দশম অধ্যায়
একাত্তরের দিনপঞ্জি
(গতকালের পর)
১৯ মার্চ : ইয়াহিয়া-মুজিব সংলাপের তৃতীয় রাউন্ড অনুষ্ঠিত। সংলাপের শেষে দু’জনের মধ্যে ৯০ মিনিটের বৈঠক।
: চতুর্থ রাউন্ড বৈঠক যেখানে সকল উপদেষ্টারা হাজির ছিলেন।
: শেখ মুজিবের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের বৈঠক : কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলাতানা, ন্যাপের ওয়ালি খান এবং জামাতুল উলামা এ ইসলাম নেতা মুফতি মাহমুদ।
২০-২৩ মার্চ : ব্যারিস্টার এ কে ব্রোহী ঢাকায় আসলেন, জেনারেল ইয়াহিয়াকে আইনী বিষয়ে সহায়তা করতে।
২১ মার্চ : ভুট্টোর সদলবলে ঢাকা আগমন।
২১-২৫ মার্চ : ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে ছয় দফা বৈঠক।
২২ মার্চ : ভুট্টো-মুজিব-ইয়াহিয়া যৌথ বৈঠক।
২২ মার্চ : ২৫ মার্চে নির্ধারিত জাতীয় পরিষদ বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।
২৩ মার্চ : চট্টগ্রামে সোয়াত জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নোঙর করল কিন্তু জাহাজ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র খালাস প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো।
২৩ মার্চ : সকাল ও বিকাল দুই অধিবেশনে দুই দলের সংলাপ। ইয়াহিয়ার পরামর্শকবৃন্দ এম এম আহমদ, বিচারপতি এ. আর. কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা এবং কর্নেল হাসানের সঙ্গে শেখ মুজিবের পরামর্শকবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেনের আলোচনা।
২৪ মার্চ : আবারো সকালে বিকালে দুই পরামর্শক দলের আলোচনা সভা।
২৫ মার্চ : জে এ রহিম এবং মোস্তাফা খরসহ জুলফিকার আলী ভুট্টোর ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক।
: কাউন্সিল মুসলিম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলাতানা জাতীয় পরিষদের বিভক্ত বৈঠক চান না।
: ভুট্টো মন্তব্য করেন যে ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন প্রায় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করবে।
২৫ মার্চ : পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ দৌলতানা, বাজেঞ্জো এবং ওয়ালি খানের ঢাকা ত্যাগ।
২৫ মার্চ : রাত ৮টায় ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তান ধ্বংস ও বাঙালী গণহত্যার হুকুম দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং এম এম আহমদকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের পথে উড়াল দিলেন।
২৫ মার্চ : মধ্যরাতে বারোটার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইউনিট ঢাকা ছাউনি থেকে ট্যাংক, মেশিনগান এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ধাবিত হলো, পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের সদর দফতর ও ঘাঁটিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের দিকে এবং সংবাদপত্র পিপলের দফতরে। মুহূর্তে শুরু হলো হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। সামান্য প্রতিরোধ পেল পুলিশ লাইনে এবং পিলখানা রাইফেলের ঘাঁটিতে।
২৫ মার্চ : মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একদল সেনাসদস্য তার ধানম-ির ৩২ নম্বর রাস্তার বসতবাড়িতে গ্রেফতার করে সেনা ছাউনিতে নিয়ে গেল।
২৫ মার্চ মধ্যরাত : বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের আগে তার স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী রেডিও ওয়ারলেসে ইপিআর এর ওয়ারলেস কেন্দ্রে প্রেরণ করলেন।
২৬ মার্চ : চট্টগ্রাম কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে অপরাহ্নে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নানের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ। রাত ১০টা পর্যন্ত এই ঘোষণা বার বার পাঠ করা হলো।
২৬ মার্চ : আবু সায়ীদ চৌধুরী জেনেভায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের বৈঠক থেকে লন্ডনে গেলেন।
২৭ মার্চ : মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন।
