ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রহমান মতি

জীবনানন্দ দাশ ॥ চলচ্চিত্র ও গল্পে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জীবনানন্দ দাশ ॥ চলচ্চিত্র ও গল্পে

যত দিন যাচ্ছে জীবনানন্দ তাঁর আবেদন নিয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হচ্ছেন আমাদের কাছে। তাঁর কবিতার প্রভাব নতুন প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে, ছড়াবে আগামীতেও কারণ ধ্রুপদী গুণ আছে। সেকালেও ছিল জীবনানন্দের কবিতার পাঠককে গ্রাস করার শক্তি একালে তো আরও প্রবল হচ্ছে। অনেক নামে তাঁর নাম ‘প্রেমের কবি’, ‘রূপসী বাংলার কবি’, ‘মহাপৃথিবীর কবি’ এরকম আরও আছে অনেক। জীবনানন্দের এই আবেদন সিনেমাতেও এসেছে অনেক সময় অনেকভাবে। সেটা ওপার বাংলার সিনেমাতে যেমন এসেছে আমাদের এখানেও এসেছে। সেরকম কয়েকটি কাজ নিয়ে এই লেখাটি লেখার একটা চেষ্টা করছি মাত্র। যদি আপনারা ভিন্নতা পান এতে, তবে আমি ধন্য... জিঘাংসা জীবনানন্দ যারা পড়েছেন তারা ‘বনলতা সেন’কে চেনেন না এটা বিশ্বাস করা যায় না। বনলতা সেন নামটি দিয়েই জীবনানন্দকে একনামে চেনা যায়। আরও আছে অনেক কিছু তবে এটাই চিরপরিচিত। এ সিনেমার সুপারহিট গান ছিল ‘ও অনুপমা ও নিরুপমা’। গানটির শিল্পী খুরশীদ আলম ও রুনা লায়লা। অপূর্ব সুরের গান। এ গানের ‘মুখ’ অংশের কথাগুলোতে আছে ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন।’ নাটোরের বনলতা সেনের কথা জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় কয়েকবার উল্লেখ আছে। নামটা ইতিহাস এখন। সোনালি দিনের হিট নায়ক ওয়াসিম ও সহশিল্পী জবা চৌধুরীর লিপে গানটি অপূর্ব... দারুচিনি দ্বীপ হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ জীবনমুখী উপন্যাস থেকে বানানো সিনেমা। উপন্যাসের বা সিনেমার নামটিও যদি বলি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতা থেকে নেয়া। কবি বলেছেন ‘সবুজ পাতার দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর।’ অসাধারণ রোমান্টিক লাইন। এ সিনেমায় আসাদুজ্জামান নূর বিন্দুর বাবা থাকে যিনি একজন নাবিক। বিন্দু বাবার কাছে চিঠি লেখে মন খারাপ করে। বাবা তখন কোন না কোন সমুদ্রে অবস্থান করছে। বাবা নূর জাহাজে তখন মনে মনে কবিতা বলতে থাকে যেটা আসলে কবিতার মতো আবৃত্তি করলেও সেটি জীবনানন্দের গান ছিল যার লাইনগুলো এরকম- ‘রাতের আঁধারে নীল নীরব সাগরে আমাদের এ জীবন জনহীন বলয়ে কোথায় কখন অতিদূর থেকে ভেসে আসে।’ নূরের চোখের এক্সপ্রেশন তখন অসাধারণ... পদ্মপাতার জল তরুণ নির্মাতা তন্ময় তানসেন তাঁর রুচিশীল এ সিনেমায় জীবনানন্দের কবিতাকে গান হিসেবে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। কবির ‘তোমায় আমি’ কবিতার কথাগুলো সিনেমায় ইমন-মীমের লিপে আসে- ‘তোমায় আমি দেখেছিলাম ব’লে তুমি আমার পদ্মপাতা হলে; শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।’ গানের সঙ্গে সঙ্গে পিয়ানোর সুর দুয়ে মিলে একদম কাব্যিক হয়ে যায়... একজন সঙ্গে ছিল মুগ্ধ করেছে এ সিনেমাটি। মৌসুমী ও আসিফ ইকবাল জীবনানন্দের ‘ফসলের দিন’ কবিতাটি আবৃত্তি করে। মৌসুমীর লাল শাড়ি, খোঁপায় ফুল, মুখে মিষ্টি ভুবন ভোলোনো হাসি আর আসিফ ইকবালের চশমা চোখে ব্যক্তিত্ববান সাবলীল অভিনয়ে দুজনে চলে কবিতা আবৃত্তি- ‘যে ভালোবাসে কত ভালোবাসা দেখাতে সে পারে জেনেছি সেদিন যেতে হবে বলে তুমি গেছ চলে দূরে গেছ সরে যেতে হবে তাই আমি হাতখানা ধরে তোমারে আনিনি ডেকে কাছে’ ঘরের চারদিকে তখন রজনীগন্ধ্যা, হাসনাহেনা আরও সব ফুলের বাহারি শোভা। কী যে রোমান্টিক না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ওপার বাংলার ‘গয়নার বাক্স’ সিনেমাতে ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার আবৃত্তি দেখা যায়। প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ এভাবেই সিনেমাতেও থেকেছেন তার অপূর্ব সব কবিতার গ্রাস করা অনুভূতিতে। তিনি আছেন, থাকবেন আগামী দিনেও তাঁর সৃষ্টিতে। তাঁর কাজ নিয়ে আরও সিনেমা হতে পারে। জীবনানন্দের কথাসাহিত্য যেজন্য সিনেমা হতে পারে : কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কথাসাহিত্যের সিনেমাকেন্দ্রিক সম্ভাবনার কথা বলব। কবি জীবনানন্দ দাশ কথাসাহিত্যিক হিসেবে কেমন? এ প্রশ্ন সমালোচকরা বারবার করেছেন। অনেকে তাঁকে কথাসাহিত্যিক বলতেই নারাজ। জীবনানন্দ জীবনের বাইরে গল্প-উপন্যাস লেখেননি। জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিশেল দিয়েই লিখেছেন। সেসব গল্প-উপন্যাসে নারী-পুরুষের সম্পর্কের বিভিন্ন রেখাকে স্পর্শ করেছে। ব্যর্থ মানুষের সংখ্যা সেখানে বেশি। সেটা নিয়েই আপত্তি সমালোচকদের। তাদের প্রতি একটাই কথা এ বিশ্বে ব্যর্থ মানুষই বেশি বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে। জীবনানন্দের কয়েকটি গল্পের কথা বলব। তিনি কী বলতে ও দেখাতে চেয়েছেন দেখুন। ছায়ানট গল্পটি ছোট। প্রেমেন্দ্র মিত্র এ গল্পটির প্রশংসা করেছেন। কথক তার স্ত্রী রেবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। তাই স্ত্রী অন্য কারও প্রতি আসক্ত। ডাক্তার আসে কথকের বাসায়। দোতলায় থেমে থেমে চুমুর শব্দ আসে। তখন কথক নিজেকে বিকৃত শবদেহ ভাবতে থাকে। রেবা কিছুক্ষণ পরে নিচে এসে কথকে বলে-‘ডাকছিলে তুমি?’এ প্রশ্নটা মূলত রহংঁষঃরহম. কথক বুঝতে পারে তার অবস্থানটা কোথায়। সঙ্গ নিঃসঙ্গ কথক তার জীবনে বিয়ে করেনি। সে আত্মবিশ্বাসী না। একদিন রাতে কথকের পূর্ব পুরুষরা সবাই তাকে ঘিরে ধরে। তারা বলে তাদের ঐতিহ্য, শক্তি, পৌরুষ সবকিছুকে কথক শেষ করে দিচ্ছে যেটা তাদের অপমান। কথক আশ্চর্য হয়। পূর্ব পুরুষদের ঘিরে ধরার মতো যে কাল্পনিক আবহ গল্পতে এসেছে এ জন্যই গল্পটি আলাদা মাত্রা পেয়েছে। গ্রাম ও শহরের গল্প পুঁজিবাদী বিকাশে সুবিধাভোগীরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেছে। বেকারত্বে পড়েছে তরুণরা। রাষ্ট্র তাদের জন্য তেমন কিছু করতে পারেনি। শচীশ গ্রাম ভালোবাসে তবে কলকাতাও তার প্রিয়। প্রকাশের কলকাতা ভাল লাগে না। সোমেন নিজে কিছু করতে চায় জীবনে। শচীর কাছে সোমেনের বেকারত্ব হাস্যকর এবং তাকে ‘ভ্যাগাবন্ড’ ভাবে। মেয়েরা ভ্যাগাবন্ডকে পছন্দ করে না। সোমনের বেকারত্বের লক্ষণ ছিল এমন- শার্টে চুরুটের ছাই, মুখে দাড়ি, মাথার চুলে তেল নেই, চোখজোড়া মেহেদি রঙের। কথা হচ্ছে আজকের বাংলাদেশেও নিজ নিজ আইডিওলজির তরুণরা আছে যাদের বাস্তবতা এরকম। আর্টের অত্যাচার অসাধারণ গল্প। এ ধরনের গল্প লেখাই হয়নি আর। গল্পের তরুণ-তরুণীরা ছবি আঁকে, গল্প লেখে, কবিতা লেখে। এক একজনের এক এক দর্শন। একজন বলে- ‘যারা কবি তারা ছাড়া আর কেউ আর্টিস্ট না।’ সেটা অন্যরা মানে না। আবার একজন বলে- ‘চিত্রশিল্পীরা নিজেকে ফাঁকি দিয়ে ছবি আঁকে। কারণ, তারা ছবিতে পুরোটা প্রকাশ করে না।’ আলাদা দর্শনের ছেলেমেয়েগুলোর বেকারত্ব আছে, প্রেম আছে, প্রতিষ্ঠা না পাওয়ার জ্বালা আছে। তারপরও এরা নিজেদের শিল্পচর্চাটা বাদ দিতে পারে না। সেখানেই এই ‘আর্ট’ তাদের মাঝে অদ্ভুত এক ‘অত্যাচার’ তৈরি করে। এ চিন্তা তো চিরন্তন, যারা শিল্পচর্চা করে সবাই মানবে এটা ছাড়তে চাইলেও ছাড়া যায় না। মধুর অত্যাচারই বটে। মেয়ে মানুষ হেমেন-চপলা, দ্বিজেন-লীলা দুই দম্পতির গল্প। একদিন সামান্য রসিকতায় লীলা দ্বিজেনের দিকে চাকু ছুড়ে মারে, তখন হেমেন-চপলা বুঝে যায় তাদের সম্পর্ক ভাল না। রান্নাঘরে তখন স্টোভ জ্বলছে এবং সেটাই তাদের সম্পর্কের প্রতীক। একদিন হেমেন বাসায় ছিল না। দ্বিজেন এসে দেখে চপলা মেঝেতে গড়াচ্ছে। দ্বিজেন চপলার বিরাট মেদযুক্ত শরীরকে মেয়ে মানুষের হৃদয় ভেবে নেয়। তারপর জীবনানন্দের ভাষায় ‘আধঘণ্টা-একঘণ্টা-দুইঘণ্টা’ চপলাকে ভোগ করে দ্বিজেন। চপলাও উপভোগ করে সময়টা। এরপর আশ্চর্যভাবে চপলার মনের কথাটা বলা হয় এবং সেখানে সে চাচ্ছিল দ্বিজেন চলে যাক। কারণ হেমেন আসার সময় হয়েছে। লাইনটা ছিল- ‘গিন্নিরাও চায় যে তাদের স্বামী আসুক। এ অতিথি বেরিয়ে যাক।’ এই হচ্ছে মানুষের সাইকোলজি। নিজের কাছে ঠিক থাকা অন্যায় করার পরেও। জীবনানন্দের ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটিও একই বাস্তবতার। তবে এখানেও অদ্ভুত সাইকোলজি আছে। মাল্যবানের স্ত্রী অন্যের প্রতি আকৃষ্ট। সে পুরুষের সঙ্গে মাল্যবান নম্রভাবে কথা বলে। নিজেকে তার ‘অবাঞ্ছিত’ মনে হয়। কাক, সজারু, পাঠা এসব পশু-পাখির সঙ্গে নিজের ও চারপাশের মানুষের আচরণের মিল পায় সে। ‘মাল্যবান’ খুব গভীরভাবে ব্যক্তি মানুষের নিঃসঙ্গতাকে তুলে ধরে। প্রতিটি মানুষ স্বাভাবিক জীবন থেকে সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করলে তার নিজের সাফল্য, ব্যর্থতার নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়। কবিপতœী লাবণ্য দাশের জীবন থেকে জানা যায় সাংসারিক জীবনের নিবিড় ব্যাখ্যা। তিনি বলতেন- ‘কবিতা আমার ভালো লাগে না আমার ভালো লাগে সংসার।’ সংসারের প্রতি ভালো লাগা ‘মাল্যবান’ উপন্যাসেও দেখা যায় মাল্যবানের স্ত্রীর মাধ্যমে। মাল্যবান মূলত জীবনানন্দ দাশের আত্মজৈবনিক উপন্যাস। নিজের উপন্যাসই যখন কবিকে জানার জন্য অনেক বড় মাধ্যম তখন সেটাকে ঘিরে সিনেমা নির্মিত হতেই পারে। এতে করে একটা ডকুমেন্ট থেকে যায়। শিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে যেমন তারেক মাসুদ ‘আদম সুরত’ নির্মাণ করেছেন এরকম কাজ আরও হওয়া উচিত। জীবনানন্দকে তার ব্যক্তি থেকে কবিসত্তা এবং গদ্যসত্তার আলাদা জীবনানন্দকে জানতে সিনেমা একটা ভালো ফ্লোর দিতে পারে। বলতে গেলে বাইরের দেশে এ ধরনের কাজ আছে অনেক। রাশিয়ার প্রবাদপ্রতিম লেখক লেভ তলস্তয়ের জীবন নিয়ে নির্মিত ‘দ্য লাস্ট স্টেশন’ সিনেমাটি অসাধারণভাবে তলস্তয়-সোফিয়ার দাম্পত্য জীবনের সুখ, দুঃখ ফুটিয়ে তুলেছে। এ ধরনের সিনেমার প্রতি দর্শকের আগ্রহ থাকে। জীবনানন্দ দাশ দিন দিন বহুল পঠিত কবি তাই তার জীবন নিয়ে সিনেমা নির্মিত হলে দর্শকের আগ্রহ থাকবে দারুণভাবেই। তাছাড়া কবির জীবনের অধ্যায় ট্রাজিক। তাঁর বাস্তবতা একজন ঔপনিবেশিক সময়ের অবহেলিত কবির বাস্তবতা। তাকে কবিতা লিখে টাকা কামাই করতে হয়েছিল। কবিতা পাঠিয়ে পারিশ্রমিকের জন্য আবার উপযাচক হয়ে চিঠি লিখতে হয়েছিল। কবিতা পাঠিয়ে সম্পাদক কবিতা পছন্দ না করে আবার কবির কাছেই ফেরত পাঠিয়েছিল। সেই কবিতা পরে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। যারা ‘নির্জনতম’ কবি বলে থাকেন জীবনানন্দকে তাদের কাছে একটা রহস্যই তিনি। এ রহস্যকে ভেদ করতে বা রহস্যের একটা প্রমাণ সিনেমায় রাখা যেতে পারে। তাঁর ব্যক্তিজীবন আর পাঁচজন কবির মতো ছিল না। সমালোচকের যন্ত্রণা সহ্য করে লিখতে হয়েছে। সজনীকান্ত দাস অনেক অহেতুক সমালোচনার পরে নিজে কবির মৃত্যুর পর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিল। স্বীকার করে বলেছিল- ‘আমাদের কালের উজ্জ্বল কবিটিকে আমরা চিনতেই পারিনি।’ (জীবনানন্দ দাশ : বিকাশ-প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত) মৃত্যুর পর কবি জীবনানন্দ প্রবলভাবে পাঠকের মধ্যে বেঁচে আছে এবং দিন দিন বাড়ছে এর রেশ। কবির স্পেস থেকে এগুলো দেখানো যেতে পারে সিনেমায়। আর তার গল্পে-উপন্যাসে যে বাস্তবতা ও চরিত্র মেলে তারা আজকের সময়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। জীবনানন্দ তাঁর সময়ে যে বাস্তবতা ফেস করেছেন আজকে তার থেকে বড় বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। তাঁর সময়ের বেকারত্ব সমস্যা, শিক্ষকদের ছাপোষা জীবন, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য কলহে সৃষ্ট বহুগামিতা এসব বেড়েছে। তাঁর চরিত্রের মতোই আজকের টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সম্পর্কের