ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এম শামসুর রহমান

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ স্মৃতিতে ভাস্বর নোবেলজয়ী আবদুস সালাম

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ স্মৃতিতে ভাস্বর নোবেলজয়ী আবদুস সালাম

আজ ৩১ জানুয়ারি। এ উপমহাদেশের অসাধারণ প্রতিভা নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালামের ৯১তম জন্মবার্ষিকী। প্রফেসর সালামের জন্মদিবস তাই বিজ্ঞান জগতের আনন্দের দিন। আবদুস সালাম ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনিই প্রথম পাকিস্তানী যিনি নোবেল জয়ের খ্যাতি অর্জন করেন। বিজ্ঞান সাধনা ও গবেষণায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আদম্স পুরস্কারসহ তিনি বহু পুরস্কারের গৌরবে ম-িত হন। ১৯২৬ সালের ৩১ জানুয়ারি আবদুস সালাম তৎকালীন ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জং শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪৬ সালের গণিতে এমএ। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী অর্জনে র‌্যাঙলার (ৎিধহমষবৎ) হওয়ার দুর্লভ কৃতিত্বেরও অধিকারী তিনি। এই সূত্রে প্রফেসর সালাম গণিত শিক্ষায় রেখেছেন সৃজনশীল মেধার স্বাক্ষর। গণিতচর্চায় ছিলেন শতাব্দীর অন্যতম প্রধান পুরুষ। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রীপ্রাপ্ত হন। ঋজঝ-এ ভূষিত হন। আবদুস সালাম লাহোর সরকারী কলেজ ও ক্যামব্রিজে অধ্যাপনা করেন। এরপর লন্ডন ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজিতে ৩১ বছর বয়সে ১৯৫৭ সালে তিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর নিয়োগ পান। ১৯৬৪ সালে তারই নিরলস প্রচেষ্টায় ইতালির ত্রিয়েস্তে আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে নব্বইয়ের দশকের প্রথমভাগ পর্যন্ত কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন পরিচালক পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীকালে সভাপতির দায়িত্বে থাকেন। তার মৃত্যুর পর এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে ঞযব অনফঁং ঝধষধস ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈবহঃৎব ভড়ৎ ঞযবড়ৎবঃরপধষ চযুংরপং. বাংলাদেশে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে আবদুস সালাম দৃষ্টিগ্রাহ্য অবদান রাখেন। এই বিশ্ববরণ্যে বিজ্ঞানীর অকৃপণ সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে (১৯৮৮)। পদার্থবিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৩ সালের ২৩ মে কার্জন হলের সম্মুখস্থ উদ্যানে তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রী প্রদান করে। প্রফেসর সালাম ছিলেন হুইল চেয়ারে উপবিষ্ট। ওই বছরই প্রফেসর সালামের শেষ বাংলাদেশ সফর। ত্রিয়েস্তের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে বহুবিধ কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছে। অধিকন্তু খড়হম ঃবৎস ঠরংরঃরহম গধঃযবসধঃরপরধহ (১৯৯০) ও অংংড়পরধঃব সবসনবৎ (১৯৯০-৯৫) হিসেবেও সেখানে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এভাবেই ওই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় দেড় দশককালের আমার নিবিড় যোগসূত্র। এক সত্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রফেসর সালামের মানসিকতা ও মহত্ত্বের যে লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এখানে তা তুলে ধরা থেকে বিরত থাকতে পারছি না। ১৯৮৩-এর আগস্ট। ত্রিয়েস্তের এক কর্মসূচীতে আমি যোগদান করেছি। সঙ্গে ছিলেন আমার সহকর্মী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহকারী প্রফেসর (বর্তমানে প্রফেসর) সত্রাজিৎ কুমার সাহা। প্রফেসর সালাম এক মনোরম অপরাহ্ণে যোগদানকারী বাংলাদেশী, ভারতীয় ও পাকিস্তানী বিজ্ঞানীদের চায়ের আমন্ত্রণ জানালেন। আমিও সে আমন্ত্রণ রক্ষা করি। বৈঠকে নোবেল বিজ্ঞানীকে একজন একটি প্রশ্ন করেন। তিনি স্মিতহাস্যে ও অসঙ্কোচে বললেন : ঝড়ৎৎু, ও ফড় হড়ঃ শহড়ি ঃযরং ঃযরহম. কেউ সর্ববিদ্যা বিশারদ নন। তাই প্রকৃত জ্ঞানতাপসের মধ্যেই এ ধরনের অকপট স্বীকার সম্ভব। বিদেশে কয়েকবার প্রফেসর সালামের সাহচর্যে এসেছি। আজও মনে পড়ে আমি ও কয়েকজন বিজ্ঞানী তার অফিস কক্ষে ১৯৯০-এর এপ্রিলে ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ আদায় করেছি। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কিছুকাল অক্সফোর্ডে বসবাস করতেন। ১৯৯৩-এর আগস্টে আবদুস সালাম অক্সফোর্ড থেকে দু’চারদিনের জন্য ত্রিয়েস্তে তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানে এলেন। জাহাঙ্গীরনগরের গণিতের আমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকজন শিক্ষক তার সঙ্গে কুশল ও শুভেচ্ছা বিনিময় করি। সে সময় তিনি প্রায় বাকশক্তিহীন ও চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। তার মায়াবি মুখখানার দিকে তাকিয়ে আমারও মন বিষণœœতায় ভরে উঠল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ গণিত সমিতি আয়োজিত পঞ্চম গণিত সম্মেলনের (২৭-২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৬) প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে ও সম্মেলনের সাফল্য কামনায় প্রফেসর সালাম সমিতির তদানীন্তন সভাপতি প্রফেসর এস এম শরফুদ্দিনের (মৃত্যু : ২৬ জানুয়ারি ২০১০) কাছে তার পত্রের উত্তর পাঠান ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬। নোবেল বিজ্ঞানীর সেই প্রেরণাদায়ক ও উৎসাহব্যঞ্জক পত্রটি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পঠিত হয়। উল্লেখ্য, ওই গণিত সম্মেলনের আমি ছিলাম সংগঠন সম্পাদক। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে প্রায় জনাবিশেক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সমিতির সম্পাদক প্রফেসর আ ফ ম খোদাদাদ খান সম্মানিত প্রতিনিধিদের দেখভালের দায়িত্বে থাকেন। গণিত সমিতির সঙ্গে যোগসম্পর্কের স্মারক হিসেবে প্রফেসর সালামের পত্র আমাদের কাছে এক অতিমূল্যবান সম্পদ। আমার সম্পাদনাকালে সমিতির মুখপত্র ‘গণিত পরিক্রমা’ ৭ম খ- ১৯৯৭ এবং ১৬শ খ- ২০০৬-এ পত্রটি মুদ্রিত হয়েছে। ২৭শ’ খ- ২০১৭-তে বিশেষ অবস্থায় এটি প্রকাশ হতে যাচ্ছে। ১৯৯৬ এর ২১ নবেম্বর অক্সফোর্ডে প্রফেসর সালাম ইন্তেকাল করেন। মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এবং শোকার্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে আমি একটি বার্তা প্রেরণ করি। আবদুস সালাম তনয় আহমেদ সালাম লন্ডন থেকে সে শোকবার্তার প্রত্যুত্তর দেন ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৬-এ। শোকে মুহ্যমান সন্তানের নিজস্ব মননে লেখা চিঠি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তাই সম্পাদক হিসেবে ২০০৫ গণিত পরিক্রমা ১৫শ’ খ-ে ওই চিঠিও পত্রস্থ করেছি। ২০১৭ গণিত পরিক্রমা ২৭শ’ খ-েও এটি দৃষ্ট হবে। সুঠামদেহী শ্মশ্রƒম-িত পুরুষ আবদুস সালাম ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষ। এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, মনস্বী শিক্ষাবিদ আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি তেমন দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। কিন্তু জীবন সংগ্রামে জয়ী হন। আর জয়ী হয়েছেন বিজ্ঞানের জন্য ভালবাসায় উজ্জীবিত কর্মের সাধনায়। তার কর্ম, তার জীবনদর্শন আমাদের কাছে উজ্জ্বল ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রইবে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুস সালামকে আজ আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি। নিবেদন করছি তার প্রতি আমাদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ গণিত সমিতি
×