ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বদলাচ্ছে না পাঠ্যবই ॥ হেফাজতি আদর্শ ও ভুল দুটোই থাকছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭

বদলাচ্ছে না পাঠ্যবই ॥ হেফাজতি আদর্শ ও ভুল দুটোই থাকছে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ হেফাজত জামায়াতী আদর্শে রচিত সাম্প্রদায়িক পাঠ্যক্রমই পড়তে হবে শিশুদের। ‘ওড়না চাই’ এর মতো বিতর্কিত কথা কিংবা ‘ছাগলের গাছে উঠে আম খাওয়া’র দৃশ্য থাকছেই শিশুদের নতুন পাঠ্যবইয়ে। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা ভুল সংশোধনীর কথা যতই বলুক না কেন বাস্তবে পরিবর্তনের কোন লক্ষণ নেই। নেই পরিবর্তন বা সংশোধনীর কোন উদ্যোগও। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, রাতারাতি পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন করা অসম্ভব। তবে ছোটখাটো কিছু ভুল নামকাওয়াস্তে সংশোধন করে ‘ছোট বই’ আকারে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের মাধ্যমে স্কুলে পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চিন্তা আছে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির। এদিকে মৌলবাদী পাঠ্যক্রম রচনা করায় উগ্রবাদীদের খুশি করলেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। প্রশ্নের মুখে পড়েছে সরকারের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। এবার ভুলে ভরা ও মৌলবাদী ভারধারায় পাঠ্যবই প্রকাশ হওয়ার পরই বিতর্কের মুখে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রী ও তাদের মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বিষয়টি দেখা হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরপর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি এবং এনসিটিবির পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটির প্রাথমিক সুপারিশ অনুসারে এনসিটিবির তিন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। তবে কারিকুলাম তৈরিতে নির্দেশদাতাদের বহাল রেখে কেবল সেই নির্দেশ পালনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া নিয়েও উঠেছে বিতর্ক। গত ১৫ দিন ধরে চলা তদন্ত আর নানা ঘোষণার পর এখন প্রশ্ন উঠেছে ভুল সংশোধনের দুই মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ কোথায়? এ বছর আদৌ ভুলে ভরা বইয়ের কোন সংশোধন হবে? নাকি ভুলে ভরা আর মৌলবাদী ভাবধারার বই-ই পড়তে হবে শিশুদের? পাঠ্যবইয়ের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতারাতি পাঠ্যবইয়ের পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে পাঠ্যবইয়ের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ভুল বানান সংশোধন করা হবে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা। বলেছেন, কারিকুলাম পরিমার্জন ও নতুন করে তৈরি করা দীর্ঘ সময়ের বিষয় সন্দেহ নেই।’ রবিবার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়েছে এনসিটিবিতে। যেখানে অনেক কর্মকর্তা ভুলে চিত্র অব্যাহতভাবে তুলে ধরার জন্য উল্টো গণমাধ্যমেও সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, সাংবাদিকদের বেশিই পাত্তা দেয়া হচ্ছে। এরপর সভার প্রস্তাব ওঠে যে, চলমান বিতর্ক নিয়ে চেয়ারম্যান ছাড়া কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। একই নির্দেশ এসেছে দুই মন্ত্রণালয়ের কয়েক অতিরিক্ত সচিবের পক্ষ থেকেও। বৈঠকের পর এক সদস্যকে সঙ্কট সমাধানের উদ্যোগের বিষয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান ছাড়া কারও কথা বলা নিশেষ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সদস্য বলেন, আমরা তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত আছি। এখন পর্যন্ত বই সংশোধনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে শীঘ্রই নেয়া হবে। কিভাবে সংশোধনী আসতে পারে তা জানিয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় এখনও কিছু বলেনি। তবে বিভিন্নভাবে সংশোধনী যেতে পারে। এক, সংশোধনী একটি ডিউপার্ট আকারে ছেপে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের মাধ্যমে স্কলে স্কুলে পাঠানো যেতে পারে। এছাড়া একটি গণবিজ্ঞপ্তি যেতে পারে সংশোধনী তুলে ধরে। এসব নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রাথমিক বইয়েই অধিকাংশ ভুল হয়েছে। প্রাথমিক মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোন নির্দেশনা দেয়নি। প্রাথমিকের ভুল ও মৌলবাদী বইয়ের বিষয়ে সদস্য কারিকুলাম (প্রাথমিক) সরকার আবদুল মান্নানকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনিও কথা বলতে রাজি হননি। তবে পরে তিনি সংশোধনীর বিষয়ে বলেন, আমার অংশের সংশোধনী তো আমি রেডি করে বসে আছি। কিন্তু সারাদেশে প্রতিটি শিশুদের হাতে এবার কি পাঠানো সম্ভব? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না। অথচ পাঁচদিন আগেও তিনি বলেছেন, প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ১১ পৃষ্ঠায় ‘অ’ তে অজ আসে’ ও ‘আম খাই’, সেখানে ছাগলের চিত্র ও ১৬ পৃষ্ঠায় ‘ও’ তে ‘ওড়না’ দেয়া হয়েছে; তাতে পরিবর্তন আনা হবে না। ছোট শিশুদের বর্ণ চেনার সঙ্গে মজা দিতে এসব ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে, যা দেখে ও পড়ে ছোটরা পড়ার সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করবে। স্বরবর্ণতে ‘ও’ এবং ‘অ’ দিয়ে একাধিক শব্দ ও সংযুক্ত ছবি না থাকায় তারা ছাগল ও ওড়না বিষয়গুলো নির্বাচন করেছেন। তিনি বলেন, মূলত কমিটি বইয়ের বানান ভুল, অসঙ্গতি ও তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। কিন্তু ছাগলের আম গাছে উঠে আম খাওয়ার যে ছবি নিয়ে বিতর্ক তাতে তিনি ‘অসাধারণ ছবি’ বলে তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এদিকে ছোটখাটো কিছু ভুল নিয়ে কথা আসলেও মৌলবাদী বই পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ নেই। মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির পক্ষ থেকে তিনটি কমিটি করা হলেও তাদের কাজের মধ্যে নেই এ বিষয়টিই। এসব কমিটি কেবল কিছু ভুল নিয়ে কাজ করছে জানিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ছোটখাটো কিছু ভুল হয়তো কিছুদিন পর সংশোধন করা যাবে। কিন্তু মৌলবাদীদের কথা অনুসারে যে বই শিশুদের জন্য করা হয়েছে তা জাতির জন্য ভয়াবহ ফল ডেকে আনবে। এখন পর্যন্ত একাধিক কমিটি করা হলেও এ বিষয়ে কোন কমিটি করা হয়নি এটা আরও চিন্তার বিষয়। জানা গেছে, অপ্রাসঙ্গিক তথ্য, ছবি ও তথ্য-বিভ্রাটে ভরপুর নতুন বইয়ের কারিকুলাম (পাঠ্যক্রম)। পাঠ্যবইয়ে অহেতুক ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিষয়বস্তু ফিরিয়ে আনা হয়েছে। শিশুদের বই থেকে অধিকাংশ প্রগতিশীল বিষয়বস্তু প্রত্যাহার করে এবারের নতুন পাঠ্যপুস্তকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধর্মীয় বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষানীতির বাইরে গিয়ে প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী লেখকদের গল্প, কবিতা, রচনা ও অন্যান্য সাহিত্যকর্ম পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে উগ্র ধর্মীয় সংগঠনগুলো। এছাড়াও সাহিত্য মানদ- মূল্যায়ন না করে শুধু জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভক্তিতে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘হিন্দু’ লেখকদের বেশকিছু লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। ‘হিন্দু’ হওয়ার কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সকল বই থেকে এবার এনসিটিবির চেয়ারম্যানের নামও বাদ দেয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা সামলাতে ভুল সংশোধনের জন্য নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি। এই কমিটি নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। কারণ বানান ভুল, কারিকুলামের ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করার ওই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে এনসিটিবির সদস্য (অর্থ) অধ্যাপক কাজী আবুল কালামকে। এর জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে সংস্থার দু’জন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, এই কমিটির দায়িত্ব দেয়া উচিত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, যারা ভাষা ও বানান রীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ। পাঠ্যক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র সাহা বলেছেন, স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত সবার মতামত নিয়েই পাঠ্যক্রম পরিমার্জন করা হয়েছে, নতুন বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। এখন সেগুলো পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তবে যেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আগামীতে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া যাবে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভুল বানানগুলো সংশোধন করে শীঘ্রই স্কুলে স্কুলে সাপ্লিমেন্টারি (সংশোধনপত্র) পাঠানো হবে বলে জানান বোর্ড চেয়ারম্যান। তবে তা কবে তার উত্তর নেই কারও কাছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, পাঠ্যক্রমের পরিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হলেও এবার শিক্ষাবিদদের মতামত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে তা করা হয়েছে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির বলছিলেন, আমরা এনসিসিসির (ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি) সভায় বলেছিলাম- পাঠ্যক্রমে দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সমস্ত বিষয় তুলে ধরতে হবে। নারী ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা রাখতে হবে, ধর্মের বিষয়গুলোও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে রাখতে হবে। কিন্তু পাঠ্যক্রমে উল্টো চিত্র ফুটে উঠেছে। ফিরে