ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মামলা হয়, বিচার শেষ হয় না ॥ দ-বিধির ধারা বদলায় পুলিশ?

সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ বছরে প্রাণ গেছে ৬৪ হাজার

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২ মার্চ ২০১৭

সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ বছরে প্রাণ গেছে ৬৪ হাজার

আরাফাত মুন্না ॥ রাজধানীর টিকাটুলিতে ইত্তেফাক মোড়ের কাছে চলন্ত বাস উল্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক গোলাম হোসেন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন জালালউদ্দিন, শাহিদা বেগম ও সুজন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনাস্থলে আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন গোলাম হোসেন। এ সময় দ্রুতগতির মতিঝিলগামী ৮ নম্বর বাস ওই আইল্যান্ডের যাত্রীদের ওপর উঠে যায়। এতে গোলাম হোসেন মাথায় গুরুতর আঘাত পান। আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় বাসটি আটক করা হলেও বাসের চালক পালিয়ে গেছে বলে জানান ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেন। এভাবে প্রতিনিয়তই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেশনা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২৩ বছরে সারাদেশে ৮৪ হাজার ৪৩৫ সড়ক দুুর্ঘটনার ঘটনায় ৬৪ হাজার ১১২ প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া এসব দুর্ঘটনায় আরও ৬৩ হাজার ৫৬২ আহত হয়েছেন। এআরআই জানিয়েছে পুলিশের প্রাথমিক তথ্য বিবরণী থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার পর মামলা হলেই পুলিশ তথ্য সংরক্ষণ করে থাকে। ভুক্তভোগী কেউ মামলা না করলে কিংবা নিজেদের মধ্যে মীমাংসা করে ফেললে পুলিশের খাতায় কোন তথ্য থাকে না। এছাড়া দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে কেউ মারা গেলে সেই হিসাবও পুলিশের কাছে থাকে না। গত ২৩ বছরে সড়ক দুর্ঘটনার দায়ে কোন গাড়ি চালকের উল্লেখযোগ্য সাজা হয়েছে, এমন তথ্য জানা নেই এআরআইয়ের। এআরআই সূত্র জানায়, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনিরের প্রাণহানির ঘটনায় সম্প্রতি যে রায়টি হয়েছে এটিই স্মরণীয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নিয়মিতভাবে বিপুলসংখ্যক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালক বা মালিকের উপযুক্ত শাস্তি হয় না। পুলিশ ও সরকারী আইন কর্মকর্তাদের উদাসীনতার পাশাপাশি চালক ও মালিকদের সাজা শিথিল এবং দোষীদের কঠোর শাস্তির অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না বলে মন্তব্য তাদের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান তার এক গবেষণা পত্রে বলেছেন, ৪২ শতাংশ চালকেরই কোন শাস্তি হয় না। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর আদালত থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত ছয় বছরে গাড়ি চাপায় নিহতদের ঘটনায় দায়ের মামলায় ৫৯ শতাংশ আসামিই শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। সূত্র জানায়, গত ছয় বছরে ঢাকা মহানগরে গাড়িচাপায় নিহতের ঘটনায় ৯৩৯ মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭৩ মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। তদন্ত শেষ হওয়া মামলার মধ্যে ৩৯৯ মামলায় পুলিশ কোন আসামি শনাক্ত করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। মাত্র ২৭৪ মামলার আসামি চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। ২৬৬ মামলা এখনও তদন্তাধীন। এআরআইয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোঃ সাইফুন নেওয়াজ অতিরিক্ত সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে ভারি যানবাহনের চালক তৈরির কোন প্রতিষ্ঠান নেই। আমরা অনেক ড্রাইভিং স্কুল দেখি যারা শুধু হালকা যানবাহন চালনা শেখান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারি যানবাহনের চালকরা হেলপার থেকে চালক হয়ে যান। তারা তাদের ওস্তাদের কাছ থেকে গাড়ি চালানো শেখেন। তিনি বলেন, এআরআই একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার মাধ্যমে পেশাদার গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে। এসব চালকের সম্পূর্ণ স্কলারশিপের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। ১৯৯৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র ॥ এআরআইয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯৪ সালে দেশে ৩ হাজার ১৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫৯৭ প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে ২ হাজার ৭৩৬। ১৯৯৫ সালে ৩ হাজার ৩৪৬ দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬৫৩ জন নিহত এবং ২ হাজার ৮৬৪ আহত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ৩ হাজার ৭৩০ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪১ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৩০১ জন আহত হয়েছেন। ১৯৯৭ সালে ৫ হাজার ৪৪৮ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ১৬২ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৭৬ জন আহত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে ৪ হাজার ৭৬৯ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৮৫ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৯৯৭ আহত হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ৪ হাজার ৯১৬ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩১৪ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৪৫৩ আহত হয়েছে। ২০০০ সালে ৪ হাজার ৩৫৭ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৪৩০ জন নিহত এবং ১ হাজার ৯১১ আহত হয়েছে। ২০০১ সালে ৪ হাজার ৯১ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ১০৯ জন নিহত এবং ৩ হাজার ১৭২ আহত হয়েছে। ২০০২ সালে ৪ হাজার ৯১৮ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৩৯৮ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৭৭০ আহত হয়েছে। ২০০৩ সালে ৪ হাজার ৭৪৯ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ২৮৯ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৮১৮ আহত হয়েছে। ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৯১৭ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৬৮ জন নিহত এবং ২ হাজার ৭৫২ আহত হয়েছে। ২০০৫ সালে ৩ হাজার ৯৫৫ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ১৮৭ জন নিহত এবং ২ হাজার ৭৫৫ আহত হয়েছে। ২০০৬ সালে ৩ হাজার ৭৯৪ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ১৯৩ জন নিহত এবং ২ হাজার ৪০৯ আহত হয়েছে। ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৮৬৯ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭৪৯ জন নিহত এবং ৩ হাজার ২৭৩ আহত হয়েছে। ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৪২৭ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭৬৫ জন নিহত এবং ৩ হাজার ২৮৪ আহত হয়েছে। ২০০৯ সালে ৩ হাজার ৩৮১ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৫৮ জন নিহত এবং ২ হাজার ৬৮৬ আহত হয়েছে। ২০১০ সালে ২ হাজার ৮২৭ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৬৪৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৮০৩ আহত হয়েছে। ২০১১ সালে ২ হাজার ৬৬৭ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৪৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৬৪১ আহত হয়েছে। ২০১২ সালে ২ হাজার ৬৩৬ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৩৮ জন নিহত এবং ২ হাজার ১৩৪ আহত হয়েছে। ২০১৩ সালে ২ হাজার ২৯ দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৫৭ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩৯৬ আহত হয়েছে। ২০১৪ সালে ২ হাজার ২৭ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৬৭ জন নিহত এবং ১ হাজার ৫৩৫ আহত হয়েছে। ২০১৫ সালে ২ হাজার ৩৯৪ দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৩৭৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৯৫৮ আহত হয়েছে। ২০১৬ সালে অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ২ হাজার ১৭৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৮৪ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছে আরও ১ হাজার ৮৩৮। যাবজ্জীবন এড়াতে মামলা লঘু করে দেয় পুলিশ ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে বর্তমানে দ-বিধির ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা করা হয়। বিচারও সম্পন্ন হয় এ ধারাতেই। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় আগে ৩০৪ ধারায় বিচার করা হতো। ১৯৮৫ সালে গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা আন্দোলন করার পর ৩০৪ ধারায় বিচার বন্ধ হয়। ৩০৪ (খ) ধারায় শাস্তি সাত বছরের কারাদ-। তাও কমিয়ে তিন বছরের কারাদ-ের বিধান করে ওই আইন সংশোধন করা হয়। কিন্তু কোন সংশোধনীতেই বলা হয়নি যে ৩০৪ ধারায় চালকদের বিচার করা যাবে না। অথচ ১৯৮৫ সালের পর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারণে আর এ ধারায় কোন মামলাই হয়নি। এ অবস্থায় বিশিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, এ জন্য চালক দায়ী। এখন সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে হত্যার পরিকল্পনা না থাকায় এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিচার হত্যা মামলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। তবে এটিও যে হত্যাকা- তা আইনেই রয়েছে। অবহেলাজনিত কারণে দুর্ঘটনা ঘটালে কঠোর শাস্তির বিধানও বর্তমান আইনেই রয়েছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে সাধারণ দুর্ঘটনা আইনে মামলা রুজু করে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। এটা পুলিশের অজ্ঞতা বলেই মনে করা হয়।
×