ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের উচিত শিক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বিশ্বব্যাংকের উচিত শিক্ষা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ কানাডার আদালতে প্রমাণিত না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক উচিত শিক্ষা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব ও বর্তমান শিল্প সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। তবে এ ঘটনায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করা ঠিক হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, সংস্থাটি আমাদের উন্নয়ন অংশীদার। তাই সব ধরনের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের আরও বেশি সুসম্পর্ক তৈরি হওয়া প্রয়োজন। আর প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান সম্প্রতি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের যেসব দায়িত্বশীল ব্যক্তি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ গুজবে কান দিয়েছিলেন, তাদের উচিত হবে নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেয়া। তবে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে দেশের ভাবমূর্তি নষ্টের মামলা করা ঠিক হবে না। মামলাই শুধু একমাত্র পথ নয়। তবে এ ঘটনা বাংলাদেশের অসন্তুষ্টির কথা তাদের জানানো যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। রবিবার দুপুরে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি, দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, পদ্মায় অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের আচরণ, ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের ভূমিকা এবং সর্বোপরি দেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে জনকণ্ঠের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন শিল্প সচিব। তিনি বলেন, কানাডার আদালতে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ছিল না। তার বিরুদ্ধে দুদকই যা করার করেছে। একটি মিথ্যে অভিযোগের কারণে সেই সময় আমাকে ৪০ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা খুবই বেদনাদায়ক ও অপমানজনক। কারণ, আমি তো অপরাধ করিনি। এটা আজ প্রমাণও হয়েছে। তাহলে আমার প্রশ্ন কেন আমাকে কারাগারে রাখা হলো। কেন গ্রেফতার করা হলো? তিনি আরও বলেন, যদিও ওই সময়ের দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা আমাকে বলেছিলেন তারা নিরুপায়। তাদের করার কিছু ছিল না। কিন্তু উপরের নির্দেশে কাজ করেছে সেটাও বলেছে। কিন্তু সে দিন তারা গ্রেফতারের কাজটা না করলেও পারত। প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক ফার্ম হিসেবে পাঁচ কোটি ডলারের কাজ পেতে এসএনসি-লাভালিনের কর্মীরা ২০১০ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহে ফোনে আড়িপাতা তথ্য (ওয়্যার ট্যাপস) ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে ২০১১ সালে তিনটি আবেদন করে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি)। অন্টারিও সুপিরিয়র কোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার আদেশে বলেন, ওই তিন আবেদনের বিষয়ে তার ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। এগুলোতে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলো অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয়। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১০ সালে নিজেরা তদন্ত শুরু করে। অভিযোগ সম্পর্কে নিজেদের তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আরসিএমপিকে অনুরোধ জানায়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডায় এসএনসি-লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১২ সালে টরন্টোর আদালতে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে এসএনসি-লাভালিনে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস ও ব্যবসায়ী জুলফিকার ভূঁইয়াকেও এ মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। সে সময় রমেশ শাহের কাছ থেকে কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা একটি ডায়েরি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়, যাতে বাংলাদেশের কাকে কত শতাংশ ঘুষ দেয়া হবে তার সাংকেতিক বিবরণ ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়। অভিযোগ করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মশিউর রহমান ১%, মিনিস্টার আবুল হোহেন ৪%, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী (কায়সার) ২%, হুইপ নূরে আলমের ভাই নিক্সন ২% ও সেক্রেটারি মোশাররফ ১%। সেই সময় কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার বহুল আলোচিত ডায়েরির পাতায় লিখে রাখা ঘুষ বণ্টনের এই হিসাব পাওয়া যায়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, মশি রহমান হলেন ড. মশিউর রহমান, মিন হলেন সৈয়দ আবুল হোসেন, কায়সার হলেন আবুল হাসান চৌধুরী, নিক্সন হচ্ছেন হুইপ নুরে আলম চৌধুরীর ভাই মুজিবুর রহমান চৌধুরী এবং সেক্রেটারি হলেন সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। উল্লেখ্য, ডায়েরির এই তালিকাটি কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ রমেশের অফিসে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে। ওই সময় বিশ্বব্যাংকের চাপে ছুটিতে যান ড. মশিউর রহমান। পদত্যাগ করেন ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কয়েক দফা ঢাকা সফরে আসে বিশ্বব্যাংকের তদন্ত দল। পাশাপাশি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মাঠে নামে দুদক, গঠন করে অনুসন্ধান কমিটি। