ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভালবাসা দিবসের কথা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভালবাসা দিবসের কথা

প্রেম-ভালবাসা কোনদিন বিফলে যায় না। শতধারায় তা ফিরে আসে নিজের কাছেই। বৃষ্টির ধারা, ঝরনার স্রোত বয়ে যায়, আবার তা ফিরে আসে আপনার উৎসমুখে। ইংরেজ কবি কিট্স লিখেছেন, ‘ভালবাসা যে পেল না আর ভালবাসা যে কাউকে দিতে পারল না, সংসারে তার মতো দুর্ভাগা যেন আর নেই’। একজন মহান ব্যক্তির উক্তি, আমাকে সামান্যই ভালবাস, কিন্তু তা যেন দীর্ঘদিনের জন্য হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত সৃষ্টি শেষের কবিতায় লিখেছেন, ‘যে ভালবাসা ব্যপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব কিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় আসঙ্গ।’ ভালবাসা নিয়ে কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকদের করা এমন হাজারো উদ্ধৃতি দেয়া যায়। বিশ্বখ্যাত লেখক-উপন্যাসিক টলস্টয় লিখেছেন, ‘ভালবাসার অর্থ হলো, যাকে তুমি ভালবাস তার মতো জীবনযাপন কর।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যাকে সত্যিকার ভালবাসা যায়, সে অতি অপমান আঘাত করলে, হাজার ব্যথা দিলেও তাকে ভোলা যায় না।’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘যাহাকে ভালবাস তাহাকে চোখের অন্তরাল করিও না।’ মহাকবি কালিদাস লিখেছেন, ‘ভালবাসা জিনিসটা ভোগ করিতে না পারলে তার প্রতি স্নেহটা দিন দিন প্রগাঢ় প্রেমে পরিণত হয়।’ রুশ সাহিত্যিক আলেকজান্ডার পুশকিন লিখেছেন, ‘ভালবাসা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয়, এক্ষেত্রে ভাষার প্রয়োজন হয় না।’ মানুষ তার প্রিয় জনের কাছে তার মনের গভীরে জমে থাকা ভালবাসা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে নানা কায়দায় প্রকাশ করে থাকে। প্রতিবছর বিশ্বের দেশে-দেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবস পালিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উদ্রেক হয়, কিভাবে উৎপত্তি বা শুরু হলো এই ভালবাসা দিবস বা ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। এমন একটি বিষয়ের প্রতি মানুষের কৌতূহলটা অন্য যে কোন বিষয়ের চেয়ে একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। খ্রিস্টীয় ইতিহাসে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিয়ে বহু কাহিনী রয়েছে। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের কথা। সাম্রাজ্যবাদী, রক্তপিপাসু রোমান সম্রাট ক্লডিয়াসের দরকার এক বিশাল সৈন্যবাহিনীর। এক সময় তার সেনাবাহিনীতে সৈনা সঙ্কট দেখা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগদানে যুবকদের আগ্রহ একেবারেই ছিল না। কিন্তু সম্রাটের অভিজ্ঞতা হচ্ছে বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিত যুবকরাই যুদ্ধের জন্য শ্রেষ্ঠ। তারা যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে অত্যধিক ধৈর্যশীল হয়। ফলে তিনি যুবকদের বিবাহ কিংবা যুগলবন্দী হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যাতে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ না করে। তার এই আদেশে যুবক-যুবতীরা ক্ষেপে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক যুবক ধর্মযাজকও সম্রাটের এই নিষেধাজ্ঞা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন রাজার আদেশ অবজ্ঞা করে ভালবেসে সেন্ট মারিয়াসকে বিয়ে করেন। শুধু তাই নয়, তিনি রাজার আদেশ অমান্য করে গোপনে তার গির্জায় গোপনে বিয়ে পড়ানোর কাজও করতে থাকেন। একটি কক্ষে মোমবাতির স্বল্প আলোতে ফিস ফিস করে বিয়ের মন্ত্র পড়াতেন ভ্যালেন্টাইন। কিন্তু বিষয়টি সম্রাট ক্লডিয়াসের কর্ণগোচর হলে তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। কারারুদ্ধ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে এক নজর দেখার জন্য কারাগারে