ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ॥ একটি রাজনৈতিক আলেখ্য

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ॥ একটি রাজনৈতিক আলেখ্য

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান হলো। বৃহত্তর সিলেটের মানুষ। কিন্তু সুরঞ্জিত- এই এক নামেই সারাদেশের মানুষ তাকে চিনতো। আমি তাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের আদি পর্ব থেকে। বাম ছাত্রনেতা হিসেবে রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব। অনেক সময় দলীয় পরিচয় পরিবর্তন করেছেন। যেমন ন্যাপ, একতা পার্টি, গণতন্ত্রী দল ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগেও যোগ দিয়েছেন। দলের সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন। মৃত্যুকালে ছিলেন দলের প্রেসিডিয়ামের সদস্য। দল বদল করলেও তিনি কখনো অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। এ জন্য জেল-জুলুম সবই ভুগেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা চার বছর আগে ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সিঙ্গাপুরে। আমি একটা হোটেলে ছিলাম। তিনিও স্ত্রীকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন। আমার খবর জেনে স্ত্রীকে নিয়ে আমার হোটেল রুমে হাজির হয়েছিলেন। ছিলেন প্রায় তিন ঘণ্টার মতো। আমার চাইতে বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাকে আমি সুরঞ্জিতদা ডাকতাম। তিনি আমাকে সম্বোধন করতেন গাফ্্ফার ভাই। দেশের রাজনীতি এবং তাতে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে সেদিন দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘গাফ্্ফার ভাই, আমি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শাসন, সামরিক শাসন, স্বৈরাচারী শাসনের সময় ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাইনি। আবার আমি কখনো সংখ্যালঘু নেতা হিসেবেও পরিচিত হতে চাইনি। আমি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সকল ধর্মের বাঙালির প্রতিনিধি হতে চেয়েছি। আমার রাজনীতি নিয়ে দেশে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু আমার এই পরিচিতি সম্পর্কে দেশে কোনো সংশয় ও বিতর্ক নেই।’ আমি তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন অসাধারণ বাগ্মী এবং পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। সংসদে বা সংসদের বাইরে বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যখন সকলকে টেক্কা দিয়ে কথা বলতে চাইতেন, তখন তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন সুরঞ্জিত সেন। তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল অসাধারণ। নৌকা প্রতীক ছাড়াই তিনি অতীতে অন্য দলের প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং একটানা সংসদ সদস্য ছিলেন। সংখ্যালঘু নেতা হিসেবে পরিচিত হতে না চাইলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর স্বাস্থ্য ও অধিকার রক্ষার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন না। আমার স্মরণ আছে বাংলাদেশে সামরিক শাসনামলে যখন সাধারণ নাগরিক অধিকার খর্ব করাসহ সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার চলছিল, তখন তিনি কিভাবে যেন লন্ডনে চলে আসেন। এসেই আমাকে আঁকড়ে ধরলেন। বললেন, ‘লন্ডনে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্তাদের সঙ্গে আমার একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেন।’ তখন লন্ডনে বাংলাদেশী কম্যুনিটি নেতা তাসাদ্দুক আহমদ জীবিত ছিলেন। তার সঙ্গে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার মাধ্যমে এই কর্তাদের সঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এক বৈঠকের ব্যবস্থা হয়। তিনি সেখানে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের বিবরণের সঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ভয়াবহ অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। এ্যামনেস্টি তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, তারা এই ব্যাপারে কঠোর প্রতিবাদ জানাবে। এই খবর লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকাতেও ছোট করে ছাপা হয়েছিল। আমি সুরঞ্জিতদা’কে বলেছিলাম, ‘আপনি তো রাখঢাক না রেখে সামরিক শাসনের অত্যাচার তুলে ধরেছেন। এখন দেশে ফিরবেন কী করে? সুরঞ্জিত সেন জবাব দিয়েছিলেন, ‘দেশ তো এখন বড় কারাগার। দরজা তো খোলাই। ঢুকে পড়তে অসুবিধা নেই।’ বিতর্কিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকেও দেখেছি। বিএনপির শাসনামলে জেনারেল জিয়ার জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসে টেলিভিশনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বিতর্কিত হন। এই সামরিক শাসকের বিরোধী ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা তার বাড়িতে হামলা চালাতে গিয়ে তাকে না পেয়ে তার গাড়ি ভাংচুর করে। এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই তাকে বলেছিলাম, এটা আপনি কী করলেন? সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের একজন নেতা হয়ে আপনি গেলেন একজন সামরিক শাসকের জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসে টেলিভিশনে বক্তৃতা দিতে? সুরঞ্জিত এক মুহূর্ত না ভেবে বললেন, ‘আত্মসাফাই গাইব না; যুক্তি দিয়ে নিজের ভুল খ-নের চেষ্টা করব না। আমি ভুল করেছি।’ তার মধ্যে নিজের ভুল স্বীকারের একটা সাহসিকতা ছিল, যার ফলে বহুবার বহু বিতর্ক ও নিন্দার কালিমা তাকে কলঙ্কিত করতে পারেনি। এরপর তিনি সাম্প্রতিককালে মন্ত্রী থাকার সময় যখন তার এক এপিএসের গাড়িতে কয়েক হাজার টাকা ধরা পড়ল এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠল, তখনও আমার মনে হয়েছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এত নিচে নামেননি। এখন প্রকৃত অপরাধী আদালতের বিচারে দ-িত হয়েছেন। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনৈতিক জীবনকে কিছুটা হলেও তা ক্ষতি করেছে। শেখ হাসিনার সরকারের শুধু মন্ত্রী হওয়া নয়, হয়ত সংসদে স্পীকারও হতে পারতেন। এমন একটা গুজবও এক সময় উঠেছিল। তা যে তিনি হননি, তাতে আমাদের সংসদীয় রাজনীতির ক্ষতি হয়েছে। তার কোন ক্ষতি হয়নি। মেঘে ঢাকা তারার মতো তিনি কলঙ্কমুক্ত হয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সিনিয়র সদস্য হিসেবে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত দেশের সেবা করে গেছেন। ওই দুর্নীতির অভিযোগে তাকেও যুক্ত করার জন্য এক শ্রেণীর মিডিয়া প্রচারের সময়েই আমার ধারণা হয়েছিল (ধারণাটি সঠিক কী ভুল তা জানি না) আমাদের রেল চলাচল ব্যবস্থায় যে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির স্তূপ, তার পালক কালো বিড়াল ধরার সংকল্প তিনি ঘোষণা করেছিলেন। তাকে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে শুধু মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় করা নয়, রাজনীতি থেকেও বিদায় করে দেয়ার একটা চক্রান্ত হয়ত এই কালো বিড়ালদের ছিল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার দলের ভেতরের ও বাইরের রাজনৈতিক শত্রুরা। তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে পারলে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির একটা গুরুতর ক্ষতি করা যেত। তিনি নিজেকে বিশেষভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা বলে মানুন আর নাই মানুন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রটিতে তার একটা বিশেষ অধিষ্ঠান ছিল। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হওয়ার সময়ে কিরণ শঙ্কর রায় থেকে শুরু করে বহু প্রভাবশালী নেতা পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান) থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছিল। এ সময় বসন্ত কুমার দাশ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ মুষ্টিমেয় নেতা তৎকালীন সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ সরকারের প্রচ- নির্যাতনের মধ্যেও স্বদেশে থেকে যান। তাদের মধ্যে বরিশালের যতীন সেন মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতনে জেলে বন্দী অবস্থায় মারা যান। আরেকজন সাহসী জাতীয় নেতা, ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ কুমিল্লার ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে তো ’৭১ সালে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতন দ্বারা হত্যা করে। গোটা পাকিস্তান আমলে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য কোনো নেতা (বিশেষ করে অমুসলিম নেতা) যাতে মাথা তুলতে না পারেন, গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামে সংঘ্যালঘুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারেন, সেজন্য বসন্ত কুমার দাশ থেকে প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ি, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখ নেতাকে শুধু নির্যাতনের শিকার করা নয়, তাদের চরিত্র হননের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এসব নেতাকে ভারতের চর ও দালাল আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, এরা ইসলাম ও পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুর (ভারতের) চর হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে রয়ে গেছেন। পাকিস্তান আমলেই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠনের সময় মনোরঞ্জন ধরকে তার মন্ত্রিসভার সদস্য করেন। আর যায় কোথা? সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ মহল থেকে চিৎকার উঠল, ভারতের চর পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় ঢুকেছে। মুসলিম লীগের সমর্থক কাগজগুলোতে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার নাম দেয়া হয়েছিল ‘আতা-ধর মন্ত্রিসভা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মনোরঞ্জন ধর, ফণীভূষণ মজুমদার প্রমুখ জাতীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে উঠে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় এই দু’জনেরই স্থান হয়েছিল। বাহাত্তরের সংবিধান রচনায় ড. কামাল হোসেন সব কৃতিত্বের দাবিদার। আসলে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিযুক্ত টিমের লিডার। সংবিধান রচনায় যারা মুখ্য দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের নাম আজ বিস্মৃত। এই বিস্মৃত নেতাদের মধ্যে মনোরঞ্জন ধর ছিলেন একজন। আমার বলতে দ্বিধা নেই, চরিত্রে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি, পতন, স্খলন, বিতর্ক সত্ত্বেও মনোরঞ্জন ধর, প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ি, ফণীভূষণ মজুমদার প্রমুখের পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একজন জাতীয় নেতার পর্যায়ে উঠে এসেছিলেন। তাকেও ধ্বংস করার চক্রান্ত হয়েছে। তার চরিত্র হননের চেষ্টা হয়েছে। তিনি সবকিছু মোকাবেলা করেছেন। কিরণ শঙ্কর রায় কিংবা আরো ডজনখানেক নেতার মতো ভারতে চলে যাননি। পরবর্তীকালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়ে সেখানকার রাজনীতিতে একজন কেউকেটা হতে পারতেন। তিনি যাননি। দেশের মাটি আঁকড়ে থেকেছেন। সংখ্যালঘু নেতার ছাপও তিনি গায়ে লাগাননি। জাতীয় রাজনীতিতে সকল ঝড়-ঝঞ্ঝার মুখে অবিচল রয়েছেন। জাতীয় নেতৃত্বের পর্যায়ে উঠেছেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন। তার শূন্যস্থান পূরণ করা সহজ হবে না। ল-ন : ৭ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৭
×