ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঘরে বাইরের রাজনীতিতে

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঘরে বাইরের রাজনীতিতে

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পার্লামেন্ট হ্যাজ লস্ট এ গ্রেট পার্লামেন্টারিয়ান। তিনি আপাদমস্তক পলিটিশিয়ান ছিলেন।’ আর ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘সংসদের সার্বভৌমত্বে কেউ আঘাত করার চেষ্টা করলে, তিনি মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও তার প্রতিবাদ করতেন।’ বলছিলাম বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী ও সাতবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার-ঘাতক ছাড়া দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনীতিবিদ ও নেতা-কর্মীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল বিশেষ মর্যাদার। প্রকৃত অর্থেই আপোসহীন রাজনীতিবিদ ছিলেন এ নেতা। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার মতো স্পষ্টবাদী রাজনীতিক সুরঞ্জিত অপ্রত্যাশিতভাবে রেলপথমন্ত্রী থেকে ইস্তফা দেয়ার পরও রাজনীতির ঘরে-বাইরে মাথা তুলেই কথা বলেছেন সব স্থানে। তাঁর সমালোচনামুখর কণ্ঠে আওয়ামী লীগের কেউ মনোক্ষুণœ হলেন, প্রভাবশালী কেউ ক্ষুব্ধ হলেন তাতে কিছু আসত-যেত না রাজনীতির এ সিংহ পুরুষের। সত্য কথা বলে দলের ভেতর কারও কারও সমালোচনার মুখে পড়েছেন, দলের বাইরে তীব্র চাপের মুখে পড়েছেন, তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়া হলেও থোড়াই কেয়ার করতেন সুরঞ্জিত। চলমান গণতন্ত্রে তৃপ্ত ছিলেন না তিনি। তাই কঠোর উচ্চারণ করে বলতেন, ‘গণতন্ত্রে সহনশীলতা চাই।’ দরাজকণ্ঠে বলতেন, ‘আমি অধম বলিয়া তুমি উত্তম হইবে না কেন?’ নেতাকর্মী মহল তো বটেই, সকল মহলেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কখনও হয়ে যেতেন কঠোর আবার তুলার মতো নরমও। নিতান্ত পল্লী-অধ্যুষিত দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় শোকের ছায়া এখনও বিরাজ করছে। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ফেব্রুয়ারি চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এর আগে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। তাঁর বয়স হয়েছিলে ৭২ বছর। প্রাণহীন দেহের সঙ্গী ছিলাম আমিও। শেষকৃত্য হয় তাঁর জন্মমাটি দিরাইয়ে। সেদিন ছিল হাজার হাজার মানুষের ভিড়। হেলিকপ্টারে করে মরদেহ নেয়া হয়। হাওড়-অধ্যুষিত দিরাই ও শাল্লা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছেন তাঁরা। কেউ কেউ কাঁদছেন। কেউবা বসে আছেন চুপচাপ, নীরব। আবার কেউ কেউ ব্যস্ত শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে। প্রিয় নেতার মৃত্যুতে সবাই শোকে কাতর, স্তব্ধ। তাঁর নিজের হাতে লাগানো গাছ থেকে নেয়া ও ঢাকা থেকে আনা কাঠ দিয়ে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদকে ‘দাহ’ করা হয় দিরাই শহরের আনোয়ারপুরে নিজ বাড়িতে। বলে রাখা দরকার, তিনি তাঁর দিরাইয়ের নিজ বাড়ির আঙিনায় দুটি চন্দন কাঠের গাছ লাগিয়েছিলেন। এক নজর প্রাণপ্রিয় নেতার মুখখানি দেখার জন্য মানুষের ঢল তো ছিলই, প্রিয় নেতাকে বিদায় জানাবার সময় ছিল তাঁদের চোখে জল। প্রাণহীন দেহের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্মভিটার দৃশ্যটা এরকমই ছিল। পৌর শহরের থানা রোডে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দোতলা বাড়ির নিচতলায় উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সব অঙ্গ সংগঠনের কার্যালয়। সারাদিন সেখানে ছিল অসংখ্য নেতাকর্মীর ভিড়। ভবনের দোতলায় দুটি কক্ষ। দিরাইয়ে এলে একটি কক্ষে থাকতেন সুরঞ্জিত। কর্মীরা দেখালো সেই জায়গাটি। এই বাড়ির দরজা সব সময় খোলা থাকত নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের জন্য। তারা প্রত্যেকেই সমস্যা শোনাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। তৃণমূলের নেতাকর্মীর কাছে রাজনৈতিক গুণ ও ব্যক্তিগত কর্মে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার পাত্র। একবার যে তাঁর সাহচর্যে গেছে, সে-ই তাঁর ভক্ত হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দূরে দিরাই পৌর শহরের থানা রোডে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়ি। এই দিরাই থেকে ঢাকায় এসে জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রেখে গেছেন সুরঞ্জিত। স্থানীয় নেতা থেকে জাতীয় নেতা সুরঞ্জিতের রয়েছে নানা অভিজ্ঞতা। এক সময় নাটক করতেন, অভিনয়গুণ ছিল চমৎকার। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ‘দুখু সেন’ নামে পরিচিত। কারণ, খুব ছোট অবস্থায় তিনি মাকে হারিয়েছিলেন। স্কুলের বড় ভাইয়েরা ’৭৩ সালের দিকে স্কুল থেকে আমাদের মতো ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণীর ছোট ছোট ক্লাসের ছেলেদের টেনে নিয়ে আসতেন মিছিলে। ‘দুখু সেনের পক্ষে মিছিল করতে হবে।’ স্যারদেরও এমন ইঙ্গিত ও সমর্থন ছিল। রসবোধ তাঁকে রাজনীতিতে আলাদা পরিচয় এনে দিয়েছে। তিনি সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে ন্যাপ থেকে নির্বাচন করে প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হওয়ার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সবার মনোযোগ কাড়েন। কারণ, তখন আওয়ামী লীগ প্রায় সব আসনে বিজয়ী হয়। এরপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। মীর শওকত আলী (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) সেক্টর কমান্ডার, সুরঞ্জিত সাব-সেক্টর কমান্ডার ও মেজর জগজিৎ সিং ভাট উপদেষ্টা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সিনিয়র সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী তাঁর সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করেছেন। সিলেট-সুনামগঞ্জের তামাবিল, ভোলাগঞ্জ, বাঁশতলা, বালাট ও টেকেরঘাট নিয়ে ছিল ৫ নম্বর সেক্টর। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। সর্বশেষ তিনি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার চমৎকার এক জাদুকরী ক্ষমতা ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। নির্দিষ্ট কোন জায়গা নয়, সর্বত্র। সেটা পার্লামেন্টই হোক, রাজনীতির ময়দানই হোক। কেবল ভাটি বাংলায় কেন, সব জায়গায়ই দেখা গেছে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য সব শ্রেণীর লোক ভিড় জমাত। তিনি যখন সংবিধান কিংবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোন ‘আইনী’ পয়েন্ট নিয়ে সংসদে কথা বলতেন, তখন সব সদস্য তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। রাজনীতির কঠিন ভাষায় আক্রমণ করতেন প্রতিপক্ষ সংসদ সদস্যকে। কিন্তু তারা প্রতিবাদ করতে পারতেন না, কারণ তারাই ভুল। রাজনীতিতে বাকপটু, রসিক ও দক্ষ সাংসদ হিসেবে সুনামের অধিকারী ছিলেন তিনি। সুরঞ্জিত সেনের সকল প্রগতিশীল ও জনকল্যাণকর কর্মকান্ডের একান্ত সহযোগী ছিলেন তাঁর স্ত্রী ড. জয়া সেনগুপ্ত। তাঁর নির্বাচনী এলাকা দিরাই-শাল্লায় চায়ের টেবিল, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে সর্বত্রই এখনও তাঁদের প্রিয় ‘সেনদা’র বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা চলছে। ‘সুরঞ্জিত কাহিনী’ যেন একবার-দুবার বলার বিষয় নয়, মানুষের চোখে এমন জল কোন রাজনীতিবিদ মারা যাওয়ার পর সচরাচর দেখা যায় না- এমন মন্তব্য স্থানীয় তরুণ ‘ভাটি বাংলা বাউল একাডেমি ও গবেষণা কেন্দ্রের’ সাধারণ সম্পাদক দোলন চৌধুরীর। সুরঞ্জিতের ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাবার অবর্তমানে আমাদের অভিভাবক এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাবা জীবনভর মানুষের উপকার করে গেছেন। এলাকার মানুষের উন্নয়নে কাজ করেছেন। আমি চেষ্টা করব বাবার শেষ কাজটুকু করে যেতে।’ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার আগে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘ছোট দলের বড় নেতা’ হিসেবে। ১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও পরে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ছাত্রজীবনের প্রথম অংশ কেটেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পান। এরপর আইনে ডিগ্রী নেন। তিনি কয়েক বছর আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। প্রথম জীবনে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন সুরঞ্জিত। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে সংসদবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব দেন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলে ‘সংস্কারপন্থী’ নেতা বলে পরিচিত হন তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তিনি মন্ত্রিত্ব পাননি। বাদ পড়েন দলের কেন্দ্র্রীয় কমিটির সভাপতিমন্ডলীর পদ থেকে। ২০১২ সালে তিনি রেলমন্ত্রী হন। সে সময় তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (?এপিএস) ওমর ফারুকের আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে সমালোচনার মুখে পড়েন সুরঞ্জিত। এ ঘটনার পর মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করলেও তা গ্রহণ না করে তাঁকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। সম্প্রতি একটি মামলায় ওমর ফারুকের কারাদ- হয়েছে। রাজনীতিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে। কারণ, তিনিই হাজারও গুণের অধিকারী। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক [email protected]
×