ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

সাগরের টানে আন্দামানে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সাগরের টানে আন্দামানে

কোথা তীর! চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল আপনার রুদ্রনৃত্যে দেয় করতালি লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা= অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি উদ্ধত বিদ্রোহ ভরে। নাহি মানে হাল, ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল মুঢ়সম।... এতটা না হলেও আকাশের মুখ ভার দেখে জাহাজে ওঠার সময় মনে হচ্ছিল সমুদ্র বেঁকে বসবে না তো? রাগী সমুদ্র ভয়ঙ্কর। কাউকে, কোন কিছুকে পরোয়া করে না। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, ‘আপনার রুদ্রনৃত্যে দেয় করতালি লক্ষ লক্ষ হাতে।’ তবে এখানকার নাবিকেরাও কম যায় না। যত রাগীই হোক সমুদ্রকে অত তোয়াজ তোষামদের ধার ধারে না। কালো মেঘে ছাওয়া আকাশের ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই নোঙর উঠল। জাহাজের নাম নন্দিনী। এমন নিখাঁদ বাংলা নাম আমরা বাঙালী বলেই কি? নইলে আর কোনটার এমন মিষ্টি নাম নেই কেন। না। ঘটনা নিছক কাকতাল। বাঙালী বলে বিশেষ পক্ষপাতিত্ব নয়। এখানে অনেক অভিবাসী বাঙালী আছে। সাতচল্লিশের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রচুর বাস্তুহারা মানুষ ভাগ্যান্বেষণে এসে বাসা বেঁধেছিল। দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্টের মালিক বা কর্মচারী হিসেবে তাদের উত্তরসূরিদের সঙ্গে দেখা হওয়া এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। নন্দিনী মনে হয় তেমনই কোন বাঙালী মালিকের জাহাজ। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে নর্থ বে আইল্যান্ড। তিরিশ চল্লিশ মিনিটের পথ। ঝড় না উঠলেও মাঝপথে সমুদ্র দুয়েকবার ঠিকই রোখ দেখিয়েছে। নন্দিনীর চালকও তার দাঁত ভাঙা জবাব দিয়ে যথারীতি তীরে তরী ভিড়িয়েছে। সাগর তলে, মাছের রাজ্যে চারপাশে জীবিত প্রবাল, সি কিউকাম্বার, স্টার ফিশ, নাম না জানা রংবেরঙের আরও অনেক মাছের একা কিংবা ঝাঁক বেঁধে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্যে বিভ্রম জাগে, বুঝি গোটা এ্যাকুয়ারিয়ামের মধ্যে এদের সঙ্গে ভাসছি। এ্যাকুয়ারিয়ামই তো। তবে কৃত্রিম নয়। একেবারে আসল। সত্যিকারের সাগর তলার গভীর নির্জন ঘর সংসার। নর্থ বে আইল্যান্ডের এটাই আসল আকর্ষণ। সাবমেরিনে করে দেখে নেয়া সমুদ্রের তলাটাও। বাংলাদেশের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনেও প্রবাল দেখা যায় প্রচুর। তবে সবই মৃত। ফসিল। এখানে মন ভরে যায় তাজা প্রবালের বিচিত্র রূপে। আর বাড়তি পাওয়া সাব মেরিনে চড়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সাগর তলটা হেঁটে দেখার ব্যবস্থাও রয়েছে। অক্সিজেন মাস্ক আর বিশেষ পোশাক পরে মাছেদের সঙ্গে একেবারে লাইভ। তবে সে জন্য চাই যথেষ্ট সাহস আর মনোবল। ব্রিটিশ পোড়োবাড়ি, রস আইল্যান্ড কি নেই! হাসপাতাল, চার্চ, সুইমিংপুল, টেনিস কোর্ট, সৈন্যদের থাকার বাড়ি, সমুদ্রের নোনা পানি পানোপযোগী করার বিশাল সব আধার। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে পরিকল্পিত আবাসন। আয়েশি জীবনযাপন করার জন্য যা লাগে তার আয়োজনে কোন কমতি ছিল না। বাগানের মধ্য দিয়ে পথ উঠে গেছে পাহাড়ে। তার চূড়া থেকে দেখা যায় নিচে বয়ে চলা সমুদ্র। নিচে নেমে এসে চলে যাওয়া যায় একেবারে সৈকতে। অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপের নির্জন সামুদ্রিক জীবন। যাকে ঘিরে এ আয়োজন তিনি সামান্য কেউ ছিলেন না। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের চীফ কমিশনার। তার গ্রীষ্মকালীন বাস ও অফিস ছিল এটি। ধাতব সাইনবোর্ডে ‘হিস্ট্রি অব রস আইল্যান্ড’-এ এ আবাস সম্পর্কে লেখা আছেÑ ‘রস আইল্যান্ড বিকাম দ্য ন্যাচারাল চয়েস ফর দ্য সেট্্লারস ডিউ টু ইটস কমান্ডিং জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন। সেটলারস ওয়েন্ট এবাউট দেয়ার বিজনেস অব রিক্রিয়েটিং এ হোম ফার এওয়ে ফ্রম হোম উইথ ভিগর, সো মাচ দ্যাট দ্য আইল্যান্ড সুন আর্নড দ্য এপিথেট অব ‘দ্য প্যারিস অব দ্য ইস্ট’। ইন র‌্যাপিড সাকসেশন রস দ্য এ্যাংলিকান চার্চেস, হোমস ফর দ্য ব্রিটিশ এ্যান্ড ইন্ডিয়ান অফিসার্স, স্টোর হাউসেস, শপস, প্রিন্টিং প্রেস, হসপিটাল, পোস্ট অফিস, টেনিস কোর্টস, মিনারেল ওয়াটার প্ল্যান্ট, সুইমিংপুল, বেকারি, লাইব্রেরি এ্যান্ড জেনারেল স্টোরস। এ্যান এনট্যায়ার বাজার এন্ড থ্রি সেপারেট ক্লাবস ওয়্যার অলসো কন্সট্রাকটেড ভিজ, সেটলমেন্ট ক্লাবস, সাবওরডিনেট ক্লাব এ্যান্ড টেম্পল ক্লাব। এ্যাবাউট ৫০০ পার্সোনেল ইনক্লুডিং অফিসার্স, ট্রুপস, ইন্ডিয়ান মার্চেন্টস এ্যান্ড ফ্যামিলিস লিভড এ্যাট রস আইল্যান্ড’। যে দেয়ালগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে তার নির্মাণ শৈলী একেবারে অন্যরকম। প্রতিটি দেয়ালের গায়ে ছড়ানো গাছের শেকড় আর বিশাল গাছ উঠে গেছে ওপরে। গাছগুলো এখনো সজীব, প্রাণবন্ত। কিন্তু এই আয়েশি আবাস গড়ে উঠেছিল কীভাবে? হিস্ট্রি অব রস আইল্যান্ডের আরেকটি বোর্ডে লেখা আছেÑ ‘টু সেট আপ দ্য পেনাল সেট্্লমেন্ট ইন রস আইল্যান্ড, ড. জেপি ওয়াকার এ্যান এক্সপেরিয়েন্সড জেল সুপারিনটেনডেন্ট এ্যারাইভড পোর্ট ব্লেয়ার ইন ১৮৫৮ উইথ টু শিপস, ২০০ ইন্ডিয়ান রেভ্যুলিউশনারিজ (এ্যাজ কনভিক্টস), এ্যান ইন্ডিয়ান ওভারসীর, ০২ ইন্ডিয়ান ডক্টরস এ্যান্ড এ গার্ড অব ৫০ নেভাল ব্রিগেডস ম্যান। দ্য ফ্রিডম ফাইটারস ক্লিয়ার্ড দ্য থিক ভেজেটেশন এ্যান্ড দ্য জাঙ্গল এ্যান্ড ক্যারিড আউট দ্য এনট্যায়ার কন্সট্রাকশন ওয়ার্ক। দে ওয়্যার লেটার শিফটেড টু ভাইপার আইল্যান্ড হোয়ার দ্য ফার্স্ট জেইল ওয়াজ বিল্ট। দ্য এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেডকোয়ার্টার অব দ্য ব্রিটিশ ইন দ্য আন্দামান এ্যান্ড নিকোবর আইল্যান্ড ওয়াজ এসটাবলিশড এ্যাট রস আইল্যান্ড এ্যান্ড দেয়ারফোর ইট বিকেম দ্য সাইটেডেল অব ব্রিটিশ পাওয়ার।’ এখন অবশ্য পুরোটাই পোড়ো। হরিণ আর ময়ূরের অভয় বিচরণ ক্ষেত্র। হরিণ, ময়ূরের পোষমানা দেখে অবাক হতে হয়। এমনিতে জঙ্গলে প্রাঙ্গণে এলোপাতাড়ি ঘুরে বেড়ায়। একটা দুটো নির্ভয়ে চলে আসে পর্যটকদের মাঝে। আসল সৌন্দর্য দেখা যায় খাওয়ার সময়। সময়টা ওদের আন্দাজের মধ্যেই থাকে হয়ত। একটা সিগন্যালের অপেক্ষা। ব্যাস, গাছের ডাল থেকে ঝুপঝাপ নেমে আসছে ময়ূর। ঝোপঝাড় থেকে দলবেঁধে হরিণ। যারা পিছিয়ে পড়ে পর্যটকদের দেখে তারা প্রথমে লাজুক শিশুর মতো থমকে দাঁড়ায়। ভয়ের কিছু নেই নিশ্চিত হলে আবার এক পা দু পা করে অন্যদের সঙ্গে গিয়ে তাল মেলায়। খাবার বিশেষ কিছু নয়। খুদ বা চালের মত কিছু ছড়িয়ে দেয় মাঠে। তাতেই ওরা খুশি। ব্যবস্থা সবার জন্য এক। হরিণ যা খায় ময়ূরও তাই। রস আইল্যান্ড থেকে এক বন্দীর পলায়নের কাহিনী প্রচলিত আছে। দুধনাথ তেওয়ারী নামে এক বিদ্রোহী সিপাহীকে আন্দামানের এখানে পাঠানো হয়। তখন রস ছিল গভীর অরণ্যে ঢাকা। অবস্থা দেখে দুধনাথ বুঝেছিলেন এখানে বেঁচে থাকা অসম্ভব। পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে মূল ভূখ-ের অরণ্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেখানে আদিবাসী বন্য মানুষদের আক্রমণের শিকার হন। ওই আদিবাসীরা তাকে না মেরে আহত অবস্থায় নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যায়। সেখানে সুস্থ হওয়ার পর দুধনাথের সঙ্গে নিজেদের এক মেয়ের বিয়ে দেয়। দুধনাথ বছরখানেক তাদের সঙ্গে ছিলেন। সেসময় দক্ষিণ আন্দামান এবং পোর্ট ব্লেয়ার অঞ্চলে ভারতের মূল ভূখন্ড এবং সিংহল ইত্যাদি জায়গা থেকে নাকি অনেক মানুষ প্রবেশ করেছিল। এতে আতঙ্কিত হয় আদিম মানুষেরা। তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে। দুধনাথ তখন পালিয়ে এসে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে এ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয়। বিনিময়ে বন্দীজীবন থেকে মুক্তি পায়। অবশ্য এ কাহিনীর সত্যতার নিশ্চিত বর্ণনা কোথাও নেই। লাইট এ্যান্ড সাউন্ড শো ইতিহাস উঠে আসে বর্তমানে সেলুলার জেলে বন্দী ব্রিটিশ ভারতের বিপ্লবী বারীন ঘোষ, উল্লাস কর দত্ত, উপেন্দ্র নাথ বন্দোপাধ্যায়, হেম কানুন গো হঠাৎ উঠে এলেন বর্তমানে। মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসুও। টাইম মেশিনে নয়, লাইট এ্যান্ড সাউন্ড শো’র কাল্পনিক ইমেজে। আন্দামান বলতে প্রথমেই যে চিত্রকল্পটি মনে আসে সেই বিখ্যাত সেলুলার জেলের প্রাঙ্গণে। সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় ভরাট কণ্ঠের ধারা বর্ণনা, আলো ছায়ার ওঠানামা আর আবহ সঙ্গীতের মূর্চ্ছনায় যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে জেলখানার সেলগুলো। নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হতো বন্দীদের ওপর। খাটুনির কাজ করানো সারাদিন ধরে। জেলখানার প্রাঙ্গণে সেসবের রেপ্লিকা রাখা আছে। ত্রিভূজ আকারের স্ট্যান্ডের সঙ্গে বন্দীর হাত-পা বেঁধে বেত মারা হতো আর সামান্য দূরে সিংহাসনের মতো চেয়ারে বসে তা দেখতো জেল অফিসার। দিনে ঘুরে দেখা পুরো জেল আর সন্ধ্যার লাইট এ্যান্ড সাউন্ড শো গায়ে কাঁটা দেয়া এক অনুভ’তি তৈরি করে। যারা এখানে বন্দী ছিলেন হতে পারে তাদের আন্দোলনের ধরনে ভুল ছিল। কিন্তু তাকেই সত্য মনে করে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাতে কোন ভুল ছিল না। এ ত্যাগের তুলনা হয়না। লাইট এ্যান্ড সাউন্ড শো’য় তাদের কাল্পনিক উপস্থিতিতে তাই ভারি হয়ে আসে চোখ। বহুমুখী অনুভূতির জন্ম দেয়া আন্দামানকে বিদায় দিয়ে আবার বীর সাভারকার বিমানবন্দর। আবার কোলকাতা। আবার প্রাত্যাহিক কাজে মগ্ন হওয়া।
×