ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটিশ নাম্বারে ছয় বছর ঢাকার রাজপথে বিএমডব্লিউ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

ব্রিটিশ নাম্বারে ছয় বছর ঢাকার রাজপথে বিএমডব্লিউ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গাড়ির নেমপ্লেটে বিদেশী নাম্বার। তাতেও সমস্যা হয়নি। ট্রাফিক সার্জেন্ট বা অন্য কোন সদস্যের চোখে পড়েনি কখনই। নির্বিঘেœ রাজধানীতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই বিলাসবহুল গাড়িটি। অথচ এই নাম্বারটি দেখেই সন্দেহ জাগে শুল্ক গোয়েন্দার। সে সন্দেহ দূর করতেই চলে নজরদারি। শেষ পর্যন্ত বুধবার ধরা পড়ে গাড়িটি। এ ঘটনায় চলছে তোলপাড়। রাজধানীর বনানীতে এক ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে বিলাসবহুল বিএমডব্লিউ এক্স ৫ গাড়িটি জব্দ করা হয়। পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণাদি হাতে নিয়েই শুল্ক গোয়েন্দার দল মঙ্গলবার গভীর রাতে বনানীর রোড ২৫এ, হাউস নাম্বার ৪৬ এর ‘আকাশপ্রদীপ’ নামক বাড়ির বেসমেন্টে হানা দেয়। সেখানেই আটক করা হয়। এ সময় গাড়ির সিজার লিস্ট তৈরি করে জব্দ করা হয়। এ সময় দেখা যায়- গাড়িটি পেছনে ‘অদ্ভুত নাম্বার প্লেট লাগানো। এ নাম্বার দিয়েই গাড়িটি ঢাকার রাজপথে দাপিয়ে চলছিল গত ছয় বছর ধরে। গোয়েন্দারাও এই সূত্রেই নজরদারির পর এই অভিযান চালান। আটকের সময় প্লেটে ওয়াইএফ-০৫পিভিটি লেখা ছিল। নাম্বারের আগে ঢাকা লেখা। এটি কালো প্লেটে লেখা ছিল। প্রতারণার জন্য এটি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়- এই নাম্বারটি যুক্তরাজ্যের। ঢাকায় আনার পরও তিনি তা পরিবর্তন না করেই ঢাকায় চালাতেন। গাড়ির চেসিস নং ডব্লিউ বি এফএ -১২০১০ এল ডব্লিউ ০৬৮৮২, ৩০০০সিসি, এমএফজি, ২০০৫। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়Ñ গাড়িটি কারনেট সুবিধায় ২০১১ সালে এদেশে আনা হয়েছিল। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের এক ফেসবুক পোস্টে জানানো হয়, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মুহসিন আলম ২০১১ সালে কারনেট সুবিধায় গাড়িটি আমদানি করেন। সে সময় কাগজপত্রে বলা হয়েছিল, এর মূল মালিক যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে পর্যটকদের বিশেষ সুবিধার সুযোগে (কার্নেট ডি প্যাসেজ) তিনশ’র বেশি বিলাসবহুল গাড়ি বাংলাদেশে আসে বলে জানান শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালক ড. মইনুল খান। তিনি বলেন, এসব গাড়ির অর্ধেক ফেরত গেলেও বাকিগুলো রয়ে গেছে। যার অনুসন্ধানে নেমে মাঝেমধ্যেই বিলাসবহুল বিভিন্ন গাড়ির খোঁজ পাচ্ছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। আন্তর্জাতিক একটি সনদ অনুযায়ী যে সুবিধায় পর্যটকরা একটি দেশ থেকে অন্য দেশে শুল্ক না দিয়েই গাড়ি নিয়ে ঢুকতে পারেন- তাকেই ‘কার্নেট ডি প্যাসেজ’ বলা হয়। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই সুবিধা পান পর্যটকরা। এর মধ্যে তাদের সংশ্লিষ্ট দেশের অটোমোবাইল এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে হয়। নির্দিষ্ট সময় পর গাড়িটি ফেরত না গেলে ওই দেশের নিয়মানুযায়ী এর ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়। এই সুবিধা নিয়ে বিএমডব্লিউ, পোরশে, রেঞ্জ রোভার, রোলস রয়েসের মতো বহু দামী গাড়ি বাংলাদেশে ঢোকে ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশে এ সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়। কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধা ছাড়াও মিস ডিক্লারেশন (মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি) দিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। তিনি জানান, মোহাম্মদ মুহসিন আলম নামের ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কারনেট সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কারনেটের মেয়াদ শেষ হলেও তিনি তা জমা দেননি। এ বিষয়ে একাধিক নোটিস দেয়া হয়েছিল। আমদানিকালে গাড়ি ব্যবহারকারী কভেন্ট্রি, ইউকেতে বসবাসকারী হিসেবে দেখিয়েছেন। শুল্ক গোয়েন্দার সাম্প্রতিক অভিযানে তিনি বাড়ির বেসমেন্টে লুকিয়ে রেখেছিলেন। গাড়িটি আটকের সময় কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। গাড়ির মালিক মোহাম্মদ মুহসিন আলম নিজেই এই গাড়ির বর্তমান ব্যবহারকারী। তিনি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্সের ব্যবসা করেন। কারনেট সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি হওয়ায় গাড়িটি আটক করা হয়েছে। শুল্কসহ গাড়িটির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩.৫ কোটি টাকা। এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদিকে গাড়িটি কি করে এমন অদ্ভুত নাম্বার ব্যবহার করেই টানা ছয় বছর ঢাকার রাজপথে নির্বিঘেœ চলাচল করেছে তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বনানী এলাকার একজন ট্রাাফিক পুলিশ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বুধবার জনকণ্ঠকে বলেন, গাড়িটি বিলাসবহুল হওয়ায় ট্রাফিকের সাধারণ কর্মকর্তারা হয়ত কখনও সাহস করেনি। কিন্তু তাদের তো নাম্বারটি দেখে একবার হলেও মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার কথা ছিল। টানা ছয় বছর রাজধানীতে এই নাম্বারটি ব্যবহার করেই গাড়িটি চালানো হয়েছে। এটা তো অবিশ্বাস্য কা-। ঢাকায় বা বাংলাদেশে তো কখনই এ সিরিয়ালের নাম্বারের কোন গাড়ি বিআরটিএর নিবন্ধনে ছিল না। তাহলে কিভাবে চলাচল করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হতে পারে এটা দামী গাড়ি হওয়ায় ভয়ে কোন সার্জেন্ট কখনোই আটক বা রাস্তায় থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সাহস পাননি। অথবা এই নাম্বারটি সম্পর্কে তারা সত্যি সত্যিই উদাসীন ছিলেন। তবে যে কারণেই হোক এ ধরনের নাম্বার নিয়ে দেশের ভেতর একটি গাড়ি এতদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দেয়াটা উদ্বেগজনক।
×