পেয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঠ্যক্রমের চেতনা। এক শ্রেণীর আমলা পুশিং (তদ্বির) করতে করতে পাঠ্যক্রমকে এই সরকারের চেতনার পরিপন্থী রূপ দিয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি বইয়ের পাঠ্যক্রম বুঝতে, ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ স্টাডি করা প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে এনসিসিসির সভায় খড়সা পা-ুলিপি দেয়া হয় অনুমোদনের জন্য। এতে কারো পক্ষেই এক-দেড় ঘণ্টা সময়ে তা ভালভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগেই আমলারা এবার পাঠ্যক্রমকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন আমলা শিশুদের পাঠ্যবইকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যবই মুদ্রণের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারাও গা-ভাসিয়ে দিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের আমলাতন্ত্রের নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। সাধারণত শ্রেণী শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে পাঠ্যক্রম পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও বিয়োজনের পর খসড়া তৈরি করতে হয়। এরপর এই খসড়া চূড়ান্ত করে সরকার গঠিত এনসিসিসি, পদাধিকার বলে যার সভাপতি সচিব। ২০০৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এতে পাঠ্যবইয়ে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাক্রম ও মনগড়া ইতিহাস তুলে ধরা হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় গিয়ে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে বিএনপি-জামায়াত জোটের সকল বিতর্কিত বিষয় ও তাদের রচিত ইতিহাস পরিবর্তন করে সঠিক ধারায় আনা হয় শিশু-কিশোরদের পাঠ্যক্রম। এই সংস্কারকে সর্বস্থরের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজ স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ ওই সংস্কারের মাধ্যমে পাঠ্যক্রমে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এর আলোকে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল। কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই পাঠ্যপুস্তক সেই চারদলীয় জোট সরকারের সাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরে এসেছে। এর বেশির ভাগ দায় বর্তায় এনসিটিবি, শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর। নতুন পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় সংগঠনগুলো খুশি হলেও এতে নাখোশ সরকার সমর্থক প্রততিশীল শিক্ষাবিদরাসহ প্রতিটি মানুষ। রবিবার রাজধানীতে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত দশ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বেশি ভুল ধরা পড়েছে শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেশমাত্র বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বইয়ে কেন এনসিটিবির হিন্দু চেয়ারম্যানের নাম ছাপানো যাবে না? সরকার হেফাজতের ১৩ দফা দাবিই পূরণ করেছে পাঠ্যপুস্তকে। হুমায়ুন আজাদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেখকদের লেখাও বাদ দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক শফি আহমেদ বলেন, এবারের পাঠ্যবইয়ে শুধু অবহেলা নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবহেলা আছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠী দাবি সরকারের কাছে করেছিল যাদের দাবিই পূরণ করা হয়েছে পাঠ্যবইয়ে। শিক্ষানীতি পাস হয়েছে ২০১০ সালে। সাত বছরেও প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম থেকে অষ্টমে উন্নীত করা যায়নি। শিক্ষা আইন করা হচ্ছে, যাতে ছায়াশিক্ষা (কোচিং সেন্টার) নামক ভয়ঙ্কর একটি বিষয় রাখা হয়েছে। এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অসততা রয়েছে। তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেশমাত্র বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে নেই। ড. মনজুর আহমেদ বলেন, পাঠ্যপুস্তকে এ ধরনের ভুল নতুন কিছু নয়। তবে এবারের পাঠ্যপুস্তকে ভুলের পরিমাণ ও গুণাগুণ নতুন মাত্রা পেয়েছে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশে কোন বিশেষজ্ঞ আছে বলে আমার জানা নেই। এনসিটিবিতে একটি গ্রুপ ঘাপটি মেরে আছে। যাদের কারণে প্রতি বছর পাঠ্যপুস্তকে ভুল ধরা পড়ছে। মমতাজ লতিফ বলেন, নিরপেক্ষতার নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আর বিপক্ষের বিষয় একসঙ্গে পাঠ্যবইয়ে দেয়া যাবে না। একটি বিশেষ গোষ্ঠী যে তালিকা দিচ্ছে তাই বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, পাঠ্যবই অসাম্প্রদায়িক করতে প্রয়োজনে আদালতে যাওয়া হবে। কারণ সংবিধান আমাদের পক্ষে রয়েছে। