ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্ব শান্তি কামনায় শেষ হলো বিশ্ব এজতেমা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্ব শান্তি কামনায় শেষ হলো  বিশ্ব এজতেমা

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গীর বিশ^ এজতেমা ময়দান থেকে ॥ টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি লাভের আশায় মহান আল্লাহতায়ালার দরবারে অশ্রুসিক্ত নয়নে দুই হাত তুলে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আমিন, আল্লাহুমা আমিন, ছুম্মা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের ৫২তম বিশ্ব এজতেমা রবিবার শেষ হয়েছে। মোনাজাতে লাখ লাখ মুসল্লি নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং কেঁদে বুক ভাসান। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি ও কামনা করা হয়। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। আগামী বছর (২০১৮ সালের) বিশ^ এজতেমার প্রথম পর্ব ১২ জানুয়ারি শুরু হবে এবং ১৪ জানুয়ারি শেষ হবে। এরপর ৪ দিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ১৯ জানুয়ারি শুরু হবে এবং তা শেষ হবে ২১ জানুয়ারি। রবিবার বেলা ১১টা ১১ মিনিট থেকে ১১টা ৪৩ মিনিট পর্যন্ত ৩২ মিনিট স্থায়ী মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লীর হযরত মাওলানা সা’দ আহমেদ। তাৎপর্যপূর্ণ এই আখেরি মোনাজাতে জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তি, আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। রবিবার আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে সূর্য উদোয়ের পূর্ব থেকে শুরু হয় এজতেমা মুখী ধনী-দরিদ্র যুবক বৃদ্ধ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের ঢল। যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় গাড়ি না পেয়ে হেঁটে মুসল্লিরা ধাবিত হয় এজতেমা ময়দানে। অগণিত মুসল্লি এজতেমা এলাকার বিভিন্ন সড়ক, মিল কারখানা ও বাড়ির ছাদে বসে মোনাজাতে অংশ নেন। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মোনাজাতে শরিক হন। গত বছর হতে দেশের সবক’টি জেলাকে চার ভাগে বিভক্ত করে বিশ্ব এজতেমাকে চার পর্বে ভাগ করে আয়োজন করায় এবারের এজতেমায় মুসল্লিদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম হলেও আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে রবিবার এজতেমাস্থলের চারপাশের ৩-৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মোনাজাতের জন্য রবিবার আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন। গত ১৩ জানুয়ারি শুরু হয় তবলীগের মিলনমেলা এবারের ৫২তম বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব। এরপর চারদিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে দু’পর্বের এবারের বিশ্ব এজতেমা শেষ হয়। আগামী বছর ১২ জানুয়ারি এজতেমা শুরু ॥ আগামী বছরের (২০১৮ সালের) বিশ্ব এজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বৃহ¯পতিবার বিশ্ব এজতেমার ময়দানে দেশ-বিদেশের মুরব্বিদের পরামর্শ বৈঠকে (মাশওয়ারায়) আগামী বিশ্ব এজতেমা ও জোড় এজতেমার তারিখ চূড়ান্ত করা হয়। বিশ্ব এজতেমার মুরুব্বি প্রকৌশলী মোঃ গিয়াস উদ্দিন জানান, ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হবে এবং তা শেষ হবে ১৪ জানুয়ারি। এরপর চারদিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব এজতেমা শুরু হবে ১৯ জানুয়ারি এবং তা শেষ হবে ২১ জানুয়ারি। এজতেমার প্রতি পর্বই আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে। এছাড়াও প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও টঙ্গীতে জোড় এজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সাধারণত বিশ্ব এজতেমার কমপক্ষে ৪০ দিন আগে জোড় এজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালের বিশ্ব এজতেমাকে সফল করার লক্ষ্যে পাঁচদিনের জোড় এজতেমা শুরু হবে চলতি বছরের ১৭ নবেম্বর এবং তা ২১ নবেম্বর আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে। জোড় এজতেমায় তবলীগের সব সাথীরা অংশগ্রহণ করতে পারেন না। কমপক্ষে তিন চিল্লার সাথীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ জোড় এজতেমা। তিন চিল্লার সাথীদের মধ্য থেকে কিছু অংশ বিশ্ব এজতেমার আয়োজনে টঙ্গীর এজতেমার ময়দানে কাজে যোগদান করেন। স¤পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে এজতেমা ময়দানের যাবতীয় কাজ স¤পন্ন করেন তারা। আর বাকি সাথীরা বিশ্ব এজতেমার দাওয়াত নিয়ে ময়দানে বেরিয়ে পড়েন। এবার বাদপড়া ৩২ জেলার মুসল্লিরা আগামী এজতেমায় অংশ নেবেন ॥ এ বছর দেশের যে ৩২ জেলা এজতেমায় অংশ নেয়া থেকে বাদ পড়েছে সেসব জেলাগুলো আগামী ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব এজতেমায় অংশ নেবে। তবে প্রতি পর্বেই ঢাকার মুসল্লিরা অংশ নেবেন। জেলাগুলো হলো- পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, শেরপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, বগুড়া, জামালপুর, রাজশাহী, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুড়া, ফরিদপুর, কুমিল্লা, নড়াইল, মাদারীপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, খুলনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রাম জেলার মুসল্লিরা। কনফারেন্সে মোনাজাত ॥ এজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। টঙ্গীর এজতেমাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে কনফারেন্সের মাধ্যমে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মসজিদের মাইকে আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করা হয়। এখানে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ঈদগাহ মাঠে এবং পার্শ্ববর্তী সড়কে ও ভবনগুলোতে জড়ো হয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকায় টেলিভিশন, ওয়্যারলেস সেট ও মুঠোফোনের মাধ্যমে মোনাজাত প্রচার করা হয়। মোনাজাত শেষে যানজট ॥ মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে আবারও হেঁটে রওনা দেয় মুসল্লিরা। আর হাঁটা মুসল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসল্লিদের যানবাহন রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থাকে এজতেমা মাঠের আশপাশের এলাকায়। মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ॥ আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মহিলা মুসল্লিও আগের দিন রাত থেকে এজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসাবাড়িতে ও বিভিন্ন ভবনের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। আবার অনেকে নদীর পাড়ে বা আশপাশে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেন। দ্বিতীয় পর্বে চার হাজার জামাত তৈরি ॥ বিভিন্ন দেশে তবলীগের কাজে বের হতে এবার এজতেমা স্থলে দ্বিতীয় পর্বে দেশীয় প্রায় ৩ হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে এজতেমা আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। আখেরি মোনাজাত শেষে এসব মুসল্লিগণ জামাতবন্দী হয়ে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে গিয়ে রিপোর্ট করবেন। পরে তবলীগের মুরুব্বিদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তারা জামাতবন্দী হয়ে দ্বীনের দাওয়াতী মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাতে কেউ কেউ এক, দুই, তিন, চার, ছয় ও এক বছরের চিল্লা, এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। এছাড়া প্রায় এক হাজারের মতো বিদেশী জামাত তৈরি হয়েছে। প্রথম পর্বে প্রায় চার হাজার জামাত তৈরি হয়েছে। আগামী ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে সূত্র জানায়। নজিরবিহীন নিরাপত্তা ॥ এবারের বিশ্ব এজতেমায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ৬ হাজারের অধিক পুলিশের পাশাপাশি পোশাকে ও সাদা পোশাকে র‌্যাব, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। ময়দানে মুসল্লিরা ময়দান ত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা মোতায়েন থাকবেন বলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন। এছাড়াও আকাশ ও নৌপথের পাশাপাশি সড়ক পথগুলোতে খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার দিয়ে মুসল্লিসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে এজতেমাস্থলে স্থাপিত পুলিশ ও র‌্যাবের পৃথক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মনিটরিং করা হয়েছে। পকেটমার আটক ॥ টঙ্গী থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, বিশ্ব এজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা থেকে রবিবার বেশ কয়েকজন হকার ও পকেটমার আটক করা হয়েছে।
×