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে সাবেক দুই মন্ত্রী ও উপদেষ্টাকে বাদ দিয়ে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সাবেক দুই মন্ত্রীকে মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে রাখা হয়। কিন্তু ওই মামলায় মশিউর রহমানের বিষয়ে কিছু উল্লেখ ছিল না। একপর্যায়ে সরকারের মন্ত্রী ও শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের মামলা করার চাপের মুখে বাতিল হয় ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি। বিশ্বব্যাংকের চাপে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুদক ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা করে। একটানা ২২ মাস তদন্তের পর দুদক কর্মকর্তারা জানান, অভিযোগের কোনো প্রমাণ তারা তদন্তে পাননি। দুদক চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ায় ২০১৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে পদ্মা দুর্নীতি মামলার অবসান ঘটে। তখনকার সেতু সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দেয় আদালত। শিল্প সচিব বলেন, দুদক এখনও যে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মানুষকে আমি এখনও এসব গ্রেফতারের বিরুদ্ধে। এটাকে স্ট্যান্টবাজি মনে হয়। দুদক মামলা করার পর গ্রেফতার করে। আমি মনে করি, এটা ঠিক না। কারণ সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয় না শেষ পর্যন্ত। তাহলে তদন্ত চলাকালীন একজনকে গ্রেফতার করে হয়রানি করার দরকার কি। তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে দুদকের আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার বলেও আমি মনে করি। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের ওপর অহেতুক একটি কালিমা লেপনের যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত্র চলছিল তা ভেস্তে গেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ ভিত্তিহীন হওয়ায় কানাডার আদালত মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। আদালতের রায় এটাই প্রমাণ করে, পদ্মা সেতুতে কোনো প্রকার দুর্নীতি হয়নি। তিনি বলেন, আমি সেতু বিভাগের সচিব থাকাকালীন বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দুটি সহযোগী সংস্থা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্প নষ্ট করতেই দেশের একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংকের কান ভারি করে। শিল্প সচিব বলেন, আমরা তখন বলেছিলাম, এত স্বচ্ছতার সঙ্গে এর আগে কোনো প্রকল্পের কাজ হয়নি। কিন্তু তারপরও কানাডিয়ান কোম্পানি, আমাদের মন্ত্রী থেকে সচিব পর্যায়ের অনেকের বিরুদ্ধে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের জড়িয়ে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করা হয়। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এটা বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ থাকলেও দেশে ও বিদেশে সব জায়গায় প্রমাণ হয়ে গেছে, এই প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হয়নি। কোন ষড়যন্ত্রও হয়নি। এটা নিয়ে যা হয়েছে এগুলো ছিল গালগল্প। আর মামলাও করা হয়েছিল গুজবের ওপর ভিত্তি করে। আদালতের এই রায় সত্য, বস্তুনিষ্ঠ ও ন্যায়বিচারের পক্ষে রায় হয়েছে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংক বুঝতে পেরেছে তারা ওই সময়ে যে অভিযোগ এনেছিল তা সত্য ছিল না। তাদের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠান এই ধরনের অভিযোগ তোলায় ও অবস্থান ধরে রাখতে না পারায় এটা তাদের ইমেজ সঙ্কট তৈরি করেছে। তারা মিথ্যে অভিযোগ করে বলেও প্রমাণ হয়েছে। সেতু বিভাগের সাবেক এই সচিব বলেন, অভিযোগ নিয়ে কাজ করেছেন ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট ও সেখানকার ইন্ট্রিগ্রিটি বিভাগের কয়েকজন। কিন্তু আজ তারা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নেই। তাদের কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কারও মেয়াদ শেষ। এই অবস্থায় আসলে আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই। বরং সম্পর্কটা ভাল রেখেই এগিয়ে যেতে হবে। বৈরিতা তৈরি করে সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, পেছনের দিনের কথা মনে করতে গেলে এটা বলতে হয় যে, যখন পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠল তখন আমাদের দেশের গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করা হতো। