ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেষ সংবাদ সম্মেলনে বিদায়ী সিইসি কাজী রকীব উদ্দিন

৫ জানুয়ারি নির্বাচন না হলে অসাংবিধানিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

৫ জানুয়ারি নির্বাচন না হলে অসাংবিধানিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ৫ জানুয়ারি নির্বাচন না হলে দেশে অসাংবিধানিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। অরাজক অবস্থা তৈরি হতো। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীব উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ৫ বছরের সময়কালে অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এ সময় অনেক সমস্যা মোকাবেলা করে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছি। নির্বাচন পরিচালনাসহ কমিশনের বিভিন্ন কর্মকা-ে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়েছি। বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এই ইসির অধীনে সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন কমিশনের নতুন ভবনে তিনি বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন করেন। ৫ বছরের দায়িত্ব পালনকালে বুধবার ছিল বিদায়ী কমিশনের শেষ অফিস। অফিস শেষে নির্বাচন কমিশন থেকে বিদায় নেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীব উদ্দিন আহমদ, ব্রিগেডিয়ার অব. জাবেদ আলী, আবু হাফিজ ও আব্দুল মোবারক। বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনের সময় ইসি আব্দুল মোবারক ছাড়া সবাই উপস্থিত ছিলেন। কাজী রকীব উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন বিদায়ী নির্বাচন কমিশন ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন। সে অনুযায়ী বুধবার ৫ বছরের মেয়াদ শেষ করে বিদায় নেন। এছাড়া কমিশনের অন্য সদস্য মোঃ শাহ নেওয়াজের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন তিনি শেষ অফিস করবেন। এরপর কে এম নুরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন কাজে যোগ দেবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে তারা শপথ নেবেন। স্বাধীনতার পর প্লানিং কমিশনের দুটি ব্লকে এতদিন নির্বাচন কমিশনের অফিস ছিল। বিদায়ী কমিটির কর্মকালে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়। গত ২২ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তরে অবস্থিত নিজস্ব নতুন ভবনে অফিস শুরু হয়। এ ভবন থেকে তারা বিদায় নেন। বিদায়ের আগে বুধবার তিনটায় তারা শেষবারের মতো সংবাদিকদের মুখোমুখি হন। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কমিশনে ৫ বছরের দায়িত্ব পালনকালে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বলেন, ৫ বছরের সময়ের মধ্যে দায়িত্ব পালনকালে কোন মহল থেকে কোন প্রকার চাপ নির্বাচন কমিশনের ওপর আসেনি। এমনকি কোন পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রভাব সৃষ্টির জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। এ সময়ের মধ্যে কোন পক্ষ থেকে ফোন কল পর্যন্ত পাননি উল্লেখ করেন। বলেন, সম্পূর্ণ চাপমুক্ত পরিবেশে দায়িত্ব পালন করেছি। তবে দায়িত্ব পালন ছিল অনেকটা চ্যালেঞ্জর। দায়িত্ব পালনকালে ৭ হাজার ৪শ’ ৭ এর অধিক নির্বাচন পরিচালনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বলেন, কাজের মাধ্যমে নিরপেক্ষতার পরিচয় দিয়েছি। গত পাঁচ বছরে আমরা অনেক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। সেগুলো সফলতার সঙ্গে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। নির্বাচন কমিশনের কর্মকা-কে গতিশীল করেছি। সাফল্যের সঙ্গে ছয়টি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি। এ সময় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে কাজী রকীব উদ্দীন আহমদ বলেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় কমিশনের জন্য নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তখন জাতির ক্রান্তিলগ্ন, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো দেশজুড়ে সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে জানমালের ক্ষতি করছিল। এই অবস্থায় নির্বাচন করা দুষ্কর ছিল। নির্বাচন না হলে অসাংবিধানিক পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হতো। তাই নির্বাচন করতে গিয়ে কর্মকর্তারা অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁদের সাহসিকতায় দেশে আজ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। ওই সময় নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে তিনজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। এ সময় তিনি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। নির্বাচনে সহিংসতার বিষয়ে বলেন, দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তাদের আমলের সব নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়েছে। তবে নির্বাচনে সহিংসতার বিষয় উল্লেখ করে বলেন যে সহিংসতা নির্বাচনে হয়েছে তা সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে। এ অবস্থা থেকে দেশে নিষ্কৃতি পাবে উল্লেখ করেন। একটি নির্বাচন কখনও লাথি মেরে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সুষ্ঠু করা যায় না। এ জন্য গণতান্ত্রিক চর্চার উন্নয়ন দরকার। সবার প্রচেষ্টা থাকলে, সহযোগিতা থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৫৪ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়েও আইন রয়েছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার নেই। আপনি নির্বাচনে অংশ না নিলে অন্য কেউ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারে। ইট’স আ পলিটিক্যাল গেম, কেউ না এলে অন্য দল তো ফাঁকা মাঠে গোল দেবেই। ভারত বর্ষে ১৯২০ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ওই নির্বাচনের এর চেয়ে অনেক বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। এছাড়া বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে এর চেয়ে বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়র নজির রয়েছে। যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে কমিশনকে তো একজনকে নির্বাচিত করতেই হবে। তবে তিনি স্বীকার করেন নির্বাচনে সহিংসতা থাকলে জনগণের অংশগ্রহণ কমে আসে। লোকে ভোট দিতে চায় না। ‘তাদের আমলে দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে সুশীল সমাজের এমন সমালোচনা করছে বিভিন্ন মিডিয়ায়’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী রকীব উদ্দিন বলেন, ৫ বছরের দায়িত্ব পালনের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় দুর্বল অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। তবে এ সময় নির্বাচনে কিছু দুর্বৃত্তায়নের কালচার তৈরি হয়েছে। সহিংসতা মূলত সামাজিক অবক্ষয় থেকে সৃষ্টি হয়। এ থেকে দেশ নিষ্কৃতি পাবে। তিনি বলেন, স্বাধীন দেশ, সবার সমালোচনার ও মতপ্রকাশের মতো প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। যে যার মতো মতামত ব্যক্ত করেছে। এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চায় না উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দায়িত্ব নিয়েই আমরা বলেছিলাম, আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করব। দায়িত্ব নেয়ার পর ৬টি সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন করার মাধ্যমে সেই (নিরপেক্ষতার) অধিকার পূরণ করেছি। ৫ বছরের দায়িত্ব পালনকালে যারা নির্বাচন বর্জন করেছে তারা বিভিন্ন সময় আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে কর্মকা-ের প্রশংসা করেছে। দায়িত্ব পালনের সময় অনেক রাজনৈতিক নেতা আমাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। ওই সময় তারা এও বলেছেন, আমরা রাজনৈতিক কারণে বাইরে আপনাদের সমালোচনা করি। আপনারা এতে কিছু মনে করবেন না। তিনি বলেন, পরবর্তীতে নির্বাচনগুলোতে যে সহিংসতা হয়েছে সেগুলো রাজনৈতিক কারণে। গণতান্ত্রিক চর্চাটা আমাদের দেশে সেভাবে নেই। ভারতের মতো গণতন্ত্র চর্চা এখানে থাকলে আমাদের নির্বাচনেও সহিংসতা অনেক কমে আসত। তবে ইদানিং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। আশা করি, দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়বে। ইতোমধ্যে নতুন কমিশন নিয়োগ পেয়েছে। তাদের জন্য কোন পরামর্শ নেই। তবে আশা করব আগামীতে তারা সফলভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। এ সময় তিনি নির্বাচন পরিচালনা ছাড়াও পাঁচ বছরের কর্মকা- তুলে ধরে বলেন, পাঁচ বছর মেয়াদে স্মার্টকার্ড দিয়েছি। যা দিয়ে অনেক কাজে আসবে। ২৬টি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট স্মার্টকার্ডে রয়েছে। কেউ নকল করতে পারবে না। ভোটার তালিকার হালনাগাদ করা হয়েছে। ছিটমহলবাসীদের ভোটার করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা উপজেলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে আগে কোন অফিস ছিল না। এখন প্রায় সব উপজেলায় সার্ভার স্টেশন করা হয়েছে। নাগরিকরা ঢাকায় না এসে উপজেলা থেকে তাদের সেবা পাবেন। এছাড়া তিনি উল্লেখ করেন তাদের সময় জাতীয় নির্বাচনের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ইসির সময়ে কমিশনের নতুন ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া তিনি উল্লেখ করেন নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নিয়েই রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসহ সবার সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনাসহ তারা বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। এ সময় তিনি নির্বাচন কাজে সহযোগিতা দেয়ার জন্য গণমাধ্যমসহ সবার ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ৫ বছর ধরে কমিশনের কাজ করেছি। নির্বাচনী সম্পৃক্ততা নিয়ে সবার সঙ্গেই ছিলাম। অজান্তে হয়ত কারও মনে কষ্ট দিয়ে থাকতে পারি। সেসব কষ্ট ভুলে যাবেন। কমিশনের দায়িত্ব নিয়ে কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করিনি। তারপর অপরাধ হলে কারও মনে আঘাত দিয়ে থাকলে বিদায় বেলায় ক্ষমা চাচ্ছি উল্লেখ করেন।
×