ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

১০ জনের একটি তালিকা তৈরি করবে সার্চ কমিটি

যোগ্যদের নাম বাছাইয়ের পরামর্শ দিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

যোগ্যদের নাম বাছাইয়ের পরামর্শ দিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নির্বাচন কমিশনে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য যোগ্যদের বাছাইয়ের পাশাপাশি কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করতে দিতে কিছু সুপারিশ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেন, বাছাইয়ে আগামীতে কমিশনে যাদের নিয়োগের সুপারিশ করা হবে তাদের জন্য দায়িত্ব পালন অনেক চ্যালেঞ্জের হবে। তাদের নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে। তাই কারো চাপের কাছে যাতে নতি স্বীকার না করেন এমন সাহসী, পরিশ্রমী, সৎ, নিষ্ঠাবান, বিবেকবানদের কমিশনে নিয়োগে জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এ জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ের জন্য পেশাদারিত্ব ও মানবিকগুণাবলী বিবেচনা করে বাছাই করার আহ্বান জানান তারা। বিশেষ করে তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান। তারা উল্লেখ করেন, সার্চ কমিটির প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। একনিষ্ঠভাবে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের সুপারিশ করবেন। যাদের নাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হবে বাছাইয়ের স্বচ্ছতার জন্য সেসব নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করার আহ্বান জানান তারা। বুধবার দ্বিতীয়বারেব মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত সার্চ কমিটি। সকাল ১১ টায় সুপ্রীম কোর্টের জাজেজ লাউঞ্জে চার বিশিষ্ট ব্যক্তি এ বৈঠকে অংশ নেন। তারা হলেন Ñসাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মাদ আবু হেনা, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের বলেন, সার্চ কমিটি রাজনৈতিক দলের দেয়া তালিকা নিয়ে পর্যালোচনা করে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তালিকাও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ের রাজনৈতিক দলের তালিকা নয়, বাইরে থেকেও নাম আসতে পারে। সব নামই পর্যালোচনা করা হবে। তিনি বলেন, বুধবার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্যই মূলত তাদের ডাকা হয়েছিল। এরা অত্যন্ত বিজ্ঞব্যক্তি। বৈঠকে সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সার্চ কমিটির সুপারিশের ওপর দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নির্ভর করছে। এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন যাদের যোগ্যতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। সমমেধা, সমযোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের বাছাই করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন উল্লেখ করেন। আজ বৃহস্পতিবার নামের তালিক পর্যালোচনা করতে সার্চ কমিটি বেলা চারটায় পুনরায় বৈঠকে বসবে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মাদ আবু হেনা সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশনের যারা নেতৃত্ব দেবেন তাদের প্রত্যেকেরই দলনিরপেক্ষ, বিবেকবান, প্রজ্ঞাবান, সাহসী ও পরিশ্রমী হতে হবে। কমিশনকে কর্যকর ও স্বাধীন দেখতে চাইলে তাহলে যোগ্য, বিবেকবান, প্রজ্ঞাবান প্রধান নির্বাচন কমিশনার দরকার। বৈঠকে এই প্রস্তাবই সার্চ কমিটিকে দেয়া হয়েছে। দেশের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের ওপর যে দায়িত্ব সংবিধান দিয়েছে সেই দায়িত্ব পালনে এমন যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা দরকার। তিনি বলেন, সার্চ কমিটির বৈঠকে কোন নাম নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। সার্চ কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ে সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনার জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে এটি দেশের গণতন্ত্রের জন্য শুভকর। এটা আগামীতেও অব্যাহত থাকা দরকার উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, সার্চ কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহের কোন সুযোগ নেই। তাদের অন্য চোখেও দেখারও সুযোগ নেই। বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, আমার বিশ্বাস, সার্চ কমিটি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। হবে দলনিরপেক্ষ ও নির্ভীক ব্যক্তিদের বাছাই করবে। একই সঙ্গে সার্চ কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ে অসাম্প্রদায়িত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটি সুশীল সমাজের মতামত নিয়েছে। আমরা যে পরামর্শ দিয়েছি তা যেন টার্ম অব রেফারেন্স হিসেবে লিপিবদ্ধ রেখে আগামী নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি যোগ্য সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। সার্চ কমিটি যোগ্য ১০ ব্যক্তিকে বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেবেন। সুশীল সমাজের সঙ্গে সার্চ কমিটি এই প্রথম বৈঠক করেছে উল্লেখ করে বলেন, এতে সুশীল সমাজের মূল্যায়ন করা হয়েছে। এটা কোন আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়। এ বিষয়ে সুশীল সমাজের ভূমিকা রয়েছে, মিডিয়ার ভূমিকা রয়েছে তার স্বীকৃতি দিয়েছে সার্চ কমিটি। সার্চ কমিটির নাম বাছাই প্রসঙ্গে বলেন, পত্রিকায় রাজনৈতিক দলের অনেক নাম এসেছে। নাম নিয়ে কিছু বলব না। