়ভ ইধহমষধফবংয, ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ...” অংশটুকুকে বাদ দেয়াও যেহেতু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতিরই অংশ ছিল, অতএব আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না। পাঠ্যপুস্তকগুলো তৈরি করা হয়েছিল অনাগত দিনে কিছু ব্ল্যাকশিপ তৈরি করা জন্য। ইতিহাসের নির্লজ্জ বিকৃতি ঘটিয়ে আমাদের মগজকে কফিন-বন্দী করার রাজনীতি তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বেশ দাপটের সঙ্গে চলেছে। আমাদের একমাত্র উজ্জ্বল উদ্ধার হতে পারত পরিবার; কিন্তু অপদর্শনের রাজনীতির মূল লক্ষ্যই যেহেতু হয় মধ্যবিত্ত, সেহেতু সেখানেও আমাদের আশ্রয় হলো না। যে মধ্যবিত্ত তৈরি করেছিলেন বাঙালীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সেই মধ্যবিত্তকে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনীতি ছেড়ে কথা বলবে কেন? সুতরাং বদলে গেল আমাদের পরিবারগুলোর মানচিত্র, হয়ে উঠল সামরিক ও মোল্লাতন্ত্রে মোড়ানো রাষ্ট্রযন্ত্রের সার্থক প্রতিচ্ছবি। সুতরাং পঁচাত্তরের পর নির্বাসিত হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সামগ্রিক স্তম্ভসমূহ। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ইত্যাদি বিষয়গুলো হয়ে উঠল প্রতœপ্রাণীপ্রতিম। ছাত্র রাজনীতির বিপরীতে দাঁড় করানো হলো সিভিল সার্ভিসকে, জ্ঞান-অর্জনের চেয়ে সনদ প্রদানকেই করে তোলা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান কাজ এবং সবশেষে রাজনীতিতে এমন কিছু সমীকরণ জুড়ে দেওয়া হলো যে, আমরা নিজেদের ‘রাজনীতিবিমুখ’ ভাবতে ভাবতেই বড় হলাম। সুতরাং আমাদের পুনরুত্থানের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পুনরুত্থান ঘটল, কেননা মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের বাইরেও একটি অপার দর্শন। কেননা, বঙ্গবন্ধু একজন ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের নেতার বাইরেও আমাদের জাতির পিতা এবং সেটাই মুখ্য। সময়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকে আড়াল করা হলেও তাকে অন্ধকারে বন্ধ রাখা যায়নি, ‘বাংলাদেশ দর্শনের’ বিরুদ্ধে ‘পাকিস্তানি ভূত-দর্শন’ প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিকভাবে তার চর্চা করা হলেও, তার গতিপ্রবাহকে রুদ্ধ করা যায়নি। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্রোত ও সেøাগান দশকের পর দশক অদৃশ্য ও অশ্রুত থেকেও বোধ ও মননে মৃতপ্রায় করে রাখা প্রজš§কে বাঁচিয়ে রেখেছে। গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ দর্শনের শক্তি এ কারণেই অনস্বীকার্য এবং অদ্বিতীয়। যূপকাষ্ঠে একাত্তর তবুও বিরাট মিছিল আগেই বলেছি, আমাদের প্রজš§ বেড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির আবর্জনাস্তূপের মধ্যে। স্বীকার করতেই হবে, এই আবর্জনাস্তূপ থেকে আমাদের টেনে বের করার দায়িত্বটি নিয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তিনি তাঁর শাড়ির আঁচল আর চশমার কাঁচে ধরে রেখেছিলেন শহীদ রুমীর মতো লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস এবং আমাদের মাঝে তা সঞ্চার করেছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আমাদের সামনে দিনের আলোর মতো ফুটে উঠেছিল ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের আত্মদানের সত্য ইতিহাস, উšে§াচিত হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক-দালালদের কুৎসিত রূপ এবং আমরা সশরীরে না হলেও মনোরৈখিকভাবে যুক্ত হয়েছিলাম শহীদ জননীর আন্দোলনের সঙ্গে। তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা কেবল যে আমাদের বন্ধ করোটির জানালাগুলো খুলে দিয়েছিলেন তাই নয়, একটি প্রজšে§র হƒৎপি-ে তাঁরা কাজ করেছিলেন যুগপৎ পালমোনারি শিরা ও ধমণীরূপে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দর্শন পাঠ আমাদের শুরু হলো শহীদ জননীর পাঠশালায়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তখনও আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের শিশুশ্রেণীর শিক্ষার্থী। ইতিহাস তখনও আমাদের কাছে কিছু সাল, তারিখ আর ঘটনার বাইরে তেমন কিছুই নয়। কিন্তু তখনও নির্মিত হচ্ছে ইতিহাসের বয়ান, প্রতিনিয়ত আমরা শিক্ষার্থী হিসেবে বড় হচ্ছি একটি দ্বন্দ্বমুখর ইতিহাসের জগতে। এই দ্বন্দ্ব যে কেবল জাতীয় পর্যায়ে, তা নয়; বরং তা আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজš§ কাজ করে যাচ্ছেন, তার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে নতুন প্রজš§ কিন্তু কোথাও কোন মিথষ্ক্রিয়া নেই। কারণ, যোগাযোগ মাধ্যম তখনও যোগাযোগবিজ্ঞানের অনুসারী হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধে মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী বামধারার রাজনৈতিক ভূমিকার যে পার্থক্য, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট আমাদের কাছে কেবলই ‘কিছু বিপদগামী সেনাসদস্যের নৃশংসতা’ বলে চিহ্নিত করা হলো; আমরা জানতে পারলাম না, সেনাবাহিনীর ভেতরে পাকিস্তানী আদর্শের কী ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল। এইসব নানা প্রশ্নের ভেতর দিয়ে আমরা বর্তমান শতাব্দীর প্রবেশদ্বারে এসে দাঁড়ালাম এবং পুনর্বার হোঁচট খেলাম ২০০১ সালের পর। বিএনপি-রাজাকার জোট সরকার গঠন করল এবং যারা যুদ্ধাপরাধী, যারা বাংলাদেশবিরোধী, তারাই গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে সংসদ ভবনে প্রবেশ করল। আমরা বুঝতে পারলাম, পূর্বসূরীদের পদচিহ্ন যতটা অবলোকনযোগ্য, ততটা অনুসরণযোগ্য নয়; কেননা, স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার দায় যতটা রাজনৈতিক মেরুদ-হীনতার, ততটাই আমাদের অগ্রজদের দায়িত্ব ও প্রতিবাদহীনতার। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকেন্দ্রিক কোন বুদ্ধিজীবী সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। অন্যদিকে সে সময়ে বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তারা অনুকূল পরিস্থিতিতে কলমচির দায়িত্ব ছাড়া আর কিছু পালন করেননি। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনভিত্তিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটাল যুদ্ধাপরাধীরা। তারা ধর্মকে ব্যবহার করল সুকৌশলে, পাকিস্তানী ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটাল প্রশাসনে, সেনাবাহিনীতে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য স্থলে; ফলত নতুন প্রজš§ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখল ইতিহাসের নানাবিধ ন্যারেটিভ সমাজে ক্রিয়াশীল এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিটিই অল্প-বিস্তর প্রতিষ্ঠিত। ধর্ম ও অর্থ বলে যুদ্ধাপরাধীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে তাদের কালো থাবা আরও শক্ত করে ফেলল। জঙ্গীগোষ্ঠী তৈরি করে সারা বাংলাদেশে বোমা হামলা চালানো হলো। এই বিরাট অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন প্রজšে§র লড়াইটি খুব কঠিন ছিল, কেননা তখনও আমরা নিজেদের বক্তব্য নির্দোষ চায়ের ক্যান্টিন ছাড়া আর কোথাও প্রকাশ করতে পারিনি। খবরের কাগজে বা টেলিভিশন চ্যানেলে আমাদের বক্তব্য প্রচারের আলো পায়নি। অগ্রজদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন ছিলেন, যাঁদের গ্রন্থে আমরা আমাদের চিন্তার উপাদান খুঁজে পেতাম। কিন্তু আমাদের ভাবনাটি কেমন, তা প্রকাশের বা জানানোর কোন উপায় আমাদের ছিল না। পক্ষান্তরে জামায়াত-শিবিরসহ অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো কৌশলে প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের জোরে তারা নিজেদের চিন্তা-চেতনার নতুন প্রজš§কে প্রচারের আলোতে এনেছে। একদিকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধি অপশক্তিÑ এ দুয়ের বাইরেও একটি তৃতীয় শক্তি কাজ করেছে, যাদের মূল লক্ষ্যটি ছিল বিরাজনীতিকীকরণ। তারা রাজনীতিরহিত একটি পুঁজিবাজারের সংস্থান করেছিল, যা নতুন প্রজš§কে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ একটি বায়বীয় অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে আমাদের মধ্যেই অনেকে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে সঠিক তথ্যানুসন্ধান করে মত প্রকাশ করাটাকে রাজনীতি ভাবতে শুরু করে। তাদের ধারণা হয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রাজনীতির বাইরে। বলাই বাহুল্য, এই বিভ্রান্ত অংশ, যদিও তারা জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে, তবুও বর্তমানে এই ধারণাটি তৈরি করার চেষ্টা করছে যে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি এক নয়। ধর্ম যে কখনোই রাজনীতির হাতিয়ার ছিল না, এটি যে একটি ব্যক্তিগত বিষয়, এই সহজ সত্যের বাইরে এসে তারা এখন নিজেদের আরোপিতভাবে হলেও ‘ইসলামদরদী’ প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। এদের এই অপগ- ধারণা শেষ পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতেই হাওয়া দিতে থাকে। জেনে হোক না জেনে হোক, তারা এই বিভ্রান্তি সুকৌশলে ছড়াচ্ছে। বলে রাখা ভাল, মুক্তিযুদ্ধের দর্শন নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ না করার ফলেই কিন্তু এই বিভ্রান্ত গোষ্ঠীটি তৈরি হয়েছে। হƒদয়ের কেন্দ্রে ইতিহাসের অনন্য ধ্যান নতুন প্রজšে§র ভাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সার্থক প্রতিফলনটি পাওয়া যায় ইন্টারনেট মাধ্যমে। আজ থেকে নয়, বর্তমান শতাব্দীর একেবারে শুরুর দশক থেকেই। সে বিচারে ইন্টারেনেটে বাংলা লিখতে পারাটা একদিকে যেমন ভাষা আন্দোলনের অমর চেতনার প্রতি নতুন প্রজšে§র কুর্নিশ নিবেদন, তেমনি এর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে নিজেদের ভাবনা-চিন্তার বিকাশ ঘটানোর একটি সুযোগ পাওয়া যায়। বাংলা ব্লগের যাত্রা শুরুর আগেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজšে§র ভাবনার একটি তুলনারহিত নিদর্শন ছিল টি-শার্টে মুক্তিযুদ্ধ। যাঁরা ভাবেন, টি-শার্টে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়াবলী উঠে এলেও নতুন প্রজšে§র বোধে তার কোন প্রতিফলন ঘটতো না, তাঁরা ভুল ভাবেন। এখানে বলে রাখা দরকার, যদিও কাজটি ছিল ব্যবসায়িক, তবুও সে সময়ের বিচারে যতটুকু সম্ভব হয়েছিল, ততটুকুই করেছিল তৎকালীন প্রজš§। পোস্টার যেমন যোগাযোগের একটি মাধ্যম, লিফলেট যেমন বক্তব্য প্রচারের কৌশল, টি-শার্টও তেমনি ছিল পারস্পরিক যোগাযোগের একটি ভিত্তি। সে সময় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণটিও আমার বিচারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, কেন বিএনপি-রাজাকার সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও, তাদের সন্ত্রাসীদের নানাবিধ নির্যাতনের পরও টি-শার্টে বঙ্গবন্ধুর ছবিই থাকবে। সেই টি-শার্ট গায়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতেও দেখেছি বন্ধুদের। সুতরাং