ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

ছুটির দিনে বিপুল উপস্থিতি, ভরপুর প্রাণ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ছুটির দিনে বিপুল  উপস্থিতি,  ভরপুর প্রাণ

মোরসালিন মিজান ॥ মেলা ঘুরে দেখার তখনও বাকি। বাকি আর নগদ করা হলো না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বের হওয়ার পথ ধরতে হলো। তখন ঘড়িতে বিকেল ৫টা ৩১। মুক্তমঞ্চের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় মনে হলো, সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তা না হলে বের হওয়া মুশকিল হয়ে যেত। কারণ? জনস্রোত। হ্যাঁ, দশম দিন শুক্রবার বিপুল লোকসমাগম হয়েছিল মেলায়। এখন মেলা অনেক বড়। বাংলা একাডেমির খোলা জায়গার পুরোটা যথারীতি ব্যবহার হচ্ছে। যোগ হয়েছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। তবুও ভিড়। সবাই হয়ত বই কেনেন না। তাতে কী? বইয়ের মেলা নিয়ে বিভিন্ন বয়সী মানুষের যে আগ্রহ, তারও মূল্য আছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলার দশম দিনটি তাই বেশ গেছে। মেলা শুরু হয়েছিল সকাল ১১টায়। আগেভাগে শুরুর কারণ শিশু প্রহর। বাবা মায়ের হাত ধরে এসেছিল ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা। তাদের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে ওঠেছিল শিশু কর্নার। অবশ্য শিশু কর্নার শুধু নয়, গোটা মেলাই ঘুরে বেড়িয়েছে খুদে পাঠকরা। ছবির বই, কার্টুনের বই দেখে সে কী আনন্দ তাদের! দুপুর পর্যন্ত এই আনন্দ হাসিরাশি দৃশ্যমান হয়েছে। এর পর থেকেই আসতে শুরু করেন বড়রা। যত সময় গড়িয়েছে, ভিড় ততো বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি স্টলের সামনে ছিল কৌতূহলী পাঠকের সমাবেশ। এবার সময় এবং প্রথমা’র মতো প্রসিদ্ধ দু’টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভাল জায়গা পায়নি। পাঠককে অনেক খোঁজাখুঁজি করতে হচ্ছিল। কিন্তু দশম দিনে এসে দেখা গেল, দুটি প্যাভিলিয়নেই উপচেপড়া ভিড়। একাডেমি অংশে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। অথচ লোক লোক সমাগম দেখে অবাক হতে হয়েছে। এমনকি লিটলম্যাগ চত্বরে ঢোকা যাচ্ছিল না। বিক্রিও হচ্ছিল ভাল। এভাবে দশম দিনে মেলায় ছিল ভরপুর প্রাণ। বইয়ের জন্য এত লম্বা লাইন, ছুটোছুটি দেখে সত্যি মন আশাবাদী হয়ে ওঠে। নতুন বই ॥ দশম দিনে নতুন বই এসেছে ৩১৩টি। মুস্তাফিজ শফির উপন্যাস ‘ঈশ্বরের সন্তানেরা’ প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। এই লেখক একইসঙ্গে সাংবাদিক। তার আলোচিত আটটি ধারবাহিক প্রতিবেদন নিয়ে ‘নির্বাচিত অনুসন্ধান’ প্রকাশ করেছে রয়েল পাবলিশার্স। সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ‘আমার কথা’ প্রকাশ করেছে পুঁথিনিলয়। ড. কাজী জাহেদ ইকবালের ‘বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনী (১৯৭২-১৯৮৮) : প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা’ প্রকাশ করেছে ধ্রুবপদ। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার দশম দিনে শুক্রবার ৪৩টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। নির্বাচিত বই ॥ মেলায় এসেছে বিশ্বখ্যাত কবি এ্যালেন গিনসবার্গের কবিতার অনুবাদ ‘হাউল ও উনিশটি কবিতা।’ রবিউল হুসাইনের ভাবানুবাদ প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস। কাব্যগ্রন্থে গিনসবার্গের অমর কবিতা হাউলসহ মোট ১৯টি কবিতা স্থান পেয়েছে। সমকালীন তরুণ কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম স্বকৃত নোমানের উপন্যাস ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’ প্রকাশ করেছে অনিন্দ্য। ফ্ল্যাপ থেকে বললেÑ ইতিহাস ও বর্তমান একটি জাহাজে মুখোমুখি বসে কথা বলছে। দুই শতাব্দীর মানব পাচারের ঘটনা গেঁথে গেছে আশ্চর্য এক সুতোয়। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক হার্তা মুলারের উপন্যাস ‘পাসপোর্ট’র অনুবাদ। মার্টিন চ্যালমার্সের করা ইংরেজী অনুবাদের বাংলা ভাষারন্তর করেছেন জিয়া হাশান। উপন্যাসের মূল চরিত্র রোমানিয় গ্রামের আটার মিলের মালিকক উইন্ডিশ্চ। চরিত্রটির মধ্য দিয়ে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের দুঃখ বেদনার কথা বলার চেষ্টা হয়েছে। তেমনি তুলে ধরা গয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামির চিত্র। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সময় থেকে মেলায় এসেছে আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রবন্ধ সংকলন ‘আমাদের জাতীয় সংসদ ও নির্বাচন।’ ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে লেখা ২৯টি প্রবন্ধ বইতে স্থান পেয়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এখনও আছেন হুমায়ূন আহমেদ। নন্দিত এই লেখকের বিভিন্ন লেখা থেকে চৌম্বক অংশ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘হুমায়ূন আহমেদের কথামালা।’ লেখক তার লেখার বিভিন্ন অংশে উল্লেখ করার মতো কিছু মন্তব্য জুড়ে দিতেন। সেইসব মন্তব্য এক মলাটে বন্দী করেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কাকলী। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা ও ১১ই মার্চ ১৯৪৮’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আহমাদ মাযহার ও মো. মশিউর রহমান। সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। প্রাবন্ধিক বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ এক মাইলফলক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টির ফলে ধর্মীয় আবেগ, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমানদের একটি বড় অংশের ইংরেজিপ্রীতি উপেক্ষা করে যে ছাত্র-যুবকরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সেদিন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সময় এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় তাদের শুধু ভাষাপ্রেমী নয়, বীর হিসেবে চিহ্নিত করাই হবে যথার্থ। বাহান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারি রক্তদানের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল তার সূত্রপাত এবং প্রেরণা ছিল ১১ই মার্চ। আর সে কারণেই বাহান্নের পূর্ব পর্যন্ত ১১ই মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হতো সর্বত্র। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ইতিহাস প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেকেই ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়কে তেমন গুরুত্ব প্রদান করেননি। আলোচকরা বলেন, ভাষা আন্দোলন শুধু ১৯৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তার বীজ নিহিত ছিল ১৯৪৮-এর ১১ই মার্চ। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ই মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে ছাত্রজনতা অসম সাহস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। আর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তৎকালের তরুণ ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের শিল্পীরা।
×