ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

দাদাবাদ-অপ্রস্তুত বিষয়ের নির্ভীক উপস্থাপনা সুমাইয়া ইসলাম নিপা

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ২০ জানুয়ারি ২০১৭

দাদাবাদ-অপ্রস্তুত বিষয়ের নির্ভীক উপস্থাপনা সুমাইয়া ইসলাম নিপা

শিল্প বা আর্ট হলো শিল্পীর মনের অব্যক্ত কথা ও চিন্তা ভাবনার পরিশীলিত পরিপাট্য সাযুজ্যপূর্ণ সুন্দর সাবলীল উপস্থাপন। যা দর্শকের মনকে আনন্দ, চোখকে শান্ত ও প্রশান্তির বহমানতায় ভিজিয়ে দেয় হৃদয়কে। শিল্প চির সত্য সুন্দর। কখনো তা বিষয়ের হুবহু উপস্থাপন কখনো বা তাতে বিমূর্ততার খোলশ দৃশ্যায়িত হয়। আবার কখনো শিল্পীর কল্পনার জগত প্রস্ফুটিত হয় তার শিল্পকর্মে। রং, রেখা, উপাদানের মার্জিত সুষ্ঠু স্বাভাবিক উপস্থাপনই হলো শিল্প। আর এই শিল্পের প্রতিটি অংশ জুড়ে থাকে কোন না কোন অর্থ। অর্থাৎ অর্থবাহী হয়ে থাকে প্রতিটি শিল্প। বাস্তবধর্মী শিল্পগুলোর অর্থ দর্শকের কাছে সহজবোধ্য কিন্তু বিমূর্ত শিল্পগুলো তা নয়। তবে বিমূর্ত শিল্পগুলো আবার অর্থহীনও নয়। দর্শকের কাছে এর বোধগম্যতা সহজ নয় কিন্তু শিল্পী তার বিমূর্ত শিল্পের ব্যাখ্যা দিলেই স্বচ্ছ দর্পণের ন্যায় দৃশ্যায়িত হয় অন্তর্নিহিত অর্থাদর্শ। শিল্প কখনো বাস্তববাদী আবার কখনো স্বপ্নীল। ধারাবাহিক এই গ-িকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আবির্ভাব ঘটে দাদাবাদের। বিশ্ব শিল্পের ইতিহাসে এটি ব্যতিক্রমী আন্দোলন। গধবাঁধা নিয়মের দেয়ালকে ভেঙে বন্দিত্বদশার মুক্তির নিমিত্তেই এ আন্দোলনের জন্ম। শিল্পকর্ম ও সাহিত্যের প্রতি প্রচ- বিক্ষুব্ধতার প্রতিক্রিয়া হলো দাদাবাদ। অগতানুগতিক উদ্ভট কাজ দ্বারা মনকে আঘাত দেয়াই যার প্রধান উদ্দেশ্য। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত শিল্পের যে দর্শনগত ধারণা মনে ধারণ করে চলছিল তার বিরোধিতা সঙ্গে বিদ্রƒপাত্মক ক্রিয়াকলাপে ঐতিহ্যের ধ্বংস সাধনের মধ্য দিয়ে দাদার উদ্ভব। যার নামকরণ করেন মাদাম লে রয়। দাদা শব্দটির ফ্রেঞ্চ অর্থ খেলনা ঘোড়া, খেয়ালীপনা অব্যক্ত শব্দ যার কোন অর্থ নেই বা কাঠের ঘোড়া। দা দা এর রোমানীয়ান অর্থ হ্যাঁ হ্যাঁ। তবে খেয়ালীপনা শব্দটিই অধিক গ্রহণযোগ্য। এটি শিল্প সাহিত্যের পরম্পরাগত ধারাবাহিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আচার আচরণের নৈতিকতার বিনাশ ঘটায়। যা কিছু তথাকথিত সুন্দর বা সুন্দরের প্রচারণা তার বিরুদ্ধেই দাদাবাদের অবস্থান। এজন্যই একে এন্টি আর্ট মুভমেন্টও বলা হয়। ফলে যা খুশি তা করাই দাদাবাদ। ১ম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সমস্ত বিভীষিকাময় নৈরাজ্য আর অব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ ঘৃণা প্রকাশের নিমিত্তেই এর সূত্রপাত। তখন যুদ্ধের অরাজকতা ও বীভৎষতা এবং ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য থেকে নিস্তারের নিমিত্তে অনেক কবি শিল্পী সাহিত্যিক যুদ্ধ নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ডের জুরিখে চলে আসেন। ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যাবারেট ভলটেয়ার নামক স্থানে কবি ত্রিস্তান জারা দার্শনিক ও সাহিত্যিক হুগোবেল, কবি ও চিকিৎসক রিচার্ড হেল্সেন বেক, শিল্পী হানস আর্প, হানস রিখটার, মার্সেল ডুসাম্প পিকাবিয়াসহ অনেকের সহযোগে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিল্পী, সাহিত্যিক, মিউজিশিয়ান সকলে মিলে ‘দাদা ফেয়ার’ নামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এই ক্যাবারেটে। এখানে তারা শব্দ করে থেমে থেমে মিউজিক বাজিয়ে লোকজনকে বিরক্ত করে এক রকমের অনুষ্ঠান করতেন। যা ছিল মূলত যুদ্ধবিরোধী মনোভাব নিয়ে তৈরি সম্পূর্ণ নতুন শিল্প আন্দোলন। দাদাকে শুধু যুদ্ধবিরোধী বলা ভুল হবে এটা প্রচলিত শিল্প জগতের সকল ধ্যানধারণা যুক্তি নান্দনিকতার শিকায় আগুন লাগিয়ে শিল্পকে ক্ষতবিক্ষত করে আবেগের প্রকাশ ঘটিয়েছেন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। দাদা শিল্পীদের কাছে আদর্শায়িত উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য শিল্পে অর্জিত ঐতিহ্য পুরোটাই অপ্রয়োজনীয় এবং পরিমাণহীন মনে হয়েছে। অযথাই নিয়মের শিকলে আবদ্ধ রেখেছে শিল্পীরা নিজেদের তাইতো সুসংঘবদ্ধ নীতিমালাটি ছিড়ে ফেলেই যা ইচ্ছা তাই করে উন্মাদনায় উন্মক্ত হয়েছেন এ আন্দোলনে জড়িত শিল্পীরা। যুক্তি, দর্শন, সৌন্দর্যকে প্রত্যাখ্যান করল সুশৃঙ্খল দর্শনতৃপ্ত কর্মই শিল্প না। যে কোন কিছুই শিল্পে পরিণতি পেতে পারে আর যে কেউই শিল্পী হতে পারে। যা কিছু স্বাভাবিক তার বিরোধিতাই দাদাবাদের ধর্ম। সব কিছুকেই অতর্কিত আক্রমণ করে বসলেন এ আন্দোলনের শিল্পীরা। কোলাজ, ফটোমন্ডাজ, এসেমব্লেজ রেডিমেডস্ প্রভৃতি পদ্ধতিগুলোই অবলম্বন করেছিল এ সময়ের শিল্পীরা। কখনো একটি লোহার ইস্ত্রির নি¤œাংশে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চৌদ্দটি পেরেক লাগিয়ে দিলেন এবং নাম দিলেন উপহার। আবার কাঠ এবং কলাই করা লোহা দিয়ে বানিয়েছেন বেলচা। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা বিখ্যাত মোনালিসা চিত্রকর্মটির সস্তা পোস্টার কার্ড এর ওপর দাড়ি গোঁফসহ উপস্থাপন ঘটালেন কালজয়ী মোনালিসাকে। আবার কখনো মোনালিসার মাথার অংশে স্থান পেয়েছে বিড়ালের লোমশ মাথা। এই মোনালিসাকেই আবার সুরক্ষা মাস্ক পরিহিত করে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। এ সময় দাদাবাদী শিল্পীরা কেউ আবার জার্মানি সরকারের সমালোচনার নিদর্শনস্বরূপ বিভিন্ন খবরের কাগজ থেকে ছবি কেটে কেটে এলোমেলোভাবে সংযোজন করেন যাতে বাস্তবতা ও কাল্পনিকতার বিকৃত উপস্থাপন ঘটে। লোমশ অবয়বে কাপ, পিরিচ এবং চা চামচের উপস্থাপনও ঘটিয়েছেন এ সময়ের শিল্পীরা। মানব ফিগারের কোমর থেকে নি¤œাংশ প্যান্ট পরিহিত অবস্থার পেছনের অংশ দৃশ্যত হিপের দু’পাশে মানব কর্ণ দিয়ে সাজিয়েছেন শিল্পপটকে। এসেমব্লেজ মাধ্যমে নকল ডামির শির তাতেই শিল্পী সংযুক্ত করেছে স্কেল, পকেট ঘড়ি, টাইপরাইটার, ক্যামেরার খন্ডাংশ, মানিব্যাগ প্রভৃতি বস্তু। যাতে দার্শনিক হেগেলের তত্ত্বের প্রভাব সুস্পষ্ট। এ সময়ের প্রথম দিকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ‘ফাউন্টেন’ একটি পূর্ব নির্মিত পেরসিলিনের মূত্রাশয়কে স্টুডিওতে বসিয়ে দিয়ে শিল্প কি তাকেই যেন আক্রমণ করেছিলেন ডুসাম্প। দাদাবাদী শিল্পীদের উদ্ভট উপস্থাপনার পাগলামী আরও ভালোভাবে প্রকাশ পায় তাদের ঐ চিত্র প্রদর্শনীতে যেখানে দর্শকদের জন্য গ্যালারীতে হাতুড়ি রাখা। প্রর্দশনীর যে কোন একটি শিল্পকর্ম হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করবে আগত দর্শকবৃন্দ। মূলত দাদাবাদী শিল্পীরা যে শিল্পের প্রতি বৈরাগ্য মনোভাব ধারণ করেছিলেন তার প্রমাণ রেখে গেছেন তাদের নির্মিত প্রতিটি শিল্পকর্মে। যে সকল বিষয়বস্তু কখনো কল্পনাতেও আসেনি যে তা শিল্পে পরিণতি পেতে পারে তারই সহজভাবে কিন্তু কট্টরপন্থী উপস্থাপন ঘটেছে এই আন্দোলনের শিল্পগুলোতে। অপ্রস্তুত বিষয়ের যে নির্ভীক উপস্থাপনা তার দুঃসাহসিকতা দাদাবাদী শিল্পীরাই দেখাতে পারে। দাদাবাদকে এক ধরনের প্রতিশিল্পও বলা যায়। জাতীয় বুর্জোয়া ভাবধারা ও ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরোধী ছিল দাদাবাদী চিন্তাচেতনা। দাদাবাদে অবচেতন মনের গুরুত্ব না থাকলেও এই আন্দোলনটির অবস্থান ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে- যে কারণে মানবিক।
×