ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তাজকিয়া নুর মুন

ক্রিকেটে ‘তিন মোড়লের’ দিন শেষ!

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

 ক্রিকেটে ‘তিন মোড়লের’ দিন শেষ!

ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে বিতর্কিত ‘তিন মোড়লের’ ক্ষমতা খর্ব হওয়ার বিষয়টি এখন আলোচিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) সর্বশেষ সভায় ক্ষমতা ও অর্থের বণ্টনে সমতা আনার বিষয়টি উত্থাপন করে। ভারত ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া প্রতিটি টেস্ট খেলুড়ে দেশ আইসিসির প্রস্তাবে সমর্থন দেয়। ‘তিন মোড়ল’ ধারণার প্রবক্তা সাবেক ইন্ডিয়া বোর্ড (বিসিসিআই) ও আইসিসির প্রধান এন শ্রীনিবাসন। দুর্নীতির দায়ে যিনি আদালত কর্তৃক বরখাস্ত হন। এরপর জাগমোহন ডালমিয়ার মৃতুতে অন্তর্বর্তী দায়িত্বে ছিলেন অনুরাগ ঠাকুর। তাকেও সরিয়ে দিয়েছে দেশটির সুপ্রীম কোর্ট। বর্তমানে আইসিসির প্রধান শশাঙ্ক মনোহর, যিনি শ্রীনিবাসন পরবর্তী সময়ে বোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন। পরিচ্ছন্ন ইমেজের অধিকারী শশাঙ্ক আইসিসির চেয়ারে বসার পরই ‘তিন মোড়ল’ বাতিল ও অর্থের সমবণ্টনের সিদ্ধান্ত নেন। সভায় দ্বিস্তরের টেস্ট, ১৩ দলের ওয়ানডে লীগ, ওয়ানেড-টি২০তে ডিআরএসের ব্যবহারের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ক্রিকেটে ‘তিন মোড়ল’ ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের একচ্ছত্র আধিপত্য দীর্ঘদিনের। এতদিন আইসিসিতে তাদের এতটাই প্রভাব ছিল যে, অন্য দেশগুলো একেবারেই অসহায় ছিল তাদের সামনে। সেই আধিপত্যের জোরে অনেক সিদ্ধান্তই তারা নিজেরাই নিয়ে নিত। আশার কথা, এবার তাদের সেই অধিপত্য খর্ব হতে যাচ্ছে। এই তিন মোড়লের আধিপত্য খর্ব করতে আইসিসির গঠনতন্ত্র ও প্রশাসনিক ক্ষমতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। গত সপ্তাহে দুবাইয়ে আইসিসির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৪ সালে আইসিসির সাবেক চেয়ারম্যান নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের নেতৃত্বাধীন কমিটি আইসিসির গঠনতন্ত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। যেখানে তিন মোড়লের আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপক সুযোগ ছিল। নতুন সংশোধনীতে বলা হয়েছে, আইসিসির নির্বাচন হবে স্বতন্ত্র অডিট কমিটির চেয়ারম্যানের অধীনে। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এই পদে নির্বাচন হবে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে তিনি কোন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারবেন না। মেয়াদ থাকবে দুই বছর। তিনবারের বেশি এই পদে থাকতে পারবেন না তিনি। আইসিসির নির্বাহী কমিটি এবং অর্থ ও বাণিজ্য কমিটিতে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার স্থায়ী সদস্য পদ রয়েছে। নতুন সংশোধনী বাস্তবায়ন হলে এই তিন ক্রিকেট শক্তির স্থায়ী পদও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আইসিসির বর্তমান চেয়ারম্যান শশাঙ্ক মনোহরের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি গঠনতন্ত্রের এই সংশোধনী কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অন্যতম মোড়ল দেশ ভারত সেটি প্রত্যাখ্যান করেছে। যদিও আইসিসির সভায় বিপক্ষে ভোট দিয়েও ভারত নতুন এই পরিকল্পনার পথটাকে রুখতে পারেনি। কারণ ভারত-শ্রীলঙ্কা ছাড়া প্রতিটি টেস্ট খেলুড়ে দেশ আইসিসির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রাগে গাঁই-গুই করা ইন্ডিয়ান বোর্ড (বিসিসিআই) এখন বাগড়া দেয়ার নতুন উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভারত প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিলেও একমাত্র শ্রীলঙ্কা ছাড়া আর কোন দেশের সমর্থন পায়নি। এমনকি ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াও জানিয়ে দিয়েছে তারাও লভ্যাংশ সমবণ্টনের পক্ষে। দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজও ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু যে করে হোক ‘গোয়ার’ ভারত এখনই হাল ছাড়তে চাইছে না। আইসিসির সভায় ভারতের প্রতিনিধি বিক্রম লামাইয়া বলেন, ‘সভায় যে সংশোধিত আর্থিক বণ্টনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে তা বিশ্বাস ও নিরপেক্ষ বলে মনে হতে পারে কিন্তু এর কোন বৈজ্ঞানিক বা যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা নেই। তাই আমাদের পক্ষে এখনই এটি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। অনেক কিছু ভাবতে হবে।’ ভারতের প্রতি যেহেতু কোন দেশের সমর্থন নেই, তাই এপ্রিলের পরবর্তী সভায় তাদের খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ক্রিকেট বোর্ড আইসিসিতে এর আগে কখনই এতটা কোণঠাসা হয়ে পড়েনি। এখন টেস্ট খেলুড়ে দেশ মোট ১০টি, তার সঙ্গে আরও ২টি দল (সম্ভাব্য আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তান) যোগ করে সংখ্যাটা ১২-তে উন্নীত করে সেটিকে সমান টু-টায়ারে ভাগ করা হবে। আর তিন বছর মেয়াদী ওয়ানডে লীগে অংশ নেবে মোট ১৩টি দল। আইসিসির (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল) চীফ এক্সিকিউটিভ কমিটি সম্প্রতি এমনটা জানিয়েছে। বোর্ড সভায় অনুমতি মিললে ২০১৯ সাল থেকে নতুন এই কাঠামো চালু হবে। শনিবার শুরু হওয়া সভায় না উঠলেও এপ্রিলে পরবর্তী সভায় এই প্রস্তাব নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে বলে সংবাদ মাধ্যমে জানান হয়েছে। পাঁচদিনের পরিবর্তে চারদিনের টেস্টের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। পরিবর্তন আসতে পারে রঙিন পোশাকের ওয়ানডে আর টি২০তেও। মূলত ক্রিকেটকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে সংস্থাটির মাথায় এমন সব পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে। নির্বাহী কমিটির সুপারিশ অনুমোদন পেলে ২০১৯ থেকে ৯-৩ ফরমেটে দুই বছর মেয়াদী টেস্ট লীগ দেখা যাবে। আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা ৯টি দল নিজেদের মধ্যে, আর র‌্যাঙ্কিংয়ের নীচের ৩টি দলের বিপক্ষে খেলবে। যেখানে এই মুহূর্তে টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ের ১০ নম্বর দল জিম্বাবুইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তান। র‌্যাঙ্কিংয়ের সেরা নয় দল ঘরের মাটিতে বা প্রতিপক্ষের মাঠে দুই বছরের মধ্যে অন্তত একবার করে খেলবে। সেরা দুই দল মুখোমুখি হবে প্লে-অফে। পূর্ণ সদস্য দেশগুলো এর বাইরেও দ্বিপাক্ষিক সিরিজ আয়োজন করতে পারবে। প্রস্তাবে বলা হয়, লীগ শুরু হলে প্রথম ৯ দলকে প্রতি দুই বছরে এই তিন দেশের অন্তত একটির সঙ্গে সিরিজ খেলতে হবে। চার বছর পরপর এই তিন দেশের মূল্যায়ন করা হবে। আর তিন বছর মেয়াদী ওয়ানডে লীগে খেলবে ১৩টি দল। ১০টি টেস্ট খেলুড়ে দেশ এবং আয়ারল্যান্ড, আফগানিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লীগের চ্যাম্পিয়ন দল। এই সময়ে প্রতিটি দল ঘরের মাটিতে ও প্রতিপক্ষের মাঠে একটি করে সিরিজ খেলবে। প্রতিটি দলের বছরের অন্তত ১২টি করে ম্যাচ খেলার সুযোগ মিলবে। স্বাভাবিকভাবে নেই কোন সর্বোচ্চ সীমা। আয়োজক দেশ আর প্রথম ৭ দল সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে। এই লীগের শেষ ৫ দলকে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে খেলতে হবে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে। মূল টুর্নামেন্ট হবে ১০ দলের। এখন থেকে চার বছর পরপর টি২০ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই হিসেবে পরের দুই আসর ২০২০ ও ২০২৪ সালে। তবে ২০১৮ ও ২০২২ সালে আরও দুটি বাড়তি বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে কথা চলছে। আইসিসির পাঁচটি অঞ্চলেই এই টুর্নামেন্টের জন্য একটি বাছাই পর্ব চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। একটি সাইকেলে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ থেকে তারা যে পয়েন্ট পাবে তার ভিত্তিতে চূড়ান্ত পর্বে যাবে। ওয়ানডে সিরিজ আয়োজনের সময় দলগুলো সর্বোচ্চ তিন ম্যাচের টি২০ সিরিজও আয়োজন করতে পারবে।
×