ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সাবরিনা আনাম

গল্প ॥ রুলিবালা

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৩ মার্চ ২০১৭

গল্প ॥ রুলিবালা

লোহার খুন্তি দিয়ে জ্বলন্ত চুলার কাঠগুলো আর একটু নাড়া দেয় আমেনা বেগম। কিছুটা নিবু নিবু হয়ে আসা কাঠ আবার গনগন করে জ্বলে ওঠে। যদিও বাড়িতে আজ অনেক মানুষ তবু মাঝরাতে সুনসান নীরবতা উঠোনময়। শুধু বড়া ভাজার ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ফেলছে। আমেনা বেগম দ্রুত হাতে বড়াগুলো ভেজে ভেজে বাঁশের ডালায় রাখছেন। মানুষটা ঠা-া তালবড়া খেতে ভালবাসে। রাতের মধ্যেই তাই বড়া ভাজার কাজটা শেষ করতে চান আমেনা বেগম। আমেনা বেগমের স্বামী জাফর আলী সাহেব হজ করে দেশে ফিরছেন। মোবাইল ফোনে তিনি জানিয়েছেন কাল ভোরে বাড়ি পৌঁছে যাবেন ইনশাল্লাহ। কলেজ পড়ুয়া ছেলে গতকালই ঢাকা চলে গেছে বাবাকে আনতে। দুই মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনিসহ বাড়িতে এসেছে। শহুরে বউ নিয়ে সন্ধ্যা রাতে এসে উঠেছে ছোট দেবর। আর আশপাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজন যারা তাদেরও সকাল সকাল চলে আসার কথা আছে। হাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসা কোন মানুষ না খেয়ে যেন ফিরে না যায় আমেনা বেগমের বৃদ্ধ শ্বশুর এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন ছেলের বউকে। তিনি নিজে যখন হজ করে ফিরেছেন তখনও নাকি এই নিয়ম ছিল। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন যারাই হাজী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাদের খাওয়ানো হয়েছে এক টুকরো খেজুর, এক চুমুক জমজম কূপের পানি আর গোশত-ভাত। জাফর আলী সাহেবের বেলায়ও রাখা হয়েছে একই ব্যবস্থা। কাল ফজর ওয়াক্তে নামাজের পর পরই গরু জবাই হয়ে যাবে। সকাল ন’টা বাজতে বাজতে চুলা থেকে নামবে গরম ভাত, আলুর ঘাঁটি আর গরুর গোশত। সূর্য ওঠার আগেই বাড়ির পুকুরে ফেলা হবে জাল। বড় সিলভার কাপের মুড়ো দিয়ে রান্না হবে আলুর ঘাঁটি। পাড়ার মসজিদ কমিটির লোকজন এসব কাজে হাতে হাতে সাহায্য করছে তাই রক্ষা। নইলে কী হতো কে জানে! ঘরের কাজে আজকাল মানুষ পাওয়া বড়ই মুশকিল হয়ে উঠছে। উঠতি বয়সের মেয়েরা সব ঢাকা শহরে চলে যাচ্ছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে। জোয়ান পুরুষেরা জমি অনাবাদি রেখে চলে যাচ্ছে ভিনদেশে। আমেনা বেগম তাড়াতাড়ি হাত চালান। তালবড়া ভাজার কাজ সেরেই তাকে রসুন, পেঁয়াজ কুটতে হবে। মসলা পেসার কাজটাও সারতে হবে দিনের আলো ফুটবার আগেই। ভাদ্র মাসের গুমোট গরমে থমকে আছে গাছের পাতা। চূলোর আগুন গুমোট ভাবকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। কুলকুল করে পিঠ ভিজে যাওয়া টের পাচ্ছেন আমেনা বেগম। তার পরেও তালবড়ার মিষ্টি গন্ধে কেমন মাতোয়ারা লাগে মনটা তার। সেই যুবতি বয়সের ছন্দ যেন আজ দেহ মনে। নির্ঘুম রাত অথচ এতোটুকু ক্লান্তি বোধ হচ্ছে না শরীরে। জাফর আলী সাহেব হজ করতে যাওয়ার পর থেকে গ্রামের মেয়েদের কাছে আমেনা বেগমের আলাদা একটা মর্যাদা তৈরি হয়েছে। হাজীর বউ বলে সম্মোধনের পাশাপাশি সবাই কেমন সমীহ করছে তাকে। স্বামীর গৌরবে আমেনার নিজেরও বেশ অহং বোধ হচ্ছে ইদানীং। আর হবে নাইবা কেন? সবার তো আর আল্লাহর ঘর দেখতে যাবার ভাগ্য জোটে না! আমেনা বেগমের বাপ-ভাইদের কপালে সে সৌভাগ্য জোটেনি। স্বামীর ভাগ্যে আমেনা বেগমের ভাগ্য খুলে দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। জাফর আলী সাহেব যাবার সময় বলে গিয়েছেন, এবার সব দেখে শুনে এসে পরের বার আমেনা বেগমকে সঙ্গে করেই নিয়ে যাবেন। কেউ দু’বার হজে গেলে, গ্রামের মানুষ তাকে ডবল হাজী বলে সম্মোধন করে থাকে। তার মানে আমেনা বেগমের স্বামীকেও লোকে ডবল হাজী বলবে এক সময়। আর তাকে বলবে ডবল হাজীর বউ। ভবিষ্যতের এই স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমেনা বেগম মিটিমিটি হাসেন। তারপরেই তার খেয়াল হয় কাজে দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি হাত চালান আমেনা বেগম। ধোঁয়া ওঠা তেলে চালের আটা আর পাকা তালের মিশ্রণ ঢালতে থাকেন। তারপর বাঁশের ডালাটা গোল গোল সোনালি রঙের তালবড়াতে ভরে গেলে দ্রুত চুলার কাঠ বাইরে বের করে এনে নিভিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। চলার পাশে স্তূপ করে রাখা আছে গাছের শুকনো পাতা, ডালপালা। চূলোর বাইরে বের করে আনা জ্বলন্ত কাঠ থেকে ওগুলোতে যাতে আগুন না ধরে সেজন্য ডালপালার স্তুপ ধরে একপাশে ঠ্যালা দেন আমেনা বেগম । কিন্তু কী এক অসতর্কতায় খচ করে ওঠে ডান হাতের কুঁড়ে আঙ্গুল। ফিনকী দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে আঙ্গুলটা দিয়ে। কোথা থেকে কী হলো তা বোঝার চেষ্টা না করেই চট করে রক্ত বের হতে থাকা আঙ্গুলটা ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরেন আমেনা। কাজের সময় এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারেন না তিনি। পরদিন দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই জাফর আলী সাহেব বাড়িতে পা রাখেন- ‘ কই গো নাফিসের মা কই গেলা...’। জাফর আলী সাহেবের এই এক দোষ। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনির সামনেই হাঁকডাক জুড়ে দেন। স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীলতা দিনকে দিন যেন বেড়েই চলেছে মানুষটার। এক মুহূর্ত চোখের আড়ালে যাবার উপায় থাকে না তাই আমেনা বেগমের। বাবা-মা গত হওয়ার পর বাপের বাড়িতে আর এমনিতেই যাওয়া পড়ে না। একটু পাড়া প্রতিবেশীর খোঁজ খবর নেয়া সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে সংসারের তালে। এদিকে মাথায় পাগড়ি, ঘাড়ে দাগ কাটা চাদর আর লম্বা আচকান পরা মানুষটাকে দেখে আমেনা বেগম প্রথমে হকচকিয়ে যান। জাফর আলী সাহেব সাধারণত পাজামা- পাঞ্জাবি পরেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তিনি সে পোশাকেই ছিলেন। তাই মাথায় পাগড়ি পরা মানুষটাকে দেখে হঠাৎ অচেনা লাগে। কিন্তু তার পরেই তার দু’চোখ ছাপিয়ে কান্না আসে। আল্লাহর ঘর ছুঁয়ে এসেছে তার স্বামী। সেই রহমতে স্বাস্থ্যটাও কেমন নাদুসনুদুস হয়েছে । আমেনা বেগমের নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়। এমন স্বামী ক’টা মেয়ের ভাগ্যে জোটে। নিজের আবেগকে আড়াল করতে আমেনা বেগম ছোট মেয়ে রওশনকে তাড়া দেন- ‘ যা মা তাড়াতাড়ি যা, তোর বাপের হাত খালি কর।’ মায়ের কথা মতো রওশন দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ায় বাপের পাশে। বেশ ভারি ভারি কয়েকটা ব্যাগ বাপ ভায়ের কাঁধ থেকে নামিয়ে ওদের রিলিফ দেয় রওশন। এর মধ্যে নাতি নাতনিরা ঘিরে ধরে নানাভাইকে। মক্কা থেকে কার জন্য কী আনা হয়েছে এটাই তাদের ভাবনার মূল বিষয়। জাফর আলী সাহেবও কম যান না। গুড়ের মতো মিষ্টি খেজুর, আতর, জায়নামাজ, তসবিহ, টুপি তো আছেই এমনকি বাচ্চাদের খেলনা, বাসনকোসন, গহনা, কাপড় চোপড় কিছুই বাদ যায়নি তার মার্কেটিং এর তালিকা থেকে। এক কথায় সব্বাইকে খুশি করেছেন তিনি। আমেনা বেগমের জন্যও নিয়ে এসেছেন একজোড়া সোনার রুলিবালা ও লকেটসহ গলার চেন। একগাদা আত্মীয়স্বজনের সামনেই জাফর আলী সাহেব স্ত্রীকে সে গহনা পরার হুকুম দেন- ‘রওশন তোর মাকে গহনাগুলো পরতে বল।’ আজ অবধি আমেনা বেগম এত ভারি গহনা পরার কথা চিন্তাও করতে পারেননি। বিয়ের সময় বাপ-ভাইদের কাছ থেকে পাওয়া একটা জোড়া ঝুমকো, চাঁদির গলার চেন আর স্বামীর দেয়া মুক্তার নাকফুল এ দিয়েই এত কালের জীবনটা চলে গেছে, তাই চকচকে সোনার বালা এবং লকেটসমেত গলার চেন আমেনা বেগমকে সত্যি খুব অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তিনি আড়ালে গিয়ে মেয়েকে বলেন গহনাগুলো সিন্ধুকে তুলে রাখতে। তারপর সারাদিন কেটে যায় কাজের তালে। আত্মীয়স্বজনদের খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করতে বেলা শেষ হয়ে যায়। ঘর দোর সাফ সুরত করে আমেনা বেগম যখন নিজের ঘরে ঢোকেন তখন আবারও বেশ রাত হয়ে গেছে। জাফর আলী সাহেব গভীর ঘুমে অচেতন। ঘরের ভেতরকার আলো আঁধারিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে যায়। দূর দেশ থেকে স্বামী তার জন্য এত দামী দামী উপহার এনেছেন, রাতের নীরবতায় তার ইচ্ছে করে ওগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে। খুব সন্তর্পণে সিন্ধুক থেকে তিনি গহনাগুলো বের করেন। স্বামীর ঘুম যাতে না ভাঙে সে রকম সতর্কতায় ওগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেন। ডান হাতের আঙ্গুলগুলো জোড়া করে বাঁ হাত দিয়ে একটা বালা পরার চেষ্টা করেন। কিন্তু অন্য রকম একটা অস্বস্তিতে তাকে থেমে যেতে হয়। আমেনা বেগম লক্ষ্য করেন তার ডান হাতটা অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠেছে। আঙ্গুলগুলো ভাজ করা যাচ্ছে না। নিজের হাতটাকেই তার খুব অচেনা লাগে। আমেনা বেগম গহনাগুলো আবার সিন্ধুকে রেখে দেন। গত ক’দিন থেকে মনের ভেতরে যে পুলক অনুভব করছিলেন, হঠাৎ তা মিইয়ে যায়। রাত বাড়তে থাকলে ব্যথাটা আঙ্গুল ছাড়িয়ে পুরো হাতেই ছড়িয়ে পড়ে। সকালে স্বামীর কণ্ঠস্বরে চেতনা ফেরে আমেনা বেগমের- ‘ বাবা নাফিস গোয়ালকান্দির ডাক্তারখানা থেকে তোমার মায়ের জন্য ওষুধ আনো। ডাক্তার সাহেবকে বলো উনি সারা রাইত জ্বরে ভুল বকছেন।’ আমেনা বেগম চোখ মেলে দেখতে পান ছোট মেয়ে রওশন পাশে বসে ভিজে গামছা দিয়ে তার কপাল মুছে দিচ্ছে। বড় মেয়ে রওনক উদ্বিগ্ন মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে। আমেনা বেগম নিজের হাত দিয়ে রওশনের হাতটা ধরতে গিয়ে আবার ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠেন। মনে পড়ে রাতের কথা। এর আগে এমন তো কখনও হয়নি! সকালের আলো ফুটেছে, অথচ তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। বলতে গেলে এসব স্বপ্নেও ভাবেননি কখনও! আল্লাহ্র ঘর ছুঁয়ে স্বামী বাড়ি ফিরলে, মেয়েরা জামাই, নাতি-নাতনিসহ এলে ভালমন্দ রান্না করে মনের মতো আদর যতœ করবেন এমনটাই তো ভেবে রেখেছিলেন। অথচ আজ একী হলো! নিজেকে তাঁর বড়ই পাপীতাপী মনে হয়। দু’চোখ ছলছল করে ওঠে। মায়ের চোখে পানি দেখে মেয়েরা মাকে সান্ত¡না দিতে চেষ্টা করে- ‘ তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো মা। আমরা রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করছি।’ আমেনা বেগম উঠতে গিয়েও পারেন না। বুঝতে পারেন এখনো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত গোয়ালকান্দির ডাক্তারখানা থেকে ওষুধ আসে। সপ্তাহ ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে সে ওষুধ খান আমেনা বেগম। মেয়েরাও মায়ের সেবা শুশ্রƒষা করে মাকে সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। ফলে জ্বরটা সারে কিন্তু হাতের অবস্থার কোন উন্নতি দেখা যায় না। বরং দিনে দিনে তা আরও বাড়ে। বিবাহিত মেয়েদের পক্ষে বেশিদিন নিজেদের সংসার ফেলে বাপের সংসারে থাকা কঠিন। এক পর্যায়ে বড় মেয়েকে চলে যেতে হয়, মাকে ঐ অবস্থায় রেখেই। ছোট মেয়ে রওশন আরও কিছুদিন রয়ে যায় মায়ের সেবায় কিন্তু বাদ সাধে গোয়ালকান্দির ডাক্তার মশায়। তিনি সাফ জানিয়ে দেন এ রোগী সারিয়ে তোলা তার পক্ষে সম্ভব না। শহরে বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। এদিকে মক্কা থেকে ফিরে আসার পর জাফর আলী সাহেবের মান মর্যাদা, কাজের পরিধি আরও প্রসারিত হয়। গ্রামের লোকজন যে কোন সালিশ, বৈঠকে জাফর আলী সাহেবকেই চায়। আগে শুধু ছিল সার-বীজের ব্যবসা। এখন গোয়ালকান্দি বাজারে একটা মোবাইল ফোনের দোকান দেয়ার কাজ চলছে। সবচেয়ে বড় যে কাজ হাতে নিয়েছেন, তা হলো হজে লোক পাঠানোর এজেন্সি খোলা। দোকানঘরের একদিকে মোবাইল ফোন সেট বিক্রি হবে, অন্যদিকে এজেন্সি কাজ করবে। মক্কা মদিনা একবার দেখে তৃপ্তি হয় না। জাফর আলী সাহেব ঠিক করেছেন এজেন্সির মাধ্যমে প্রতি বছর মক্কায় কেবল হাজীদের পাঠিয়েই ক্ষান্ত থাকবেন না, তিনি নিজেও যাবেন সঙ্গে। এতে করে বছর বছর যেমন মক্কা-মদিনা যাওয়া হবে, সমাজে মানমর্যাদাও বাড়বে। তো আয় উন্নতির এই চরম