ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পিকেএসএফের ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচী

এক লাখ টাকা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণে পাল্টে গেছে ভিক্ষুক জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

এক লাখ টাকা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণে পাল্টে গেছে ভিক্ষুক জীবন

আনোয়ার রোজেন ॥ মাত্র ১ লাখ টাকা বদলে দিয়েছে তাদের জীবন। ১০ বছর ভিক্ষাবৃত্তির পর চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের নুরুল ইসলাম-জমিলা খাতুন দম্পতি আজ আর ভিক্ষা নেন না, ভিক্ষা দেন। ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচীর ১ লাখ টাকা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণে পাল্টে গেছে তাদের জীবন। এ টাকার মধ্যে ৪২ হাজার টাকা দিয়ে এক জোড়া গাভী-বাছুর, ১৮ হাজার টাকা দিয়ে ৫টি ছাগল, ২ হাজার টাকায় ৭টি মুরগি ও ৩ হাজার টাকা দিয়ে ৮ জোড়া কবুতর কেনেন। ১৬ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে গরুর গোয়াল, ছাগলের ঘর এবং কবুতর ও মুরগির ঘর নির্মাণসহ নিজের বসতবাড়ির সংস্কার এবং বসতবাড়ির পিছনের পরিত্যক্ত জমিতে শাক-সবজি চাষের জন্য বেড়া নির্মাণে খরচ করেন ১৭ হাজার ৮৬০ টাকা। এরপর তাদের ভাগ্য বদলের কাহিনী শোনান এ দম্পতি। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ‘সমৃদ্ধি’ কর্মসূচীর আওতায় এভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় এনজিওর মাধ্যমে ভিক্ষুকদের করা হচ্ছে স্বাবলম্বী। দিনমজুর নুরুল ইসলাম ৪২ বছর বয়সে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে তুলে নিয়েছিলেন ভিক্ষার ঝুলি। কঠোর পরিশ্রমের ফলে তাদের গোয়াল ঘরে এখন ২টি গরু মোটাতাজা হচ্ছে, ছাগল রয়েছে ১৭টি, মুরগি ২৫টি ও ১৭ জোড়া কবুতর। গরু ও ছাগল বিক্রি করে গত বছর ১ বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে শুরু করেছিলেন ধান চাষ। ঘরে এখন তাদের চাল মজুদ রয়েছে। ক্ষেতের শাক-সবজি, কবুতর, মুরগি ও ডিম খেয়ে এবং বিক্রি করে এখন তাদের সংসার দিব্যি চলে যাচ্ছে। প্রায় একই রকম গল্প শোনালেন এই প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হওয়া ভিক্ষুক জীবননগরের আছিয়া খাতুন, কোটচাঁদপুরের হাওয়া বিবি ও শহিদুল ইসলাম এবং কালিগঞ্জের ময়জদ্দিনের ছেলে আজিজুল হক। দিনাজপুর শহরের কামরুজ্জামান, কবিতা রানী, জুলেখা খাতুন, জুবেদা বেওয়া, রাবেয়া বেওয়ারাও আজ স্বাবলম্বী। গাভী পালন, ভ্যান চালিয়ে অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসা করে এরা আজ স্বাবলম্বী। পিকেএসএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, গত দুই বছরে তিন ধাপে সর্বমোট ৬২৫ জন ভিক্ষুককে এ পর্যন্ত পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। যারা এখন আর ভিক্ষা করছেন না। মাত্র দু’জন এ প্রকল্প থেকে ছিটকে পড়লেও তারা আবার এ কর্মসূচীতে যুক্ত হচ্ছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আরও ২১২ জন ভিক্ষুকের পুনর্বাসন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি জানান, প্রত্যেক ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য পিকেএসএফ থেকে সর্বমোট ১ লাখ টাকার অনুদান বরাদ্দ দেয়া হয়। দেশে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে অনেক উদ্যোগ নেয়া হলেও সেগুলো টেকসই করা সম্ভব হয়নি। রাজধানী ঢাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে প্রায় ৭ বছর আগে নেয়া সরকারের উদ্যোগটিও মুখথুবড়ে পড়েছে। বাজেট থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার অভাবে থমকে গেছে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের পুনর্বাসন কার্যক্রম। কিন্তু সমৃদ্ধি প্রকল্পের মাধ্যমে পিকেএসএফের এই কার্যক্রম সফল বলা যায়। কেননা এ প্রকল্পের ভিক্ষুকদের অনেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। অথবা সমাজ থেকে বিচ্যুত। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, পিকেএসএফের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মসূচী ‘সমৃদ্ধি’ শুরুর পূর্বে প্রত্যেকটি সমৃদ্ধিভুক্ত এলাকায় একটি বিস্তারিত জরিপ পরিচালনা করা হয়। সমাজে পিছিয়ে পড়া প্রকৃত ভিক্ষুকদের এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। নির্বাচিত ভিক্ষুকের পুনর্বাসন পরবর্তীতে তার প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে একটি পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি তার সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেন পুনরায় ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরে না যায় তা নিশ্চিত করে। পুনর্বাসন কমিটির মধ্য থেকে সংশ্লিষ্ট ভিক্ষুক পরিবারে নিকটতম ব্যক্তি বা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যকে ভিক্ষুক পরিবারের স্থানীয় অভিভাবক বা জামিনদার হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পিকেএসএফের দেয়া এক লাখ টাকার মধ্যে ন্যূনতম ৭০ শতাংশ টাকা সংশ্লিষ্টদের আয় বৃদ্ধিমূলক খাতে বিনিয়োগের শর্ত দেয়া থাকে। পুনর্বাসন পরবর্তীতে ব্যক্তি পুনরায় আর ভিক্ষাবৃত্তিতে ফেরত যাবেন না, এটি উক্ত চুক্তির প্রধান শর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। পুনর্বাসন চুক্তি সম্পন্ন হলে প্রত্যেক ভিক্ষুকের জন্য সংশ্লিষ্ট ভিক্ষুক পরিবার এবং সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। অনুদানের সমুদয় অর্থ প্রাথমিকভাবে উক্ত হিসাবে স্থানান্তর করা হয় এবং পরবর্তীতে প্রয়োজন মতো উক্ত হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন করে পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। এ বিষয়ে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, সমৃদ্ধি কর্মসূচীর আওতায় নিয়ে আসা প্রত্যেক ভিক্ষুক আজ স্বাবলম্বী। এটি সমাজে উদাহরণ হতে পারে। সাময়িক কিছু সহযোগিতা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন বা স্বাবলম্বী করা সম্ভব নয়। মাত্র এক লাখ টাকায় একটি ভিক্ষুক পরিবার আজ স্বাবলম্বী। সমাজের বিত্তবানরাও পিকেএসএফের এই উদাহরণ গ্রহণ করে দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে পারেন।
×