বিকৃত ইতিহাসের যে ঘোল খাওয়ানো হয়েছিল প্রজš§কে, তা তারা উগড়ে দিয়েছিল। স্বীকার্য, টি-শার্ট, চাবির রিং বা মোবাইলের কলার টিউনে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গান কোনভাবেই এটি প্রমাণ করে না যে, আমাদের বোধের আকাশে উড়ছে মুক্তিযুদ্ধ দর্শনের অনন্য শ্বেত পায়রা। স্বীকার্য, তখনও জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্কর বা মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্রের ফুটেজ সংগ্রাহক লিয়ার লেভিন আমাদের কাছে কেবলই মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু; কিন্তু কেন তাঁরা সে সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সে প্রশ্নের উত্তরটি আমরা তখনও খুঁজিনি। এই উত্তর খুঁজতে সাহায্য করল বাংলা ব্লগ। বাংলা ব্লগের শুরুর দিকে দেবদূতের মতোন কিছু ব্লগার নিরলস পরিশ্রম করে এই সত্যটি আমাদের মগজে গেঁথে দিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ ছিল মানবতার বিনাশের বিপরীতে মানুষের জয়গান। পৃথিবীর নিপীড়িত, নির্যাতিত অগণিত মানুষের জন্য সাহসী উদ্বোধনের ইশতেহার। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শনই মুক্তিযুদ্ধের দর্শন। বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের দৃপ্ত উচ্চারণই আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। সুতরাং সারা পৃথিবীর যে রাষ্ট্র বা মানুষেরা আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন এই জন্য যে, তাঁরাও এই মানবতার স্নিগ্ধ জয়গানেরই ধারক ও বাহক। কী আশ্চর্য! আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দর্শন যে অনন্যতায় ঋদ্ধ, তাকে কয়েকটি সাল-তারিখ-ঘটনার বৃত্তে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে, আর্কাইভের অন্ধকার থেকে সত্য ইতিহাস অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিলেন বাংলা ব্লগারদের কয়েকজন। পুরো কাজটি তাঁরা করলেন বিনা পারিশ্রমিকে, এবং এরই মধ্য দিয়ে তাঁরা আমাদের এটাও সেখালেন যে, এটা আমাদেরও যুদ্ধ। আদর্শের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধ চলমান। জহির রায়হানের মতো শহীদ জননী যেমন আলো ফেলেছিলেন আমাদের চৈতন্যের অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে, তেমনি আমাদের প্রজš§ও ব্লগ লিখতে শুরু করল অনাগত প্রজšে§র জন্য আলোর অপেরা তুলে রাখতে। আর যেন কখনও কোন প্রজšে§র মগজ আলোহীন অন্ধকারে ডুবে না যায়, তাই কাজ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। নির্মিত হতে থাকল মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র। বাংলা ব্লগ থেকে একে একে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি সুসংহতভাবে উঠে আসতে লাগল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে যোগ করল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আমরা লক্ষ্য করেছি কিভাবে স্বাধীনতাবিরোধিরা ট্রাইব্যুনালের বিরোধিতা করেছিল। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ব্লগে, প্রকাশনায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর প্রতিবাদ হয়েছে ইতিহাস থেকে তথ্য খুঁজে এনে। ব্লগ যেহেতু কেবল লেখাই নয়Ñ একই সঙ্গে অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমওÑ তাই বিভিন্ন অডিও বা ভিডিও ফুটেজও একে একে উঠে এসেছে বাংলা ব্লগে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ব্যক্তিগত আর্কাইভ তৈরি হয়েছে, যেহেতু আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, স্বাধীনতাবিরোধিরা ক্ষমতায় এসে আর্কাইভের মহামূল্যবান বিষয়বস্তুও নষ্ট করে দিয়েছে। এই আর্কাইভের স্বর্ণখনি অকাতরে তরুণ প্রজšে§র হাতে তুলে দিয়েছেন অনেকেই। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি গবেষক এম এম আর জালাল ভাইকে, যিনি এখনও বাতিওয়ালার কাজ করে যাচ্ছেন ইতিহাসের রাজপথে আমাদের ভবিষ্যত পদবিক্ষেপটি যেন আলোকিত হয়, সে লক্ষ্যেই। অমি রহমান পিয়াল, কুলদা রায়, আরিফ জেবতিকের মতো ব্লগাররা আমাদের হাতে ধরে শিখিয়েছেন কিভাবে অন্তর্জাল মাধ্যমে ইতিহাসের নথিভুক্তি করতে হয়। বিতর্ককে উৎরে যেতে না পারলেও প্রচার মাধ্যমেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ লক্ষ্য করেছি। স্থূল হোক, তবুও বিজ্ঞাপনে বা নানাবিধ ব্যবসায়িক মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে দেখছি। এই ধারাটিও থাকবে, কেননা যারা ব্যবসাদার, তারা বুঝতে পারছে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর অমর আবেগের একটি পবিত্র জায়গা। কিন্তু আবেগসর্বস্ব যে নয়, তার প্রমাণও আছে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে না বুঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ব্যবহার করতে গিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন অনেকেই। ফলে এটাও একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। একটি রক্ষাকবচ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে, ঐতিহাসিক চেতনাকে কোনভাবেই বিকৃত পুঁজির কাছে বিকিয়ে দেয়া যাবে না। এই সচেতনতার জায়গাটি সম্ভবত নতুন প্রজšে§র ইতিহাস চর্চার একটি নতুন সংযোজন। বাংলা উইকিপিডিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সংক্রান্ত ভুক্তি সমৃদ্ধ হচ্ছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে ইংরেজি ভাষার উইকিপিডিয়াতেও। মুক্তিযুদ্ধের ই-আর্কাইভ তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আজ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন অসত্য তথ্য উত্থাপিত হলেই তার প্রতিবাদ হচ্ছে মুহূর্তে। প্রতিবাদ হচ্ছে সরাসরি। ইংরেজী ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের অনেক দলিল ও লেখা অনূদিত হচ্ছে। বিষয়ভিত্তিক ওয়েবসাইট তৈরি হচ্ছে। সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের যে কোন বিষয় নিয়ে বাংলা বা ইংরেজীতে সার্চ করলেই আমরা তথ্য পাচ্ছি। তথ্যের অবাধ উš§ুক্ত তানে তত্ত্ব কী তবে ঘরছাড়া? লক্ষ্য করার মতো বিষয় হচ্ছে, এই বিতর্কের সূত্রপাতও এখন অনলাইনেই হচ্ছে। আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিতর্ক হচ্ছে। একই সঙ্গে ঋদ্ধ হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা। বিভ্রান্তির বিপরীতে মনোজগতের আধিপত্যবাদ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার একটি দিক হলো, সেটি সকলেই ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং আজ নতুন প্রজš§ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে দেবার জন্য অন্তর্জাল মাধ্যমকে ব্যবহার করছে, তেমনি স্বাধীনতাবিরোধিরাও একই মাধ্যমকে ব্যবহার করছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির জন্য। সুতরাং অনাগত প্রজšে§র সামনে কী অপেক্ষা করছে, তার সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে আমাদের প্রচেষ্টা কতটা সৎ ও পরিশ্রমীÑ তার ওপর। এখানেও স্বাধীনতাবিরোধীরা দেদারসে টাকা খরচ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আছে। তাকে ব্যবসায়িক তত্ত্বে রূপান্তরিত করেছে গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বা অন্যান্য মাধ্যমগুলো। এখন এই ব্যবসায়িক হিসেবে আমরা কোথায