২৫-২৭ মার্চ : ঢাকা হলো মৃত্যুপুরি। পুলিশ লাইন শূন্য, ইপিআর ঘাঁটি শূন্য, ইংরেজী দৈনিক চবড়ঢ়ষব-এর দফতর ভূলুণ্ঠিত। মহানগর এখানে সেখানে বিধ্বস্ত। পলায়নপর জনতা মহানগর ছেড়ে গ্রামমুখী।
২৫ মার্চ-৬ এপ্রিল : চট্টগ্রামে ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম শুধু সমুদ্রপোত ও বিমানপোত ছাড়া মহানগরকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলমুক্ত রাখতে সক্ষম।
২৬ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল : মেহেরপুর মহকুমা হাকিম তওফিক এলাহী, মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব আহমদ, কুষ্টিয়ায় ছুটিতে অবস্থানকারী মেজর আবু উসমান এবং বরিশাল এবং ফরিদপুরে ছুটিতে অবস্থানকারী মেজর জলিলের নিয়ন্ত্রণে।
২৭ মার্চ : ওয়াশিংটনে পাকিস্তান মিশনের কাউন্সিলর মুহিতের বাড়িতে স্থানীয় বাঙালীদের বৈঠক ও বাংলাদেশের পক্ষে আন্দোলনের জন্য কর্মসূচী গ্রহণ।
২৯ মার্চ : ওয়াশিংটনে কংগ্রেসের সামনে বাংলাদেশের পক্ষে র্যালিতে প্রায় ২শ’ বাঙালী ও অন্যান্য সমর্থকদের অংশগ্রহণ।
১ এপ্রিল : মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ে উদ্বেগ ও আশু সমাধানের জন্য সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও সিনেটর পল হ্যারিসের বক্তৃতা।
২ এপ্রিল থেকে ৬ এপ্রিল : তাজউদ্দীন আহমদ চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সহায়তায় দিল্লীতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মোলাকাত এবং আলোচনা করেন।
৪ এপ্রিল : সীমান্ত এলাকা দিয়ে পলায়নে সফল চার সেক্টরের সেনাপতিদের তেলিয়াপাড়ায় কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে বৈঠক। এতে ছিলেন চট্টগ্রাম সেক্টরের মেজর জিয়াউর রহমান, সিলেট কুমিল্লা সেক্টরের মেজর খালেদ মোশাররফ, জয়দেবপুর ময়মনসিংয়ের মেজর কে এম সফিউল্লাহ এবং ঢাকা কুমিল্লা ফেনীর মেজর নুরুজ্জামান। কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে ছিলেন কর্নেল এম এ রব।
৬ এপ্রিল : দিল্লীস্থ পাকিস্তান দূতাবাস থেকে দ্বিতীয় সচিব মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন ও সহকারী প্রেস এটাশি আমজাদুল হক আনুগত্য পরিবর্তন করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগদান। দূতাবাসে কর্মরত বাঙালী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আনুগত্য পরিবর্তনের এই হলো সূচনা।
৭ এপ্রিল : বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে প্রতিনিধি সেমুর হেলপার্নের বক্তৃতা।
১০ এপ্রিল : কলকাতায় তাজউদ্দীনের প্রচেষ্টায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত এবং বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা। সরকার হলো ছয় জনকে নিয়ে যার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত। ১. রাষ্ট্রপতি অনুপস্থিত শেখ মুজিবুর রহমান। ২. সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী সভাপতি বটে)। ৩. প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ৪. অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ মনসুর আলী। ৫. পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমদ। ৬. ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান।
১০ এপ্রিল : বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী লন্ডনে বিবিসিতে ঘোষণা দিলেন যে, তিনি পাকিস্তানের কোন প্রতিনিধি বা পদাধিকারী আর নন। তিনি বাংলাদেশের প্রতি অনুগত এবং বাংলাদেশের জন্যই তিনি যা করতে পারবেন তাই করবেন।
১০ এপ্রিল : সিনেটর কেস ও সিনেটর সন্ডেইল মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের জন্য এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য একটি প্রস্তাব (জবংড়ষঁঃরড়হ) উত্থাপন করলেন।
১১ এপ্রিল : প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি।
