ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ই-নাইন ফোরামের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ রুখতে শিক্ষায় সংস্কার করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ রুখতে শিক্ষায় সংস্কার করা হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জঙ্গীবাদের সমাধান সামনে রেখে শিক্ষায় সংস্কার হচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উগ্রবাদ ও সশস্ত্র সংঘাত বিশ্বে মানবাধিকার, শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। উদ্ভাবন, সমঝোতা এবং দূরদর্শী নীতির দ্বারা এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের সমাধান সামনে রেখে বাংলাদেশের শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা উপকরণ সংস্কার করা হচ্ছে। রবিবার রাজধানীর হোটেল রেডিসনে নয়টি দেশের শিক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ক ‘ই-নাইন’ ফোরামের তিন দিনব্যাপী মন্ত্রী পর্যায়ের ১১তম সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। ই-৯ এর জন্ম দিল্লীতে ১৯৯৩ সালে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৯টি উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ শিক্ষা বিষয়ক লক্ষ্যসমূহ নিয়ে এই সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা জোরদার করার লক্ষ্য সামনে রেখে টেকসই উন্নয়নের জন্য নতুন বৈশ্বিক ‘এডুকেশন ২০৩০’ এজেন্ডার প্রেক্ষাপটে ই-৯ উত্তর-দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। ই-৯ ভূক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ব্রাজিল, চীন, মিসর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, নাইজিরিয়া এবং পাকিস্তান। এবারই প্রথম বাংলাদেশে এ সম্মেলন হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়েই ই-৯’ এর নতুন চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। গতবারের চেয়ারপার্সন পাকিস্তানের শিক্ষা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বালিঘ-উর-রহমান সংগঠনের উন্নয়ন রিপোর্ট উপস্থাপন করেন এবং নতুন চেয়ারপার্সন নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে সংগঠনের চেয়ারপার্সনশিপ হস্তান্তর করেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এবং ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা। ই-৯ শীর্ষক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ই-৯ ’র সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় আমি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিনন্দন। তিনি বিগত ২ বছর যাবত আন্তরিকতার সঙ্গে ই-৯ এর লক্ষ্যকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দায়িত্ব পালন করায় সদ্য বিদায়ী চেয়ারপার্সন পার্সন মুহাম্মদ বালিঘ-উর-রহমানকে ধন্যবাদ জানান এবং এই অনুষ্ঠান আয়োজনে সহ-আয়োজকের ভূমিকা পালন করায় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকাভোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকায় এই বৈঠক এসডিজি-৪ অর্জনের ক্ষেত্রে যৌথভাবে আমাদের করণীয় সম্পর্কে এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বিগত দেড় দশকে এমডিজি আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ এমডিজির অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় পর্যায়ে জেন্ডার সমতা অর্জন এবং প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় শতভাগ ভর্তি নিশ্চিতকরণ। নতুনভাবে প্রণীত এসডিজি-৪-এ জেন্ডার সমতাকে আবারও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা সমতাভিত্তিক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এসডিজি-৪-এ বর্ণিত ফলপ্রসূ শিখন ফলাফল পেতে সহায়তা করবে। দেশে শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে সবার সঙ্গে বিশদ আলোচনার মাধ্যমে ২০১০ সালে একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। আমরা বেশকিছু কৌশলগত নীতি এবং উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি কর্মসূচী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন গোষ্ঠী এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত সম্পদ বরাদ্দ, সামাজিকভাবে অনগ্রসরদের অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যক্তিখাত/ বেসরকারী সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্ব জোরদারকরণ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় অধিকতর সুবিধা নিশ্চিত করতে বৃত্তি কর্মসূচীর সম্প্রসারণ, দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং সর্বজনীনতা নিশ্চিতকরণ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে এবং ভর্তির হার বৃদ্ধি করতে এক বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেছে। শিশুদের শৈশবে মাতৃভাষায় শেখার অধিকারের বিষয়টি মাথায় রেখে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক বই প্রকাশ করেছে। এর ফলে ২০১৬ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তির হার ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং ঝরে পড়ার হার ২০ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, বছরের প্রথম দিনেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ এই সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে। ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে আমরা ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। এটা বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বই বিতরণ কার্যক্রম। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, শিক্ষা সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করে, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা হ্রাস এবং তাদের ক্ষমতায়নে সাহায্য করে। আমাদের স্যানিটেশন, পানি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য এবং শিখন ফলাফলের ওপর এর একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পঠন শিক্ষাকে সহজ করবে, শিক্ষার্থীদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাবে এবং নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের খাপ খাওয়াতে সাহায্য করবে। শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষকতা পেশায় যোগ্য ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পেশার জন্য একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে নীতিগত উপায় উদ্ভাবন এবং বিশেষ প্রণোদনার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষা আমাদের কাছে একটি জাতীয় অগ্রাধিকারের বিষয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন দেশের জন্য সর্বজনীন শিক্ষাসহ বেশকিছু বলিষ্ট এবং দূরদর্শী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওইসব দূরদর্শী উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমতাভিত্তিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ও জীবনব্যাপী শিখনের লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত। আমাদের সরকারের বাজেট বরাদ্দে শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আশা করি- এই বৈঠক থেকেই এসডিজি-৪ অর্জনের জন্য আমাদের অভিযাত্রা শুরু হলো এবং ঢাকা ঘোষণা আমাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতীয়মান হবে। বিদেশী অতিথিবৃন্দের এখানে অবস্থান আনন্দদায়ক এবং স্মরণীয় হয়ে থাকুক, এ প্রত্যাশা করছি। ই-নাইনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে শিক্ষামন্ত্রী ॥ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি প্রতিনিধিত্বকারী নয়টি দেশের শিক্ষা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রীদের ই-নাইন ফোরামের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। দায়িত্ব পাওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা বাড়তি চাপ, এই চাপটা নিতেই হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত মান অর্জনের ওপর জোর দিতে হবে। ‘মিনিস্টেরিয়াল প্যানেল: প্রায়োরিটিজ এ্যান্ড পারস্পেকটিভস অন এডুকেশন-২০৩০’ সেশনে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষামন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এই নয়টি দেশে। আবার এসব দেশেই এ্যাডাল্ট লিটারেসি সবচেয়ে কম। এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ই-নাইন ফোরাম গঠিত হয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন চেয়ারম্যান। এটা আমাদের সম্মানের বিষয়। চেয়ারম্যান পদ পাওয়াটা দেশের জনগণ এবং বাংলাদেশের জন্য সাফল্য। আমরা মনে করি, আমাদের এখন অনেক কাজ। বাংলাদেশের ওপর ই-নাইন দেশগুলোর যে আস্থা, তা রক্ষা করতে হবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যেন আস্থার সঙ্গে চলতে পারি, এটাই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের জোর দিতে হবে কোয়ালিটির দিকে, নারী শিক্ষার সমতার দিকে। সদস্য দেশগুলোকে নিয়ে এগোলে সবাই লাভবান হব, বাংলাদেশ আরও বেশি লাভবান হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসায় ইউনেস্কো মহাপরিচালক ॥ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা। তিনি বলেন, উন্নয়নে সফলতার গল্প রয়েছে বাংলাদেশের। চরম দরিদ্রতা হ্রাস, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, স্কুলে যাওয়া, ঝরে পড়া হ্রাস, স্কুলে ছাত্রীদের অংশ নেয়ায় সমতা, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারসহ বাংলাদেশের পজিটিভ পরিবর্তন রয়েছে। বাংলাদেশকে উদীয়মান হিসেবে মন্তব্য করে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক বলেন, এ উন্নয়নের কারণ বাংলাদেশ তার জনগণের জন্য বিনিয়োগ করছে। পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি ই-নাইন দেশের উন্নয়নের গল্প রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সব সরকার ও সমাজের সমন্বিত কার্যক্রম দরকার। ই-নাইন প্রতিষ্ঠার সময় এই ৯টি দেশ যে অবস্থানে ছিল তার চেয়ে বর্তমানে অনেক এগিয়েছে বলে জানান ইরিনা বোকোভা।
×