ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাত খুন মামলার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ

বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭

বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে

আরাফাত মুন্না/ মোঃ খলিলুর রহমান ॥ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র‌্যাবের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তবে র‌্যাবের কিছু উচ্চাভিলাষী সদস্য এবং সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে সাত খুনের ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে এ ধরনের উচ্চাভিলাষীরা না আসতে পারে, নিয়োগের সময় সে বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে। নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এমন মন্তব্য করেছেন। রায়ে আদালত বলেন, কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও কাউন্সিলর নূর হোসেনের দ্বন্দ্বের শুরু এলাকায় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করেই। একজন প্যানেল মেয়র নজরুলকে হত্যা করতে গিয়ে নিরীহ ছয়জন মানুষ এসব র‌্যাব ও নূর হোসেন বাহিনীর নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতকারী ও কিছুসংখ্যক রাজনীতিক-সন্ত্রাসীদের দ্বারা এ হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। রায়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের চিত্র উঠে এসেছে। গত সোমবার নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২৬ জনকে মৃত্যুদ- দিয়ে এ রায় ঘোষণা করেন। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার বাকি ৯ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেন বিচারক। দ-প্রাপ্ত ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের সদস্য, যার মধ্যে ১৬ জন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। দুটি মামলায় ১৬৩ পৃষ্ঠা করে মোট ৩২৬ পৃষ্ঠা রায় লিখেছেন বিচারক। পুরো রায়টিই ইংরেজীতে লেখা হয়েছে, যদিও নিম্ন আদালতের রায় বাংলায় লেখার বিধান রয়েছে। এদিকে রবিবার রায়ের অনুলিপি প্রকাশের পর রায় এবং অন্যান্য নথি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। রবিবার দুপুরে এসব নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছেছে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ। সাত খুন মামলার রায়ের পর্যবক্ষেণে আদালত বলেছেন, এখানে যেমনি নূর হোসেন একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও গডফাদার। অপরদিকে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ দুজনের দ্বন্দ্বের জের ধরে এ হত্যাকা-টি সংঘটিত হয়েছে। একজন প্যানেল মেয়র নজরুলকে হত্যা করতে গিয়ে নিরীহ ৬ জন মানুষ এসব র‌্যাব ও নূর হোসেন বাহিনীর দ্বারা নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। রায়ে আদালত বলেন, অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্যেই নূর হোসেন ও নজরুল ইসলামের দ্বন্দ্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। মূলত ১৯৯৭ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জয়-পরাজয় নিয়ে এবং শিমরাইল মোড়ে অবস্থিত সড়ক ও জনপদ বিভাগের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়েই দু’জনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেন দুজনই নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। নজরুল ২ ও নূর হোসেন ৪নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী একে অপরকে মেরে ফেলতে একাধিকবার চেষ্টা করেছেন। দুজনের দ্বন্দ্বে তিনজন এর আগে তিনজন প্রাণ হারিয়েছে। সাক্ষীদের বক্তব্য তুলে ধরে আদালত বলেন, সাত খুনের ঘটনার চার মাস আগে থেকে নজরুল ও নূর হোসেনের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। কেউ কাউকে ছাড় দিতেন না। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২নং ওয়ার্ডে একটি রাস্তা প্রশস্তকরণ নিয়ে চূড়ান্ত বিরোধ। রায়ে আদালত বলেন, সাক্ষীদের জবানবন্দী ও প্রদত্ত নথিপত্র থেকে উঠে এসেছে র‌্যাব-১১ এর তৎকালীন সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে নূর হোসেন ও নজরুল দুজনেরই ভাল সম্পর্ক ছিল। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নজরুলের গতিপথ নূর হোসেনই র‌্যাবের সদস্যদের নিশ্চিত করে। রায়ের পর্যবেক্ষণে র‌্যাবের বিষয়ে বিচারক বলেন, র‌্যাব একটি শৃঙ্খলিত বাহিনী। এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত। দেশের কল্যাণে এ বাহিনীর অনেক সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী থেকে শুরু করে জঙ্গী দমন, মাদক নির্মূলসহ বিভিন্ন অর্জন রয়েছে এ বাহিনীর। কিন্তু এ শৃঙ্খল বাহিনীর কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল সদস্য সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মিশে এ হত্যাকা- ঘটিয়েছেন। এ হত্যাকা-ের দায় শুধু এসব বিপথগামী সদস্যদেরই, গোটা বাহিনীর নয়। রায়ে আদালত বলেন, র‌্যাবে ওইসব সদস্যরা উচ্চাভিলাষিতার জায়গা থেকে ঘৃণ্যতম এ অপরাধটি সংঘটিত করেছে। তাদের দ্বারা র‌্যাবের সম্মান সাময়িকভাবে ক্ষুণœ হলেও মামলা পরিচালনার সময় র‌্যাবের সহযোগিতায় সার্বিকভাবে বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ অক্ষত রয়েছে। আদালত আরও বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র‌্যাবের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তবে পুলিশের এই এলিট ফোর্সে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপথগামীরা অন্তর্ভুক্ত না হতে পারে, সে জন্য নিয়োগের সময় সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে। রায়ে আদালত বলেন, ৭ খুনের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৫ জনকে হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে একটি মামলা এবং নিহত এ্যাডভোকেট চন্দন সরকার ও তার গাড়ির চালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় তার জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে অপর একটি মামলা দায়ের করেছেন। দুটি মামলার সাজা একই। আদালত বলেন, দুটির মামলার রায় হলেও তারা সাজা ভোগ করবেন এক সাথে। একইদিন থেকে সাজার গণনা শুরু হবে। যারা পলাতক আছেন তারা গ্রেফতারের দিন থেকে অথবা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্থন করলে সেদিন থেকে তাদের সাজা গণনা শুরু হবে। পিপির ব্রিফিং ॥ রায়ের নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানোর আগে রবিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেস কনফারেন্স রুমে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট এসএম ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সময় যে সমস্ত অভিযোগ এনেছিলাম সেই অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করেছেন। যারা এই হত্যাকা-ের শুরু থেকে শেষ অবদি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত সেই ২৬ জনকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করেছেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে ৭ জনকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০ বছর করে কারাদ- এবং ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। অন্য দুই জনকে আলামত নষ্ট ও ধ্বংস করার চেষ্টার অভিযোগে ৭ বছর করে সশ্রম কারাদ- এবং ২৫ হাজার টাকা করে অর্থদ- করা হয়েছে। এ রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। সাত খুনের বাদী বিউটির বক্তব্য ॥ সাত খুনের ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলার বাদী নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি রবিবার দুপুরে আদালতে এসে সাংবাদিকদের বলেন, যারা খুনি তারা অনেক বড়মাপের এবং প্রভাবশালী লোকজন। তারা অনেক পয়সাওয়ালা লোক। নূর হোসেন ফাঁসির দ-প্রাপ্ত। কিন্তু নূর হোসেনের সাঙ্গোপাঙ্গরা এখনও এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার সবকিছুই চলছে। তার লোকজনের কারণে আমরা এখন আতঙ্কগ্রস্ত। নূর হোসেনের সকল ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করা হোক।
×