দাঁড়িয়ে? একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রিত ‘বাঁশেরকেল্লা’ পেইজ লাখ লাখ টাকা খরচ করছে তাদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পোস্টগুলো প্রচারের ক্ষেত্রে; তার বিপরীতে আমাদের অবস্থান কোথায়? লক্ষণীয় যে, এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কাজ করছে সমষ্টিগতভাবে; কিন্তু আমরা বিচ্ছিন্ন। সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয় বেশকিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এ বিষয়ে, কিন্তু সেগুলো অপ্রতুল কেননা ২০০৮ সালের পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধীরা কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে; অন্যদিকে আমাদের সরকার ব্লগ ফেসবুক বা অন্যান্য মাধ্যমের যৌক্তিকতা ও শক্তি বিষয়ে সচেতন হয়েছে ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের পর। সুতরাং আমাদের আরও দ্রুত, আরও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা জরুরী। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানাবিধ বিভ্রান্তি ছড়ানো শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। এটি আগেও ছিল, তবে এখন এর প্রকোপ বেড়েছে। আমরা মনে করতে পারি একাত্তরের ইতিহাস বিকৃতকারী শর্মিলা বোসের ডেড রেকর্নিং ১৯৭১ বইটির কথা। ব্লগে তার তুমুল প্রতিবাদ হয়েছে। অনেক বিশ্লেষণধর্মী লেখা তৈরি করেছিলেন ব্লগাররা। কেবল তা-ই নয়, ব্লগারদের মধ্যে যাঁরা দেশের বাইরে থাকেন, তাঁরা সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা সংস্থাতেও এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সম্প্রতি পাকিস্তানী লেখক জুনায়েদ আহমেদের লেখা বই ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, মিথস এক্সপ্লোডেড বইটিতেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে পাকিস্তানী বর্বর গোষ্ঠী। বই লিখে তারা অপকর্ম ঢাকার অপচেষ্টা করছে। এইসব প্রতিবাদে ইংরেজীতে মুক্তিযুদ্ধের নানা দলিলপত্র ও গ্রন্থাবলী অনুবাদ করা প্রয়োজন। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবীর ও সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমানের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র- এর ইংরেজী অনুবাদ এবং বাংলা-ইংরেজী উভয়েরই অনলাইন সংস্করণ থাকা জরুরী। এই কাজগুলো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া করা নয়। তাছাড়া বিভিন্ন বইপত্রের অনলাইন সংস্করণের বিষয়েও বাংলাদেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাকিস্তানী চক্রান্ত বাস্তবায়নের যে অপচেষ্টা রাজনৈতিকভাবে চালানো হয়েছিল পঁচাত্তরের পর, তা কিন্তু শেষ হয়নি। চক্রান্তের ধরন বদলেছে, কিন্তু চক্রান্ত চলছে। সুতরাং আমাদেরও লড়াই জারি রাখতে হবে। অনাগত প্রজšে§র মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আধিপত্যবাদ গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজšে§র মনন ও কাজে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা বর্তমানে ক্রিয়াশীল। তাকে সন্দর্ভের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও ভূমিকা প্রয়োজন। যে স্ফূলিঙ্গ এখন তৈরি হয়েছে, তাকে সৃজনশীল দাবানলে পরিণত করার কাজটি সকলের। আমরা চাই না আর কোন প্রজš§কে ইতিহাসের শুদ্ধ জলে স্নান করার জন্য অপেক্ষা করতে হোক অনেক বছর। তারা নিজেই যেন খুঁজে নিতে পারে নিজেদের অস্তিত্বের উৎসবিন্দু। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জš§ নেয়া বাংলাদেশের আর কোন প্রজšে§র মস্তিষ্ক যেন পাকিস্তানী ক্লেদাক্ত ধর্মান্ধতার ঊর্ণাজালে আটকে না যায়।
×