লগ্নে রোগগ্রস্ত স্ত্রীর পাশে বসে থাকার মতো সময় জাফর আলী সাহেবের নেই। বলতে গেলে সারাদিন গুরুত্বপূর্ণ এসব কাজ সেরে যখন ঘরে ফেরেন তখন আমেনা বেগমের ব্যথাতুর চেহারা কিংবা কঁকানোর আওয়াজ তাঁর খুবই বিরক্ত লাগে। তাছাড়া স্ত্রী অসুস্থ হবার পর থেকে ঘরে পছন্দনীয় খাবার-দাবার কিংবা প্রয়োজনীয় জিনিস কোনটিই ঠিকমতো পান না। এমনি পরিস্থিতিতে একদিন সন্ধ্যার পর খাবার দিতে গিয়ে রওশন পিতার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে- ‘আব্বা, আম্মারে নিয়া কী করবেন? গোয়ালকান্দির ডাক্তার তো জবাব দিছে। এখন শহরে বড় ডাক্তার দেখান লাগে। আর আপনের জামাইও আমারে নিবার আসতে চায়। আমি গেলে আপনের খাওয়া দাওয়া চলবে কেমনে!’ রওশনের কথা শেষ হতেই পারে না, তার আগেই ঝনঝন করে থালাবাটি মাটি পড়ে যাবার শব্দ পাওয়া যায়। গর্জে ওঠেন জাফর আলী সাহেব- ‘ ধুত্তারী! অসুখ্যা ম্যায়া মানুষ নিয়া আমি কি বইসা বইসা পূজা দিবো মনে করছো তোমরা? যাও নিজের সংসারে গিয়া শ্বশুর শাউড়ীর সেবা করো। আমার যা করার করবো আমি।’ ভাতের থালা উল্টে ফেলে গটগট করে হেঁটে জাফর আলী সাহেব বৈঠক ঘরের দিকে চলে যান। রওশন বেচারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। আমেনা বেগম ঘরের ভেতর থেকে সব শোনেন। সব শুনে তাঁর নিজের ওপরই আবার ক্ষেদ জমে। এতোবড় আল্লাহওয়ালা লোক তাঁর স্বামী, অথচ এমন স্বামীর খেদমতের সুযোগ না দিয়ে আল্লাহ তাঁকে বিছানায় ফেলে শাস্তি দিচ্ছেন। কতটা পাপী তাপী হলে আল্লাহ কোন মানুষের ভাগ্যে এমন বিপর্যয় ঘটান! নিজের ভারি হয়ে যাওয়া ডান হাতটাকে শূন্যে তুলে হঠাৎ তাঁর দুচোখে আগুন জ্বলে ওঠে। মনে হয় এই হাতটাই আসল প্রতারক। নইলে এমন সময় এ হাতের চেহারা এমন হবে কেন? প্রাণপণ শক্তিতে মাটির মেঝেতে নিজের হাতটাকে আছড়াতে শুরু করেন আমেনা বেগম। রওশন চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ততক্ষণে ফুলে যাওয়া আঙ্গুল থেকে রক্ত পুঁজ গড়িয়ে পুরো হাতের তালু ভিজে যায়। সে রাতে জাফর আলী সাহেব বৈঠক খানাতেই রাত কাটান। সকালে মুখে কিছু না দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যান। তবে দুপুরের আগেই ফিরে আসেন হাসিমুখ নিয়ে। সঙ্গে এক তরুণী। পাকা কলার মতো গায়ের রং, ছিপছিপে গড়নের তরুণীটিকে দেখিয়ে বলেন- ‘এই হইলো সোনালী। রোগীর সেবা, রান্ধন বাড়ন সবেতে ওস্তাদ। যা মা রওশন তোর মায়ের কাছে সোনালীকে নিয়া যা। আর আমারে তাড়াতাড়ি খাওন দে’। হতচকিত রওশন পিতার আদেশ অনুসারে আগন্তুককে মায়ের ঘরে ঢুকিয়ে দ্রুত ভাত বেড়ে দেয়। জাফর আলী সাহেব খুব নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার বাইরে চলে যান। রওশন মাকে খাইয়ে তরুণীকে নিয়ে খেতে বসে। খেতে খেতে যে গল্প হয় তাতেই জানা যায়, সোনালীর ঘর, বর সবই ছিল কিন্তু এখন নাই। দুই বছরের সংসারে ছেলেপুলে হয়নি বলে স্বামী তালাক দিয়েছে। ঘর ভাঙার পর এতদিন ভাইয়ের সংসারে আশ্রিত হতে হয়েছিল বেচারীকে। সেখানে ভাইয়ের বউয়ের গঞ্জনা কম সহ্য করতে হয়নি। সোনালীর ভাই রহমত খাঁ জাফর আলী সাহেবের হজ এজেন্সির একজন বড় পার্টনার। এই রহমত খাঁই জাফর আলী সাহেবের হাতে সোনালীকে তুলে দিয়েছে। সোনালীর ভাষায়- ‘ডাইনীর হাত থেইকে জাফর চাচা উদ্ধার করছে আমারে।’ তো কাজে কামে মেয়েটা সত্যি অতুলনীয়। মাছ কোটা, উঠোন নিকোনো, কাপড় ধোয়ার মতো কাজগুলো চোখের পলকে সেরে ফেলতে পারে সে। প্রথম দিন আমেনা বেগমের সারা শরীরে গরম তেল দিয়ে যেভাবে মেসাজ দিয়েছে, তাতে বহুদিন বাদে আমেনা বেগম হাতের ব্যথা ভুলে প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা এ সংসারে সহমর্মী একজন মানুষ পাওয়া গেছে। আমেনা বেগম অসুস্থতার মাঝেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। রওশনও খানিকটা আশ্বস্ত হয়। এক দুপুরে সে মায়ের কাছে কথাটা পাড়ে- ‘মা, সোনালী তো আছে, আমি কয়টা দিন তোমার জামাইয়ের দেখাশোনা করে আসিগে’ আমেনা বেগমও আপত্তি করেন না মেয়ের কথায়। রওশন চলে যায়। রওশন চলে যাবার পর সংসারের পুরো পরিবেশটা পাল্টে যায়। ঘরের আনাচে কানাচে আলোয় যেন ভরে উঠে। আমেনা বেগমের ঘরের পাশের জংলা জায়গাটা পরিষ্কার হয়ে লেবু, পেঁপের চারা বাতাসে দোল খায়। উঠোনের এক ধারে পায়রার খোঁপ বসে। নিঝুম দুপুরে পায়রার বকুম বকুম বাড়িটিতে প্রাণের নতুন স্পন্দন জাগিয়ে দেয়। শুধু আমেনা বেগমের ডান হাতটার চেহারা বিশ্রী হতে থাকে দিন দিন। একদিন নিজের ঘরে গুমোট অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে আমেনা বেগম শুনতে পান কথাগুলো-‘কুমড়ো বড়ির এতো সোয়াদ’! এরপর পরই মেয়েলী কণ্ঠের হি হি হাসি। দুপুরে কুমড়ো বড়ির ভর্তা আর কাঁটাপাতাসী মাছের চড়চড়ি সত্যি খুব স্বাদের হয়েছিল। কিন্তু এখন আমেনা বেগমের গা গুলিয়ে ওঠে। হাতের কাছে রাখা স্টেইনলেস স্টিলের গ্লাসটা ইচ্ছে করেই মেঝেতে ছুড়ে মারেন তিনি। মাটির মেঝেতে শব্দ তেমন না হলেও জাফর আলী সাহেব এবং সোনালী দু’জনেই দৌড়ে আসেন। যে কাজটা কখনোই করেননি এর আগে, সে কাজটাই এখন করেন জাফর আলী সাহেব। আমেনা বেগমের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নেন, বলেন- ‘ইস কত কষ্ট হইচ্ছে নাফিসের মা তুমার। থামো, বড় ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা আমি আজকাই করতাছি।’ তারপর চোখের পলকে অনেক কাজ হয়। ছোট জামাইকে মোবাইল ফোনে দায়িত্ব দেয়া হয়, কথা হয় ছেলের সঙ্গেও। কোথায় কীভাবে আমেনা বেগমের চিকিৎসা হবে, ফোনে ফোনে রাতের মধ্যেই সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে যায়। একটা ট্রাভেল ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে দেয় সোনালী। পরদিন যাবার সময় সোনালী আশ্বস্ত করে আমেনা বেগমকে- ‘চাচি আম্মা ভালো হইয়া আসেন তাড়াতাড়ি, এদিক নিয়া কুনো চিন্তা কইরেন না আপনি।’ আমেনা বেগমের চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে, তিনি কথা বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পান না। শেষ পর্যন্ত শহরের বড় ডাক্তারের কাছে শুরু হয় চিকিৎসা। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বেরিয়ে আসে রোগের কারণ। বিষাক্ত কাঁটা জাতীয় কিছু এ রোগের জন্ম দিয়েছে। তবে বড় দেরি হয়ে গেছে। চট করে মনে পড়ে যায় আমেনা বেগমের, হাজী সাহেব ফিরে আসার দিন তালবড়া ভেজে চুলা বন্ধ করতে গিয়ে হাতে কিছু একটা বিঁধে ছিল। কিন্তু পরদিন কাজের তালে ওদিকে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী দুটো সপ্তাহ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে যায়। ইনজেকশনের নিডল্, ওষুধ, ফিনাইল ইত্যাদির ঝাঁঝাল গন্ধ ঠেলে আমেনা বেগম যখন জেগে ওঠেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন কোন দুঃস্বপ্ন দেখছেন না। বাস্তবিকই তাঁর হাতের দুটো আঙ্গুল কাটা পড়েছে। ডাক্তাররা বলেছেন এছাড়া কোন উপায় ছিল না। দুহাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে আমেনা বেগম সংসারটাকে তিল তিল করে গড়েছেন। এখন কাটা হাতে সে সংসার আগলাতে হবে তাঁকে! এদিকে হাসপাতালে স্ত্রীকে পাঠিয়ে জাফর আলী সাহেব প্রায় প্রতিদিনই মোবাইল ফোনে খোঁজ খবর রেখেছেন। টাকা পয়সা পাঠিয়েছেন প্রয়োজন মতো। কিন্তু নিজে আসবার সময় পাননি। নিজের বাড়ির উঠোনে পায়রার ঘর থেকে যে আওয়াজ হয়, হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই সে আওয়াজ শুনতে পান আমেনা বেগম। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে তাঁর। ছেলে, জামাইকে কাছে ডেকে আমেনা বেগম ফিসফিস করে বলেন- ‘বাবারা আমার বাড়ি যাওনের ব্যবস্থা করো তোমরা। দেরি কইরো না।’ অবশ্যি ডাক্তার বলেছেন সব ঠিক হয়ে গেছে। ছেলে, জামাই তাই আপত্তি না করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা করে। ফিরে আসেন আমেনা বেগম নিজের সংসারে। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর তাঁর সব কিছু গোলমাল লাগে। কোন কিছুই যেন আগের মতো নেই। কিন্তু কি নেই সেটা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়। সোনালীকে সামনে দেখা যায় না। তার বদলে একটি কিশোরী দৌড় ঝাঁপ করে এটা সেটা এগিয়ে দেয়। দীর্ঘ পথের ক্লান্তিতে আমেনা বেগমের গলাটা শুকিয়ে এসেছিল। বাড়িতে ডাব গাছ আছে। একটা ডাব নামিয়ে পানি দিতে বলেন তিনি কিশোরীকে। অল্প সময়ের মধ্যে কিশোরী নয়, এক গ্লাস পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে লাল পাড় সোনালী জমিনের শাড়িতে ঘোমটা দেয়া এক নারী। বাইরে তীব্র রোদ কিন্তু আমেনা বেগমের ঘরের ভেতরটা শীতল অন্ধকার। শক্তিশালী এন্টিবায়োটিকের ডোজে তখনো মাথাটা ঝিম মেরে থাকায় ভাল করে তাঁর দেখতে অসুবিধা হয়। নারী আরও এগিয়ে এসে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দেয়। বিদ্যুত স্পর্শ পাওয়ার মতো আমেনা বেগম দেখতে পান পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়া হাতে সেই রুলিবালা, মক্কা থেকে হাজী সাহেব যেটা তাঁর জন্য নিয়ে এসেছিলেন। হাতের ব্যথায় সেটা তাঁর আর পড়া হয়ে ওঠেনি।
×