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দলের তালিকায় দু’একটি নাম উভয় তালিকায় রয়েছে। সেখান থেকে সার্চ কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করতে পারে। এছাড়া এর বাইরে থেকেও তারা নাম বাছাই করতে পারে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ে যে অনুশীলন শুরু হয়েছে এর মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র সুরক্ষা হবে। আগামীতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। সার্চ কমিটির প্রতি পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বৈঠকে সবচেয়ে জোর দিয়ে বলা হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাছাইয়ের ওপর। কারণ, যিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন তিনি হবেন প্রতীক। তিনি যদি তার দায়িত্ব পালনে নরম হন তাহলে কমিশন জিরো হয়ে যাবে। এজন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মেরুদ- শক্ত থাকতে হবে। কোন হুমকির কাছে পরোয়া করবেন না তিনি। এক্ষেত্রে তিনি ভারতের দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কারো কথা মানেন না। নির্বাচনী আইন প্রসঙ্গ বলেন, ২০ বছর ধরে বলা হচ্ছে দেশে কোন নির্বাচনী আইন নেই। কিন্তু আইন নয়। নির্বাচনী বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। কানাডাসহ পৃথিবীর ২০টি দেশে নির্বাচনী বিষয়গুলো সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের এখানে এটি করতে হবে উল্লেখ করেন। ডেইলি স্টার সম্পাদক বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, ঐতিহাসিকভবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অনেক বড়। যেহেতু গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত নির্ভর করছে আগামীতে সুষ্ঠু, সুন্দর ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর। সার্চ কমিটির বাছাইয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের সুপারিশের পাশাপাশি তাদের একটি ভিশন থাকা উচিত। সার্চ কমিটি তাদের প্রজ্ঞার ভিত্তিতে কিছু বিষয় পরামর্শ আকারে আগামী নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে যাবে। যেসব নাম প্রস্তাব করা হয়েছে সেসব নাম নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। সার্চ কমিটির ওপর দায়দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নিজেদের বিচক্ষণতায় বাছাই করে কিছু নাম দেবে রাষ্ট্রপতির কাছে। এ কারণে নাম সিলেকশনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নামের তালিকা চেয়েছে তারা। সুশীল সমাজ সার্চ কমিটির সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিলেও তারা কোন নাম প্রস্তাব করেনি। নাম বাছাইয়ে সার্চ কমিটি অতন্ত সচেতন রয়েছে। তাই নামের তালিকা প্রকাশ নিয়েও বিতর্ক করা ঠিক হবে না। গতবার সিলেকশন কমিটি ক্যাবিনেট সচিবের কাছে যে নামের তালিকা দিয়েছিল তখন কিন্তু তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই নাম প্রকাশ করেছে। এবার আশা করব সার্চ কমিটির সুপারিশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশ করার। তিনি বলেন, পেশাদারিত্ব মানবিক গুণাবলী বিবেচনায় তারা যাদের বাছাই করবে তাদের সৎ, নিষ্ঠাবান, সাহসী হতে হবে। কারো কাছে তারা মাথা নত করবে না। কিন্তু কারো পারফর্মেন্স নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাইয়ের পর তারা যদি তাদের পারফর্মেন্সে নিরাশ করেন তাহলে তার দায়দায়িত্ব সার্চ কমিটির নয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটির ওপর আস্থা রয়েছে। একনিষ্ঠভাবে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগে সুপারিশ করবেন। ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সার্চ কমিটির বৈঠকে বলা হয়েছেÑ তারা যে নাম সুপারিশ করবে তার আগে একটি ভূমিকা রাখবে। সার্চ কমিটির দায়িত্ব পালনে যেসব পরামর্শ দিয়েছে ভূমিকায় তা উল্লেখ থাকবে। সবাই মিলে পরামর্শ করে কিছু ক্রাইটেরিয়ার ওপর যোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করা হলো। কিন্তু তারা যখন দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবে তখন যদি জনগণের আশা অনুযায়ী কাজ করতে না পারে তখন সে দায়দায়িত্ব সার্চ কমিটির নয়। আগের নির্বাচনগুলোর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, ’৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত তিনবার যে নির্বাচন হয়েছে তা ছিল দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু আগামীতে যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন তাদের কাজের ধরন আগের নির্বাচনের চেয়ে অনেকটা তফাৎ হবে। আগে যেসব ভাল নির্বাচন হয়েছে সবই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। তখন সরকার কমিশনের কাজে কোন হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু এখন যারা কমিশনের আসবেন তাদের নির্বাচন করতে হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে। সেখানে রাজনৈতিক দলের একটা হস্তক্ষেপ নির্বাচনের ওপর থাকতে পারে। এটা মোকাবেলা করা তাদের জন্য বড় ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ। যেটা আগে ছিল না। রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ পাশ কাটিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ বর্তমান কমিশনের থাকতে হবে। তিনি বলেন, সার্চ কমিটি যাদের নাম প্রস্তাবের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাছাই। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম প্রস্তাবের ওপরই সব কিছু নির্ভর করবে। কারণ, প্রধান নির্বাচন কমিশারের ওপর নির্ভর করবে কমিশনের কার্যকারিতা ও ক্ষমতা প্রয়োগ। আশা করি, রাজনৈতিক সরকার কমিশনের কাজের ওপর কোন হস্তক্ষেপ করবে না। সার্চ কমিটি যে নামগুলো দেবে সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। রাষ্ট্রপতির এর বাইরে থেকে কারো নিয়োগ দেবে না। এই সার্চ কমিটির ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আশা করি, সরকার তাদের কাজে কোন হস্তক্ষেপ করবে না। তারা যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দেবে।
×