ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে হামলায় জড়িত ২২ জঙ্গী এখনও পলাতক

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

হলি আর্টিজানে হামলায় জড়িত ২২ জঙ্গী এখনও পলাতক

শংকর কুমার দে ॥ বহুল আলোচিত গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে নব্য জেএমবির ৩৫ জঙ্গীর। এর মধ্যে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৩ জঙ্গী। এখনও পলাতক ২২ জঙ্গী। যেসব জঙ্গী এখনও পলাতক তারা সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। এর মধ্যে রাজধানীর আশকোনার সূর্য ভিলা নামের জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গীদের মাস্টারমাইন্ড মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত নব্য জেএমবির জঙ্গী তৎপরতা ও জঙ্গী হামলা বন্ধ হবে এমন গ্যারান্টি দিতে পারছেন না গোয়েন্দারা। তবে পলাতকদের মধ্যে কয়েক জঙ্গীকে যে কোন সময় গ্রেফতারের জন্য গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। রিপন শেখ নামে পলাতক এক জঙ্গী শনিবার পশ্চিমবঙ্গে জাল টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ধরা পড়ার খবর পেয়ে কলকাতার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে ঢাকার গোয়েন্দারা। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানায়, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর রিপন ও খালিদ নামে দুই জঙ্গী পালিয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গে। এর মধ্যে শনিবার রিপন শেখ নামে এক জঙ্গী পশ্চিমবঙ্গে জাল টাকা পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হলেও খালিদ নামে অপর জঙ্গী সেখানে থেকে বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। রিপন শেখ ওরফে রিপন আলীকে শুক্রবার রাতে পশ্চিমবঙ্গের মালদার কালিয়াচক অঞ্চল থেকে গ্রেফতার করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গে জাল নোট পাচারের অভিযোগে তাকে গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা(এনআইএ)। রিপনের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া অপর জঙ্গী খালিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত(চার্জশীট) আসামিও। জেএমবি সদস্য খালিদ ওরফে শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদকে ধরতে দুই লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। খালিদের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হওয়া পশ্চিমবঙ্গের জাল নোট পাচারে অন্যতম মাথা তথা জেএমবির জঙ্গী রিপন শেখ ওরফে লায়ন ওরফে লিটন শেখকে এনআইএ হাতে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে জানতে পেরেছে ঢাকার গোয়েন্দারা। ঢাকার গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার গভীর রাতে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের দিকের কাঁটাতারের বেড়া টপকে মালদহের বৈষ্ণবনগরের সবদলপুর সীমান্ত দিয়ে সে দেশে ঢোকার সময় টহলরত বিএসএফ জওয়ানদের হাতে ধরা পড়ে যায় ৩০ বছরের ওই জঙ্গী রিপন আলী ওরফে রিপন শেখ। এর পরই দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ’র হাতে তুলে দেয়। শনিবার রিপনকে কলকাতার নগর দায়রা আদালতের মুখ্য বিচারক শুভ্রা ঘোষের এজলাসে হাজির করেন এনআইএ’র অফিসাররা। এনআইএ’র আইনজীবী শ্যামল ঘোষ আদালতে বলেন, গত নবেম্বর মাসে মালদহের কালিয়াচকে শেখ আনোয়ার আলী ওরফে টাইগার নামে এক জালনোট কারবারিকে গ্রেফতার করে এনআইএ। ওই জঙ্গীর হেফাজত থেকে পাওয়া যায় হাজার এবং পাঁচ শ’ টাকার নোট মিলিয়ে মোট ৮ লাখ জাল টাকা। জেরায় টাইগার জানায়, এই কারবারে তার মাথার ওপর রয়েছে ‘লায়ন’। এখন সে থাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার সাহাপাড়ায়। আদালত এদিন রিপনকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এনআইএ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেয়। ভয়ঙ্কর শীর্ষ জঙ্গী ॥ গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় জড়িতদের মধ্যে সর্বশেষ বৃহস্পতিবার গভীর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে জঙ্গী নুরুল ইসলাম মারজান ও সাদ্দাম। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা আরও এক জঙ্গী পালিয়ে গেছে বলে পুলিশের দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে পলাতক জঙ্গীদের মধ্যে কয়েক শীর্ষস্থানীয় জঙ্গী রয়ে গেছে, তারা যে কোন সময় বড় ধরনের জঙ্গী হামলার জন্য হুমকি বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের দাবি। পলাতক শীর্ষস্থানীয় জঙ্গীদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া, আশকোনার জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া মাঈনুল ওরফে মুসা, আজিমপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়া বাশারুজ্জামান ওরফে চকোলেট, মাহফুজ সোহেল, রাজিব গান্ধি খুবই দুর্ধষ ও ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। এ ছাড়াও সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য আবু ইউসুফ মোহাম্মদ বাঙালি, পুরনো জেএমবির শূরা সদস্য (বর্তমানে নব্য জেএমবির অস্ত্রের যোগানদাতা) মাহফুজ সোহেল ওরফে হাতকাটা সোহেল ওরফে নাসির উদ্দিন ওরফে ভাগিনা সোহেল, খোকন, ওয়াসিম আজওয়াদ ওরফে আসিফ আজওয়াদ, আবুল কাশেম ওরফে বড় হুজুর, কমান্ডার মানিক, মামুনুর রশিদ লিটন, ইব্রাহিম হাসান খান ও তার ভাই জুনায়েদ হাসান খান, ইকবাল, মামুন, বাদল, সাগর, আজাদুল ওরফে কবিরাজ ও সাকিব ওরফে মাস্টার পলাতক থাকায় পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তারা ধরা না পড়া পর্যন্ত জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির কাছ থেকে জঙ্গী হামলা কিংবা গুপ্ত হত্যা বা টার্গেট কিলিং আবার হবে না এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। পলাতকদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দেশে গোয়েন্দা জাল পেতে রেখেছে। তাদের মধ্যে রাজিব গান্ধীকে গ্রেফতার করতে সবচেয়ে বেশি মরিয়া তদন্তকারীরা। এই জঙ্গী গুলশান হামলার আগে ও পরে দেশের উত্তরাঞ্চলের নব্য জেএমবির নেতৃত্বে ছিল। গুলশান হামলার দিন সে ঢাকাতেই ছিল। হামলার পর সে তামিম-মারজানের সঙ্গে দেখা করে উত্তরাঞ্চলে চলে যায়। বর্তমানে নব্য জেএমবির নেতৃত্বদানকারী আবু মুসাও যেকোন সময় গ্রেফতার হতে পারে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দারা। যেসব শীর্ষ জঙ্গী বন্দুকযুদ্ধে নিহত ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নব্য জেএমবির প্রধান সমন্বয়ক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী, অর্থের যোগানদাতা আব্দুর রহমান, সামরিক প্রশিক্ষক নুরুল ইসলাম মারজান ও মেজর (অব) জাহিদ এবং সংগঠক তানভীর কাদেরী। তারা সবাই অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে তামিম আহমেদ চৌধুরী যেহেতু বিয়ে করেনি সেই কারণে তাকে ছাড়া বাদ বাকি সবার স্ত্রীরা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দী আছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যানুযায়ী নব্য জেএমবির সাংগঠনিক তৎপরতা ও জঙ্গীদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। যেভাবে ৩৫ জঙ্গী হামলায় জড়িত ॥ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেছেন, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে এমন সন্দেহভাজনের সংখ্যা প্রায় ৩৫ । এদের মধ্যে আছে জঙ্গী হামলার মূল সমন্বয়ক, সমন্বয়ে সহযোগিতা ও রেকি, আক্রমণকারী জঙ্গীদের প্রশিক্ষক, পরিকল্পনাকারী, বোমা তৈরি, অস্ত্র সংগ্রহ, আশ্রয়দাতা, অর্থদাতা, মদদদাতা। তবে গুলশান জঙ্গী হামলায় এখন পর্যন্ত মাত্র গ্রেফতার দেখানো হয়েছে দুই জনকে। এই দুইজন হচ্ছে কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে আহত অবস্থায় গ্রেফতারকৃত জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যান ও জঙ্গী হামলার সময় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির ছাদে জঙ্গীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপরত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক হাসনাত রেজা করিম। এর মধ্যে রাকিবুল হাসান রিগ্যান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। রিগ্যান গুলশান হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ জঙ্গীকে ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাস নিয়ে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছিল বলে তদন্ত কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। প্রসঙ্গত গত ১ জুলাই হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় দেশী-বিদেশী ২০ নাগরিক নিহত হয়। এর মধ্যে ৯ ইতালিয়ান, ৭ জাপানী, এক ভারতীয়, একজন বাংলাদেশ এবং আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক ও দুই বাংলাদেশী। এছাড়াও হামলার মুহূর্তে পুলিশী অভিযান শুরুর মুখে জঙ্গীদের হামলায় নিহত হন রবিউল ইসলাম ও সালাউদ্দিন খান নামে দুই পুলিশ কর্মকর্তা। আহত হন আরও অন্তত ২৫ পুলিশ সদস্য। পরদিন সকালে সেনা কমান্ডোর নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল নামে পাঁচ জঙ্গী নিহত হয়। এছাড়া অভিযানে নিহত হয় সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নামে এক শেফ। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়ার পর জাকির হোসেন শাওন নামে আরেক তরুণ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অভিযানের আগে ও পরে হলি আর্টিজান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এক জাপানী ও দুই শ্রীলঙ্কানসহ অন্তত ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে।
×