ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থানান্তর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান বিদেশী কূটনীতিকরা

ঠেঙ্গারচরে সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ঠেঙ্গারচরে সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করবে সরকার

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার আগে সেখানে সকল প্রকার সুবিধা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। বিশেষ করে অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করার পরেই ঠেঙ্গারচরে নিয়ে আসা হবে। তবে সরকারের এ কর্মপরিকল্পনার বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চান বিদেশী কূটনীতিকরা। এদিকে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সূত্র জানায়, ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নেয়ার আগে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ, আশ্রয় কেন্দ্র, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মসজিদ, রাস্তা সুবিধা নিশ্চিত করতে চায় সরকার। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠেঙ্গারচরে সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়ে সরকারের কর্মপরিকল্পনা বিস্তারিত জানতে চাইছেন বিদেশী কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা। রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে সরকার যে আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছে সে ব্যাপারে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত পিয়ারে মায়াদ্যু বলেছেন, এ বিষয়ে সরকারের কর্মকৌশল সম্পর্কে আমাদের আরও বেশি করে জানা প্রয়োজন। এ মুহূর্তে এ সম্পর্কে তেমন কিছু বলাটা অনেক আগেভাগেই বলা হয়ে যাবে। আমরা সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানতে চাই। বর্তমানে এটি সংজ্ঞার পর্যায়ে আছে। তিনি বলেছেন, বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের পাশে আছে ইইউ। এটা নতুন কিছু নয়। আমরা মিয়ানমার সরকারের প্রতিও সেখানে রোহিঙ্গাদের দমন-পীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আসছি। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকার পরও রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ জায়গার ব্যবস্থা করেছে। আমরা তাদের জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছি। কেননা রোহিঙ্গা সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সম্পৃক্ত করতে চাইছে সরকার। সে লক্ষ্যে হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে যেখানে রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, সে এলাকা তাদের পরিদর্শনও করাতে চায় সরকার। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতিও চলছে। খুব শীঘ্রই বিদেশী কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের ঠেঙ্গারচর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করবে সরকার। ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণের পর ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নাল আবেদীন ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন। গত বুধবার ঠেঙ্গারচর পরিদর্শনকালে তিনি চরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি হেলিপ্যাড নির্মাণ, একটি জেটি নির্মাণ, গভীর নলকূপ স্থাপনসহ নানাবিধ বিষয়ে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তর করতে চাইলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এ অর্থ ব্যয় হবে। তবে দেশী-বিদেশী সংস্থার সহায়তা চেয়েছে সরকার। তাদের কাছ থেকে সহায়তা পেলে সরকারের এ উদ্যোগ আরও দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠেঙ্গারচরে পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। ঠেঙ্গারচরকে ‘বিরান’ ও ‘অনুন্নত উপকূলীয় দ্বীপ’ উল্লেখ করে রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানোর পরিকল্পনাকে ‘নিষ্ঠুর’ বলেও আখ্যায়িত করেছে সংস্থাটি। এইচআরডব্লিউ এক বিবৃতে বলেছে, কক্সবাজার থেকে ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া হলে চলাফেরা, জীবনযাপন, খাদ্য ও শিক্ষার অধিকার থেকে এসব মানুষকে বঞ্চিত করা হবে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশের এ আইন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একাধিক সরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। তবে সরকার এ নিয়ে কোন ধরনের সমালোচনার মধ্যে যেন না পড়ে, সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখছে। ঠেঙ্গারচরে জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। অমানবিকভাবে সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে চায় না সরকার। রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরে স্থানান্তরের বিষয়ে বিদেশী কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন আর কোনভাবেই স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। ছোট জায়গার মধ্যে অনেক বেশি শরণার্থী অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছে। সেখানকার আর্থসামাজিক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এসব নাগরিকদের মধ্যে অনেকেই মানব পাচার ও চোরাচালানে জড়িত বলেও তাদের জানানো হয়। এছাড়া কক্সবাজার বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ পর্যটন নগরী বলেও তাদের অবহিত করা হয়। এসব বিষয় বিবেচনা করেই তাদের ক্যাম্প হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক এখন অবস্থান করছে। তবে গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক প্রবেশ করেছে। এসব নাগরিকও ক্যাম্পে অবস্থান করছে। সে কারণে সেখানে এখন আর কোনভাবেই স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। তাই রোহিঙ্গা ক্যাম্প হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে স্থান সঙ্কুলানের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলেও জানা গেছে। শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরণার্থী বেড়ে যাওয়ার কারণেই এ ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হচ্ছে না। তাদের সরিয়ে নেয়ার পেছনে আরো বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো, পর্যটন এলাকা রক্ষা, মাদক পাচার ঠেকানো, জঙ্গী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ঠেঙ্গারচরে ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে মিয়ানমারের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময় সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গীরা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে আশ্রয়ও নিয়েছে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে রয়েছে সরকার। সে কারণে সরকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে কোন জঙ্গীগোষ্ঠীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়। আর রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়া হলে সেটা অনেকটাই সম্ভব হবে বলে ধারণা করছে সরকার। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থাকার কারণে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সে কারণে এখন থেকে পাঁচ বছর আগে সেখান থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে ফেলার প্রাথমিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সে সময় যমুনার নদীর চরাঞ্চলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। তবে বর্ষাকালে যমুনা নদীর পানিতে সেখানে প্রায় সব চরই ডুবে যায় বলে যমুনার চরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। তবে অক্টোবরের পর থেকে প্রায় ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক নতুন করে প্রবেশ করার পর কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি এখন চূড়ান্ত হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে প্রত্যাবাসন করার আগে তাদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করেছে সরকার। অমানবিকভাবে সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা হবে না। এছাড়া সেখানে রোহিঙ্গারা যেন কৃষিকাজ ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সে বিষয়টিও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন আর কোনভাবেই স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। ছোট জায়গার মধ্যে অনেক বেশি শরণার্থী অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছে। তাই মানবিক বিষয় বিবেচনা করেই তাদের ক্যাস্প হাতিয়ার ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হাতিয়ার চরে সরিয়ে নেয়ার ফলে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ফেরত পাঠানোর বিষয়ে যে আলোচনা চলছে, সেটা অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানান। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে তিন লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছে আর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। এছাড়া গত বছরের ৯ অক্টোবর সীমান্তে সহিংস ঘটনার পর প্রায় ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
×