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে তা বিচার করা হতো না। একটা কথা বললে সেই কথার মধ্য থেকে নেতিবাচক কথা বের করে করে এরপর প্রকাশ করা হতো। আমি একবার দুদকে গেলাম। সেখান থেকে নিচে নেমে মিডিয়াকে বললাম, আমার সঙ্গে ও মন্ত্রীর সঙ্গে যারা কাজ পেতে আগ্রহী ওই সকল প্রতিষ্ঠানের ও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। এটাকে তারা প্রচার করল অবশেষে সচিব স্বীকার করলেন, এসএনসিলাভালিনের প্রতিনিধির সঙ্গে সচিব আর মন্ত্রীর দেখা হয়েছে, বৈঠক হয়েছে। এই যে প্রচারণা এটা তো পূর্ণাঙ্গভাবে করা হতো না। তিনি বলেন, এই রকম আরও অনেক ঘটনা আছে। প্রতিদিন যখন মিডিয়াতে খবর প্রকাশ করা হতো তখন সামাজিকভাবে আমাকে ও আমার পরিবারের সদস্যদের হেয় হতে হয়েছে। কিন্তু দুদকে অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ হওয়ার পর আর সমস্যা হয়নি। তিনি বলেন, আমি এই জন্য কৃতজ্ঞ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তার অনঢ় অবস্থান, কঠোর মনোভাব ও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর সব সময় বুঝিয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়নি। তিনি কঠোর না থাকলে অনেক কিছু হতে পারত। কোন দিন এমনকি একটি মুহূর্তের ও জন্যও তিনি আমাকে, ওই সময়ের মন্ত্রী মহোদয় ও উপদেষ্টাকে সন্দেহ করেননি। প্রশ্নও তোলেননি। এই কারণে যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন টাকা নেবেন না বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে, তখন তো তিনি সবাইকেই দায়িত্ব দিয়েছেন। আমাকেও মূল্যায়ন করেছেন। আমি তাঁর প্রতি এ জন্য কৃতজ্ঞ। তার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ইমেজ অক্ষুণœ রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের ভেতরেও কেউ কেউ আমাদের বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যদি পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে থাকতে পারতে তাহলো ভাল হতো। কিন্তু না থাকতে পারাটা দুঃখজনক। তারা ভাবতে পারেনি প্রধানমন্ত্রী তাদের ফিরিয়ে দেবে। কারণ তাদের কথামতো সবভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতির প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু এরপরও তারা বিশ্বাস করেনি। কেবল চাপ দিয়েই যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী কোন চাপের কাছে হেরে যাননি। বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন বিশিষ্টজনেরা ॥ কানাডা আদালতে পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের মামলাটি খারিজ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন, দেশের বিশিষ্টজনেরা। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, কানাডার আদালতের এই রায়ে প্রমাণ হয়েছে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা। তিনি বলেন, কিছু লোক অহেতুক ষড়যন্ত্র করেছিল, যাতে পদ্মা সেতু না হয়। আর যারা এই প্রকল্পে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল, তারা সরকারের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। কানাডার আদালতের রায়ে তা প্রমাণ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, আমরা আগেই জানতাম দুর্নীতির অভিযোগ ঠিক নয়, প্রমাণিত হবে না। এখন বিশ্বব্যাংকের জবাবদিহি করা দরকার। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, যখন অভিযোগ আনা হয় তখন পদ্মা সেতুর কাজই শুরু হয়নি। ছাড় হয়নি এক টাকাও। তবুও তারা অভিযোগ এনেছিল। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জানান, পদ্মায় যে দুর্নীতি হয়নি তা আমরা আগেই বলেছিলাম। এখন কানাডার আদালতে তা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের ক্ষমা চাওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন কাজ এগিয়ে চলছে। সংগঠনটির সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি ও দেশের অন্যতম নারী উদ্যোক্তা মনোয়ারা হাকিম আলী বলেন, এ ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, পদ্মায় কোন দুর্নীতি হয়নি। বিশ্বব্যাংক ষড়যন্ত্রকারীদের কবলে পড়েছিল। তিনি বলেন, সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়ন কর্মকা- এগিয়ে নিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে পদ্মা সেতুসহ মেগা দশ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, এখন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। তবে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মামলা করতে পারবে না বাংলাদেশ। কারণ, বিশ্বব্যাংকসহ কোন দাতা সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া আছে। তবে জাতীয় সংসদের অনুমতি নিয়ে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে মানহানির মামলার সুযোগ আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এমএম আকাশ মনে করেন এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, কানাডার আদালতের এ রায়ের ফলে প্রথম প্রমাণিত হলোÑ বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অভিযোগ করেছিল। নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তাদের হাতে থাকার কথা যেটা বলেছিল, সেটা তাদের কাছে নেই এটা বেশি করে প্রমাণ হয়েছে। কানাডিয়ান কোর্ট তাদের বলেছিল কাগজপত্র জমা দিতে, কিন্তু সেটা জমা দিতে অপারগতা জানায় বিশ্বব্যাংক। সমালোচনাকারীদের ক্ষমা চাওয়া উচিতÑ তোফায়েল আহমেদ ॥ কানাডার আদালতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় এই অভিযোগে সমর্থন জানানো বুদ্ধিজীবীদের করজোরে দেশবাসীর কাছে কাছে ক্ষমা চওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সচিবালয়ে রবিবার শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার ইয়াসোজা গুনাসেকারার সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৫ সালে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথাছিল। আজকে ২০১৭ চলছে। দক্ষিণাঞ্চলে কত অর্থনৈতিক উন্নতি হতো, কত শত শত কোটি টাকা আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের জিডিপি গ্রোথ আরও কমপক্ষে ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেত। তারা অভিযোগ করেছিল দুর্নীতির ষড়যন্ত্র, দুর্নীতির ষড়যন্ত্র তো প্রমাণিত হয়নি, বরং তারা ষড়যন্ত্র করেছিল। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র করেছিল ড. ইউনূস। সকলের জানা তিনি (ড. ইউনূস) হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে আমাদের উন্নয়নমূলক এ কাজটা যাতে না হতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছিলেন। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছিল আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। তারা টকশো, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে একইভাবে তারা কণ্ঠ মিলিয়েছিল। তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সঠিকভাবে বলেছেন, তাদের (ষড়যন্ত্রকারী) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। বিদ্যান লোক যারা টকশোতে যায়, যারা সমালোচনা করেছিলেন তাদের কি হবে? এদের ক্রেডিবিলিটি নাই, ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়ে গেছে। এদের এখন জাতির কাছে করজোরে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ বিএনপি নেতারা যা বলছেন ॥ পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর ক্ষমতাসীন দল হিসেবে ব্যাপক চাপে পড়ে আওয়ামী লীগ। এই অভিযোগকে বার বার মিথ্যা বললেও দেশবাসীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছিল স্পষ্ট। তবে কানাডার আদালতের রায়ের পর এখন স্বস্তিতে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতিম-লীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক জানান, কানাডার আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই এটা বলে আসছে। সেটা আজ আদালতে প্রমাণিত হলো। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তির কারণে ওই সময়ে পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক। কানাডার রায়ে সেই ব্যক্তির মুখোশ বিশ্ব বিবেকের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। যারা ওই সময়ে ষড়যন্ত্র করেছে তাদের সবার মুখোশ আজ উন্মোচিত হয়েছে। সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, যারা এতদিন পদ্মা সেতু নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন তাদের সেতুর নিচ দিয়ে যেতে হবে। রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের দাবি শীর্ষক মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরিষদ। মানববন্ধনে ড. হাছান মাহমুদ আরও বলেন, পদ্মা সেতু দেশের মানুষের যুগ যুগ ধরে লালিত স্বপ্ন। এ স্বপ্ন পূরণ করতে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা এবং দেশের কিছু ষড়যন্ত্রকারী সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ করেছিল। এমনকি বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে মামলা দিয়েছিল। এদিকে, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ছিল বিএনপি। ইতোমধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে তখন পত্র পত্রিকায় অনেক তথ্য প্রকাশ হয়েছে এবং বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই তখন তাদের বক্তব্য বিবৃতি ছিল। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থ বন্ধ করে দিয়েছিল, এটাই বাস্তবতা এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখন কোথায় কী প্রমাণ হলো কিংবা হলো না সেটা তাদের বিষয় নয়। ওই সময় খালেদা জিয়া যা বলেছেন ॥ পদ্মা সেতু প্রকল্প আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে ২০১২ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের এক জনসভায় সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছিলেন, বর্তমান রকারের দুর্নীতির কারণেই পদ্মা সেতু হলো না। খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। সরকারের দুর্নীতির কারণেই পদ্মা সেতু হতে পারল না। তারপরেও এই আওয়ামী লীগ সরকারকে যারা ভোট দেবে, তারা জাতীয় বেইমান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
×