ক্রাইসিসের উপরে সিনেমা হচ্ছে। সেসব সিনেমায় লিভ টুগেদার, বহুগামিতা, দাম্পত্য জীবনের কলহ থেকে মৃত্যু বা অপরাধ, আত্মহত্যা এসব দেখানো হয়। স্টারডমের ফলে তৈরি হওয়া সাংসারিক সমস্যা থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত চূড়ান্ত সমস্যা এ ধরনের চলমান যে বাস্তবতাগুলো এখন দেখাচ্ছে তারা সেসব জীবনানন্দ তাঁর গল্পে গত শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকেই দেখিয়ে গেছেন। তিনি বর্তমান থেকে অগ্রবর্তী চিন্তা করেছিলেন। তাহলে সেসব কাজ সেলুলয়েডে আসাই উচিত। জীবনানন্দ দাশের গল্প কী জীবনের বাইরের কথা বলছে? না, জীবনের নিবিড় কথাই বলছে যেখানে আছে মানুষের মানসিক বিভিন্ন কলাকৌশল। আজকের কলকাতাভিত্তিক আর্ট ফিল্মে স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের ক্রাইসিস, লিভ টুগেদার বা বহুগামিতার যেসব স্টোরি টেলিং দেখানো হয় জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে তো সেসব গত শতাব্দীর প্রথমদিকেই দেখানো হয়েছে। তারা কি তবে জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের থিম থেকে নিয়েছে!! তাদের ‘নাগরদোলা, হেমলক সোসাইটি, হাওয়া বদল, রাতের অতিথি’ সিনেমাগুলো জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের থিমকে ৎবঢ়ৎবংবহঃ করে। এমনকি তাদের ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’ সিনেমাটি ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরাব. তবে কি তারা জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের থিমকে তারা কাজে লাগিয়েছে? ভাববার অবকাশ আছে কিন্তু। এছাড়া জীবনানন্দের মৃত্যু পুরো বিশ্বের কবি সমাজেই আলাদা। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ট্রাম দুর্ঘটনায়। এভাবে মৃত্যু আর কোন কবির হয়নি। এ ট্র্যাজেডি দেখানোর জন্য সিনেমা হতে পারে সবচেয়ে অথেনটিক মাধ্যম। জীবনানন্দের চিন্তা নিয়ে আনঅফিসিয়ালি সিনেমা হয়েছে ওপার বাংলায় আমাদের এখানে অফিসিয়ালি হবে না কেন। আর হ্যাঁ, আজকের আধুনিক এ শতাব্দীতে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের ক্রাইসিস দিন দিন বাড়ছে এবং বাড়বে যেহেতু স্বাধীন হতে চায় সবাই। সম্পর্কের সেসব ক্রাইসিস থেকে জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাস নিয়ে আমাদের এখানেও সিনেমা নির্মাণের যথেষ্ট সুযোগ আছে। সিনেমা মুক্ত শিল্প মাধ্যম। দেশে দেশে বায়োপিক তো আজকাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ক্রিকেটার অনেককে নিয়েই হচ্ছে। তাঁদের জীবন যদি সমাজের জীবনের কথা বলে তবে কবির বিষয় তো আরও বেশি জরুরী। জীবনানন্দ দাশের জীবন এবং সাহিত্য দুটি ক্ষেত্রই সিনেমার মতো সবচেয়ে বড় শিল্প মাধ্যমে আসতে পারে। সচেতন নির্মাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ হলে এ প্রস্তাব সফল হবে।
×