প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীরা প্রতিদিন কারাগারে আসত ফুল ও উপহার সামগ্রী নিয়ে। তারা সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদ্দীপনামূলক কথা-বার্তায় উদ্দীপ্ত রাখত। এক কারারক্ষীর অন্ধ মেয়েও আসত ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে। তারা অনেকক্ষণ ধরে প্রাণ খুলে কথা বলত। এভাবে তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। রাজা তার এই আধ্যাত্মিকতার খবর পায় এবং ভ্যালেন্টাইনকে রাজ দরবারে হাজির করার নির্দেশ দেন। রাজা তাকে রাজকর্মে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেন। বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হলে রাজার দেয়া এই প্রস্তাব পালনে ভ্যালেন্টাইন অস্বীকৃতি জানান। এতে রাজা ক্ষুব্ধ হন এবং তার মৃত্যুদ-াদেশ দেন। মৃত্যুদ- বাস্তবায়নের ঠিক আগ মুহূর্তে ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীদের কাছে কাগজ ও কলম চেয়ে নেন। তিনি মেয়েটির কাছে একটি গোপন চিঠি লেখেন এবং শেষাংশে বিদায় সম্ভাষণে লেখেন ‘ফ্রম ইউওর ভ্যালেন্টাইন’। এটা ছিল এমন একটি শব্দ, যা হৃদয়কে স্পর্শ করে। অতঃপর ১৪ ফেব্রুয়ারি মহান প্রেমিক ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এই ঘটনা আবার অন্যভাবেও বর্ণনা করা হয়েছে। গ্রীসের রাজা দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ছিলেন, ‘প্যাগান’ ধর্মাবলম্বী। প্যাগানরা ছিল মূর্তি পূজারী। তার সময় খ্রিস্টধর্মের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হতে থাকে। তখন একজন যুবক পাদ্রি ছিলেন। তার নাম ছিল সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। রাজা ক্লডিয়াস তার রোমান রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করেন। আদেশ জারি করেন, যে বা যারা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করবে তাকে মৃত্যুদ- দেয়ার। রাজার আদেশ উপেক্ষা করে ভ্যালেন্টাইন খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে থাকেন। এতে রাজা ক্ষুব্ধ হন এবং ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদ-াদেশ প্রদান করা হয়। রাজা ভ্যালেন্টাইনকে ‘প্যাগান’ মতবাদ মেনে নেয়ার শর্তে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দিলে ভ্যালেন্টাইন তা প্রত্যাখ্যান করেন। জেলখানায় বন্দী থাকা অবস্থায় জেলার এ্যাসটেরিয়াসের যুবতী সুন্দরী অন্ধকন্যা ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে আসে। যদিও সে চোখে দেখে না, তবুও তাদের প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে। ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় সুন্দরী জুলিয়া দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। এতে রাজা ক্লডিয়াস আরও ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া ভ্যালেন্টাইনের অসাধারণ জনপ্রিয়তা তাকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। রাজা ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকরের আদেশ দেন। মৃত্যুদ- কার্যকর করার আগে ভ্যালেন্টাইন একটি চিরকুটে প্রেমিকা জুলিয়াকে চিঠি লেখেন। চিঠিটি শেষ করেন, ‘ণড়ঁৎ ঠধষবহঃরহব’ লিখে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো এদেশেও ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ উদযাপন হচ্ছে। এই দিবসটি পালনে প্রধানত সক্রিয় যুবক-যুবতী বা প্রেমিক-প্রেমিকারা। মাত্র ক’বছর আগে এই দিবস সম্পর্কে এদেশের মানুষ জানতে পেরেছে যা ক্রমশ প্রসার লাভ করছে। ভালবাসা দিবসে প্রিয়জনকে কিছু উপহার দিন। সামনা-সামনি দেখা না হলেও ভালবাসার বার্তা পাঠান। মোবাইলে ফোনে বা ‘ম্যাসেজ’ পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন ভালবাসার কার্ড। তবে সবচেয়ে সেরা উপহার হচ্ছে বই ও ফুল। সেটি যে ফুলই হোক না কেন। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×