মোরসালিন মিজান ॥ শূন্য মাঠে মেলা। গাছ নেই কোন। মাথার ওপরে তাপ বিকিরণ করে চলেছে সূর্য। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশে টেকা যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় জার্নিম্যান বুকসের সামনে কিছুটা ছায়ার দেখা মিলল। সেখানে দাঁড়াতেই এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। হাতে কয়েকটি নতুন বই। তিনি কিছু বলতে চান। প্রথমে মনে হয়েছিল বইপ্রেমী মানুষ। পছন্দের বই কিংবা স্টল খুঁজতে সহায়তা চাইবেন। ঠিক তার উল্টোটি ঘটল। জানা গেল, নিজেই তিনি লেখক। ৭৫ বছর বয়সী সরলপ্রাণ লেখিকা দুটি বই এই প্রতিবেদকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি লিখেছি। আকন্দ সামসুন নাহার আমার নাম। পড়ে দেখেন। ভাল লাগলে কিনবেন।’ তার মানে, নিজের লেখা বই নিজেই ফেরি করে বিক্রি করছেন! বলার অপেক্ষা রাখে না, অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এমন অভিজ্ঞতা নতুন। শুক্রবার মেলার ২৪তম দিনে বিরল এই অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব হয়।
বিপুল বিস্ময় লুকিয়ে রেখেই কথা হয় সৌখিন লেখিকার সঙ্গে। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক আলোচনা। তথ্য সংগ্রহের এই কৌশল বেশ কাজে আসে। জানা যায় অনেক অজানারে! এই মেলায় অজানা অচেনা এত এত লেখক। অগণিত বই। কেন? কীভাবে আসে? বহুদিন ধরেই এ আলোচনা। আর তারপর মাত্র এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে সব উত্তর পাওয়া হয়ে যায়!
আকন্দ সামসুন নাহারের জানান, ছোট বেলায় এটা সেটা লিখতেন। না জেনে বুঝেই লিখতেন। বড় হয়ে অভ্যাসটি আর ধরে রাখা যায়নি। বিশেষ করে সংসার সন্তান সামলাতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়ে গেছে অনেক। এখনও সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত। হাতে সময় আছে। তাই গত কয়েক বছর ধরে লিখছেন। আবেগের জায়গাটি পরিষ্কার। কিন্তু প্রকাশিত বই তো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্টল থেকে বিক্রি হওয়ার কথা। আপনি লেখক। আপনি নিজে কেন ফেরি করে বিক্রি করছেন? এমন প্রশ্নে যা জানা যায় তা প্রকৃত প্রকাশকদের জন্য সত্যি লজ্জার। তিনি বলেন, ‘আমার প্রকাশককে টাকা দিতে হবে। এবারের মেলায় দুটি নতুন বই এসেছে। আরেকটি আসার কথা, টাকা দিতে পারছি না তাই আসছে না। আমি গত বছর প্রকাশিত বই ফেরি করে বিক্রি করছি। এ টাকা প্রকাশককে দেব। তবেই নতুন বইটি বের করে দেবেন তিনি!’
অর্থাৎ বইয়ের সম্মানী বাবদ প্রকাশক লেখককে যে টাকা দিয়ে থাকেন, তার বিপরীত চিত্র এখানে। লেখিকা প্রকাশককে টাকা দিচ্ছেন। বিনিময়ে আসছে নতুন বই। পিলে চমকে যাওয়ার মতো তথ্যÑ একটি বইয়ের জন্য তিনি সর্বনিম্ন চল্লিশ হাজার করে টাকা প্রকাশকদের দিয়েছেন। আর একটি বইয়ের জন্য সর্বোচ্চ খরচ করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। তার হাতে ধরে রাখা একটি বইয়ের শিরোনাম ‘নিঝুম দ্বীপের মহাকাব্য।’ উপন্যাসটির পাতা উল্টে দেখা যায় প্রকাশ করেছে জয়তী নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। অন্য বইটির শিরোনাম ‘ইরানের জারান্দ শহর।’ লেখিকা জানান, দুটি বই ছেপে দেয়ার জন্য প্রকাশককে গত বছর মোট ৮০ হাজার টাকা দিয়েছেন তিনি। এর পরও অধিক মুনাফার আশায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বই কম ছাপিয়েছে। লেখকের সবগুলো কপি তারা বুঝিয়ে দেয়নি।
এবার তাই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বদল করেছেন লেখিকা। নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম নবরাগ। প্রতিষ্ঠানটির স্টলে নিজেই নিয়ে গেলেন লেখিকা। সেখানে পাওয়া গেল তার লেখা দুটি বই ‘যখন বৃষ্টি নামল না’ ও ‘সোহরাব-রুস্তম।’ জানালেন, প্রতিটির জন্য ৪০ হাজার করে ৮০ হাজার টাকা খরচ করেছেন তিনি। আরেকটি বই আসবে ঘাস ফুল নদী নামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে। কিন্তু ততদিনে হাত খালি। টাকা নেই। সেই টাকা যোগার করতেই বই ফেরির কাজ করছেন বলে জানান তিনি। প্রকাশককে তো লেখক টাকা দেন না। প্রকাশক লেখককে সম্মানী দিয়ে থাকেন। আপনি উল্টো করলেন কেন? প্রশ্ন করলে নিজের ভেতরের শিশুটি যেন বের হয়ে আসে। বলেন, ‘অতো কিছু কি আমি জানি নাকি? বই বের করতে খরচ লাগে না। টাকা ছাড়া কী করে হবে?’ বোঝা যায়, এমন সরলতারই সুযোগ নেন অসৎ প্রকাশকরা। তো, এই টাকা আসে কোথা থেকে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছেলেদের কাছ থেকে ধার হিসেবে নেই। বড় ছেলে বিদেশে থাকে। ছোটটা সঙ্গীতশিল্পী। আমি ছেলেদের ওপর নির্ভর করি না। বেশি প্রয়োজন হলে ধার-টার করি। পরে পরিশোধ করে দেই। প্র্যাস্টিজের ব্যাপার তো।’ কিন্তু এই যে ফেরি করে বই বিক্রি করছেন। এটা কতটা সম্মানের? জবাবে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হয় তাকে। বলেন, ‘আমার বই আমি বিক্রি করব। এতে প্র্যাস্টিজ যাবে কেন?’ ততক্ষণে বেশ ঘনিষ্টতা হয়ে গেছে লেখিকার সঙ্গে। আবেদনের মতো করে বলেন, ‘আমি একজন লেখক। সেটা কীভাবে প্রচার করবা বলো? আমি প্রতিষ্ঠিত লেখকদের মতো হতে চাই। চেয়ে চেয়ে কিছু হয়? এমন প্রশ্নেরও ভাল জবাব দেন। বলেন, ‘সব লেখকরাই শুরুতে আমার মতো ঘুরেছে।’ তাই বলে, ৭৫ বছর বয়সে? তার উত্তরÑ ‘শুধু উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করে...।’