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বলেন, আমার নাতি-নাতনিরা এনসিটিবির পাঠ্যবই পড়ে। সেখানে ভুল দেখলে আমি নিজে তা ঠিক করে পড়াই। অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, চলিত আর শুদ্ধ, ছবিতে, প্রচ্ছদে, জেন্ডারে, শব্দ ও তথ্যে পর্যন্ত ভুল এবারের পাঠ্যবইয়ে। একইভাবে সূচীপত্রে, যতিচিহ্নের প্রয়োগেও ভুল। আর রয়েছে পক্ষপাতিত্বের ভুল। রয়েছে মূল্যবোধের ভুল। দুই মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের অপসারণ দাবি, আন্দোলন ॥ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ঘেরাও করা হয়েছে। তথ্য বিকৃতি করে ভুল পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে নতুন প্রজন্ম ও অভিভাবকদের বিভ্রান্ত করার ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদে রবিবার প্রগতিশীল কয়েকটি ছাত্র সংগঠন এ কর্মসূচী পালন করে। ঘেরাও কর্মসূচীতে সংগঠনগুলোর নেতারা পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্য উপস্থাপন করার কারণে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ ও জড়িত সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। রাজধানীর মতিঝিলে এনসিটিবি ভবনের সামনে ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ কয়েকটি সংগঠন অবস্থান ও সমাবেশ করেন। সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক প্রত্যাহার, বাদ দেয়া ও বইয়ে ভুল করা বিষয়গুলো তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনেরও দাবি জানান। এছাড়াও সমাবেশে আগামী ৩০ জানুয়ারি মধ্যে ভুলে ভরা বই প্রত্যাহার, মন্ত্রীদের পদত্যাগ, ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ কয়েক দফা দাবি তুলে ধরেন। এ সময় সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার বলেন, এই সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে ৩১ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করা হবে। তারপরও দাবি মানা না হলে কনভেনশন করে বৃহত্তর ও কঠোর কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। সমাবেশে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি সফিউদ্দীন অভিযোগ করেন, বইয়ে যে বিষয়গুলো এসেছে সেগুলো ভুল নয়। এগুলো পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এর দায় এড়াতে পারে না। সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকি আক্তার বইয়ে ভুল ও ‘সাম্প্রদায়িকীকরণ’ এর জন্য শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। তিনি বলেন, পাঠ্যবইয়ে ‘ন্যক্কারজনক’ বানান ভুলের প্রতিকার হিসেবে আঠা লাগিয়ে সংশোধন করার পরামর্শ শিক্ষামন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। সত্যিকার অর্থে হেফাজতে ইসলাম, ওলামা লীগ, চরমোনাই পীরসহ সকল মৌলবাদী শক্তি সরকারের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে। যার ফলাফল আমরা পাঠ্যপুস্তকে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি। অবিলম্বে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করে কোমলমতি শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়ার দাবি জানিয়ে লাকী আক্তার আগামী ১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এদিকে গণসংহতি আন্দোলন সমর্থিত ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন পাঠ্যপুস্তক কেলঙ্কারির প্রতিবাদে আজ সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সংগঠনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান নেবেন। দুই মন্ত্রীর অপসারণের দাবি এসেছে চট্টগ্রামে চারটি প্রগতিশীল গণসংগঠন আয়োজিত সমাবেশ থেকে। ভুলে ভরা এবং সাম্প্রদায়িক ও নারীবিদ্বেষী ভাবধারায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে এই দাবি ওঠে। চারটি সংগঠন হচ্ছে ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী এবং খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটি। নগরীর নন্দনকাননে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সামনে আয়োজিত এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সহ-সভাপতি প্রবাল দে। সমাবেশে বক্তারা বলেন, বর্তমান সরকার বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিচ্ছে। আমরা সবসময় সরকারের এ কর্মকা-ের প্রশংসা করেছি। কিন্তু এবার সরকার বছরের প্রথম দিন বই তুলে দিলেও আমরা প্রশংসা করতে পারছি না। ‘কারণ এই পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে দেশে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এই পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে ধর্ম ব্যবসায়ী হেফাজতে ইসলাম আর চরমোনাই পীরদের দাবি পূরণ করা হচ্ছে। আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে নিয়ে যাবার সব আয়োজন করা হয়েছে এই পাঠ্যপুস্তকে। একদিকে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয়েছে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রণেশ দাশগুপ্ত, হুমায়ন আজাদের মতো প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে লৈঙ্গিক বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
×