১১ এপ্রিল : চারজন বাঙালী মেরিন কর্মকর্তা আবদুল আওয়াল মিন্টু, আনোয়ার হোসেন, আবুল কাশেম ও তাহেরুন ইসলাম বাল্টিমোর বন্দর থেকে পাকিস্তানী জাহাজ ‘ময়নামতি’ ও ‘শালিমার’ পরিত্যাগ করে আমেরিকায় আশ্রয়প্রার্থী হন।
১২ এবং ১৪ এপ্রিল : ওয়াশিংটন পোস্ট দৈনিকে হার্ভাড অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যানের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধের জন্য ২৯ জন বিশ্ব বুদ্ধিজীবীর এক পৃষ্ঠা জুড়ে বিবৃতি বিজ্ঞপ্তি হিসেবে প্রকাশিত। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কিছু নোবেল লরিয়েটও ছিলেন।
১৩ এপ্রিল : বিশ্বব্যাংকে কর্মরত বিশেষজ্ঞ হারুন অর রশিদকে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালী কর্মকর্তাগণ তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমসাময়িক তথ্য, যথাযথ নির্দেশনা ও উপদেশ নিয়ে আসতে প্রেরণ করেন। হারুন এই কাজটি করতে আগ্রহ প্রকাশ করায় ব্যবস্থাটি গ্রহণ করা হয়। হারুন কলকাতায় পৌঁছেন মুজিবনগর সরকারের অভিষেকের সামান্য আগে। তিনি মুজিব নগরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে একটি তারবার্তা আমাকে পাঠান ২০ এপ্রিলে। তারপর তিনি ফিরে আসেন ২৫ এপ্রিল।
১৪ এপ্রিল : কর্নেল এমএজি ওসমানীকে এবহবৎধষ ঙভভরপবৎ ঈড়সসধহফরহম রহ ঈযরবভ ড়ভ ঃযব খরনবৎধঃরড়হ অৎসু হিসেবে মন্ত্রীর মর্যাদায় নিযুক্তি দেয়া হয়। তখন সেক্টর ছিল আটটি।
১৫ এপ্রিল : মার্কিন সিনেটে পাকিস্তানে সামরিক সহায়তা বন্ধের পক্ষে কেস মডেইল প্রস্তাব পেশ।
১৭ এপ্রিল : মুজিবনগর সরকারের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে শপথ গ্রহণ এবং প্রতিষ্ঠা উৎসব।
১৮ এপ্রিল : কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর ৬৫ জন কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা। মিশনের দ্বিতীয় সচিব আনোয়ারুল করিম চৌধুরী এই উদ্যোগে বিশেষ ভূমিকা পালন। ডেপুটি হাইকমিশনার দফতর মুজিবনগর সরকারের প্রধান দফতর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
২১ এপ্রিল : লন্ডনে অবস্থানকারী পূর্ব পাকিস্তানের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের এনভয় হিসেবে ইউরোপ ও জাতিসংঘে নিযুক্ত।
২২ এপ্রিল : জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট ভাগাত আল তাবিলকে ঢাকার তার বিশেষ দূত হিসেবে ঘোষণা দিলেন। তিনি ৭ জুনে ঢাকায় পদায়িত হন।
২৫ এপ্রিল : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত।
২৬ এপ্রিল : নিউইয়র্কে পাকিস্তানের ভাইস কনসাল আবুল হাসান মাহমুদ আলীর বাংলাদেশের সমর্থনে আনুগত্য পরিবর্তন।
২ মে : মুজিবনগর সরকারের শেষ দখল রামগড়ের পতন।
২ মে : অধ্যাপক রেহমান সোবহান অর্থনৈতিক এনভয় নিযুক্ত এবং লন্ডন হয়ে ওয়াশিংটন আগমন।
১২ জুন : নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সামনে কাজী শামসুদ্দিন আহমদ এবং বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার উদ্যোগে বাংলাদেশ গণহত্যা বন্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা কামনা করে র্যালি অনুষ্ঠিত। বাঙালী এবং অন্যান্য সমর্থক নিয়ে এইটি ছিল প্রায় ৫০ জনের র্যালি।
২১ জুন : প্যারিসে পাকিস্তান দাতা কনসোর্টিয়ামের নতুন আর্থিক সহায়তা দান স্থগিত।
২৮ জুন : জেনারেল ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ গ্রুপ প্রতিষ্ঠা।
৩০ জুন : ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাস থেকে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর এ এম এ মুহিতের আনুগত্য পরিবর্তন।
১০ জুলাই : পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতির ওপর বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন, পূর্ব পাকিস্তানে কোন সহায়তা দেয়ার সুযোগ নেই। সারাদেশে ভয়াবহতার রাজত্ব বিরাজিত এবং ভীতির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রতিরোধ দমন হলো পাকিস্তান সরকারের একমাত্র কাজ এবং এই কাজে তারা নৃশংস, বর্বর ও লাগামহীনভাবে স্বেচ্ছাচারী। চলবে...