নির্বাচিত বই ॥ ‘মার্কিন নথিতে উনিশশো একাত্তর’ প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের অবমুক্ত করা নথি সংকলন ‘সাউথ এশিয়া ক্রাইসিস, ১৯৭১’ এর ভাষান্তর করেছেন পলাশ দত্ত।
সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের বই ‘নতুন চর্যাপদ।’ বইতে নব-সংগৃহীত ৩৩৫টি পদ। সেই সঙ্গে রাহুল সাংকৃত্যায়নের ২০টি, শশিভূষণের ২১টি এবং জগন্নাথ উপাধ্যায়ের ৩৭টি পদ পরিশিষ্টরূপে যুক্ত হয়েছে।
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে মেলায় এসেছে ‘আবদুল মান্নান সৈয়দের জসীমউদ্দীন।’ সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজ করেছেন আহমাদ মাযহার। বইতে পল্লীকবি সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দের মূল্যায়ন। ৫টি উল্লেখযোগ্য ও অগ্রন্থিত প্রবন্ধে জসীমউদ্দীনের সৃষ্টির নানাদিক তুলে ধরেছেন তিনি।
আগামী প্রকাশ করেছে ‘চেরনোবিলের কণ্ঠস্বর একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথ্য ইতিহাস।’ স্ভেৎলানা আলেক্সেইভচের মূল রচনা ‘ভয়েস ফ্রম চেরনোবিল : দ্য ওরাল হিস্ট্রি অফ আ নিউক্লিয়ার ডিজ্যাস্টার’ থেকে অনুবাদ করেছেন অদিতি ফাল্গুনী।
‘ঢাকার ডায়েরি সতেরো ও আঠারো শতকের বাংলা।’ বের করেছে উৎস প্রকাশন। জে টি রেংকিনের মূল রচনা থেকে অনুবাদ করেছেন গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া।
অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে নূহ-উল-আলম লেনিনের কাব্যগ্রন্থ ‘একটি অখ- পৃথিবীর স্বপ্ন।’ রাজনীতির মানুষ কবিতায় নিজের চিন্তাকে নির্মাণ করেছেন। ব্যতিক্রম তো বটেই।
নতুন বই ॥ মেলায় এদিন এসেছে ১৪৬টি নতুন বই।
মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলায় এদিন ৫৩টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
মূল মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘ব্যারিস্টার আবদুল রসুল : জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মামুন সিদ্দিকী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তাবেদার রসুল বকুল এবং সুভাষ সিংহ রায়। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া।
প্রাবন্ধিক বলেন, বিশ শতকের প্রথম দুই দশক বাংলার সমাজ ও রাজনীতিতে আবদুল রসুল একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রভাবনা, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তাধারা ও ভাবাদর্শ বাঙালী সমাজকে বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছিল। উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে তাঁর চিন্তাধারা সমকালে ততটা গুরুত্ব লাভ না করলেও উত্তরকালে, এমনকি আজও তাঁর বিপুল প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন এবং সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশনা এবং নানাবিধ সমাজকর্মের মাধ্যমে তিনি একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
আলোচকরা বলেন, বাংলার রাজনীতির বিচিত্র পরিক্রমায় ব্যারিস্টার আবদুল রসুল এক ব্যতিক্রমী নাম। তিনি যেমন বাংলার রাজনীতির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র গঠন করতে চেয়েছেন তেমনি জনলগ্নতাকে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার কেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করেছেন। আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও তাঁর জীবন ও দর্শন এক প্রাসঙ্গিক বিষয়।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া বলেন, ব্যারিস্টার আবদুল রসুল একজন অসাম্প্রদায়িক-জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে নিজের অনন্য ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছিলেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী জনমত সংগঠনে তাঁর ভূমিকা বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সন্ধ্যায় ছিল ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র’, ‘হামিবা সাংস্কৃতিক একাডেমী’ এবং ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’র সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।