ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তিন সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি করেছে এনসিটিবি ;###;প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বললেন হেফাজতের নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ব্যবস্থা এগোবে

সমালোচনার ঝড়

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৭ জানুয়ারি ২০১৭

সমালোচনার ঝড়

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ঝকঝকে মলাটে মোড়া নতুন পাঠ্যবই দেশজুড়ে বিতরণ করে প্রশংসা কুড়ালেও ভুলেভরা আর মৌলবাদীদের দাবি অনুসারে পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র। সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক থেকে শুরু করে পাঠ্যবই কেলেঙ্কারিতে উদ্বিগ্ন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাঙ্গন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্রই বইছে সমালোচনার ঝড়। তবে ভুল নিয়ে তীব্র সমালোচনার পর তিন সদস্যের একটি পর্যালোচনা কমিটি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, দ্রুতই ভুল সংশোধন করা হবে। উগ্রবাদীদের দাবি মেনে বই হলেও মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, হেফাজতের চেতনায় নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাবে। এবারের পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক শুরুর আগেই গত কয়েক মাস হেফাজতসহ জামায়াত-শিবির মদদপুষ্ট কিছু উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী তাদের দাবি মেনে বইয়ের লেখক নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছিল। মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে পাঠ্যবইকে হিন্দুদের বই বলেও সভা-সমাবেশ করেছে তারা। অধিকাংশই স্বাধীনতাবিরোধী এ গোষ্ঠীর আব্দার ছিল, হিন্দু লেখকদের বই পড়ানো যাবে না, হুমায়ূন আজাদের লেখা পড়ানো যাবে না। বই নিয়ে মৌলবাদী গোষ্ঠীর দাবি নিয়ে এতদিন কারও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এবারের বই হাতে পেয়ে দেখা গেল অনেকাংশেই জামায়াত মদদপুষ্ট হেফাজতসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চাওয়াই পাঠ্যবইয়ে পূরণ করা হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে শিশুদের বইয়ের পরতে পরতে অসংখ্য ভুল। নতুন বছরের প্রথম দিন হাতে বিনামূল্যের নতুন পাঠ্যবই পেয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ থাকলেও বইয়ের ভুল নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না অভিভাবকরা। এর পরই শুরু হয়েছে প্রতিবাদ। বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ভুলগুলো নিয়ে সমালোচনায় পড়েছে বই প্রণেতা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। যদিও পাঠ্যক্রম নির্ধারণে আছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দেশের বহু নামী- দামী শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞ। ভুলের দায় ঘাড়ে পড়া এনসিটিবি বলছে, পাঠ্যবইয়ের এ বিষয়ে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সারাদেশে বই শিশুদের হাতে চলে যাওয়ার পর এখন তা পরিবর্তনের সুযোগ আদৌ আছে কিনা তা নিয়েই আছে প্রশ্ন। বইয়ে বানান ভুলের খতিয়ান তুলে ধরে অনেকে প্রশ্ন রেখেছেন- শিশুদের পাঠ্যবইয়ে এসব কী শেখানো হচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি বিকৃত করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে লেখা হয়েছে, ‘ও’-তে ওড়না চাই; যা নিয়ে ফেসবুকে চলছে তুমুল সমালোচনা। ২০১২ সালে নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী ২০১৩ সালে বিতরণ করা বইয়েও ‘ও’-তে ওড়না চাই বাক্যটি লেখা ছিল। প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে শুনি ও বলি পাঠে একটি ছাগলের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, অজ (ছাগল) আসে। আম খাই। এক সময় অ-তে অজগর শেখানো হলেও তার বদলে শিশুদের বইয়ে প্রায় অপ্রচলিত ‘অজ’ শব্দের ব্যবহার সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আবার আম খাওয়া বোঝাতে একটি আম গাছের নিচের অংশে দুই পা তুলে একটি ছাগলের দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেয়া হয়েছে সেখানে। এই ছবি নিয়ে কেউ কেউ ফেসবুকে লিখেছেন, ছাগল নাকি গাছে উঠে আম খায়। তৃতীয় শ্রেণীর একটি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবির নিচে ইংরেজীতে একটি বাক্য লেখায় বানান ভুল হয়েছে। এই বাক্যে আঘাত করা বোঝাতে গিয়ে হার্ট বানান লিখতে ভুল হয়েছে। লেখা হয়েছে, উঙ ঘঙঞ ঐঊঅজঞ অঘণইঙউণ. অর্থাৎ আঘাতের ইংরেজী হার্ট (ঐবধৎঃ)। অন্তত এটাই শিখবে প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণী পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দু ধর্মশিক্ষা বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ঠিক এমনটাই লেখা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় বেশ কয়টি লাইন বিকৃত করার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। মূল কবিতায় আছে ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’। আর বইয়ে ছাপা কবিতায় লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?’ এছাড়া ‘মানুষ হইতে হবে- এই তার পণ’ এর বদলে লেখা হয়েছে ‘মানুষ হতেই হবে’। বিকৃতি কেবল এটুকুই নয়; কবিতার চতুর্থ লাইনে কুসুমকুমারী লিখেছেন, ‘মানুষ হইতে হবে’-এই তার পণ। বিকৃত কবিতায় ‘হইতে’ শব্দটিকে ‘পা-িত্য’ দেখিয়ে ‘সম্পাদনা’ করে ‘হতেই’ লিখেছেন পাঠ্য রচয়িতারা। নবম লাইনে মূল কবিতায় লেখা আছে, ‘সে ছেলে কে চায় বল কথায়-কথায়’। এই লাইনের ‘চায়’ শব্দটিকে বিকৃত করে অথবা উচ্চারণ অজ্ঞতায় পাঠ্য রচয়িতারা লিখেছেন ‘চাই’, অর্থাৎ ‘সে ছেলে কে চাই বল কথায় কথায়’! এর পর ‘আমার বই’য়ে দেখাই গেলো না একাদশ থেকে চতুর্দশ লাইন পর্যন্ত। সে চারটি লাইন হলো, ‘সাদা প্রাণে হাসি মুখে কর এই পণ/‘মানুষ’ হইতে হবে মানুষ যখন।/কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার/সবারি রয়েছে কাজ এ বিশ্ব মাঝার,/’ মূল কবিতার পঞ্চদশ লাইনে লেখা ‘হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান’। এই লাইনের ‘খাট’ শব্দটিকে বিকৃত করে লেখা হয়েছে ‘খাটো’। এভাবে শব্দ-লাইন বিকৃতির পাশাপাশি বালাই দেখা গেলো না যতি চিহ্নের ব্যবহারেও। ড্যাশ-কমা-ঊর্ধ্বকমা ইচ্ছেমতো ব্যবহার বা বর্জন করা হয়েছে। এদিকে সঙ্কটের এখানেই শেষ নয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পাঠ্যবইয়ে শিশু-কিশোরদের যে পাঠ্যক্রম পড়ানো হতো তা ২০১২-১৩ সালে এসে আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তন করে। স্মরণকালের মধ্যে পাঠ্যবইয়ে আওয়ামী লীগের করা সেই পরিবর্তনই এই খাতে বড় সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই সংস্কারের ফলে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে পায় পাঠ্যবই। কিন্তু তিন বছর না যেতেই, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শুদ্ধ হওয়া পাঠ্যবইগুলো এবার এসে পড়েছে জামায়াত-হেফাজতের খপ্পরে। এর ফলে অনেকটা নীরবে ‘প্রতিক্রিয়াশীলদের’ পছন্দমতো রচনা বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ফিরে আসে। বই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-২০০৩ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পড়ানো হয়েছে, কিন্তু ২০১৩-১৬ পর্যন্ত পড়ানো হয়নি এমন ১০টি ‘গদ্য ও পদ্য’ বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ২০১৭ সালে ফিরে এসেছে। উল্লেখ্য, ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল- জোট সরকার ক্ষমতায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিকৃত ইতিহাস পড়াচ্ছে। ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে পাঠ্যবই সংস্কারের কাজ শুরু করলেও আওয়ামী লীগ সরকার তা শেষ করে ২০১১ সালে। এ সময় পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তুলে ধরা হয়। কিন্তু এখন পরিবর্তনের ফলে পাঠ্যবইগুলোতে সেই মূল্যবোধ আর থাকছে না। হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া এসব পাঠ্যবই আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৭ সাল থেকে শিশু-কিশোররা পড়তে বাধ্য হবে। ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উৎসবের মাধ্যমে এসব বই শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের হস্তক্ষেপে পাঠ্যবই থেকে বাদ পড়েছে অনেক প্রগতিশীলের লেখা। যা সুশীল সমাজে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণীর পাঠ্যবই পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, লালন শাহ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হুমায়ুন আজাদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ পড়েছে। হেফাজতের দাবি পূরণ করেই যেন হিন্দু লেখকদের অনেক রচনা বাদ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অন্য লেখা পড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এর ফলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে এবার পাঠ্যবইয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ফিরে এলো বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। তবে শুধু বাংলা বইয়ে নয়, অন্য বইয়েও পরিবর্তন হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রকাশিত এসব পাঠ্যবইয়ের প্রথমদিকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান একটি ভূমিকা লেখেন। ভূমিকার নিচে বোর্ডের চেয়ারম্যানের নামসহ স্বাক্ষর দেয়া হয়। কিন্তু গত দু’বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান ‘হিন্দু’ হওয়ায় মাদ্রাসা বোর্ড এবং কিছু মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের আপত্তি। তারা মাদ্রাসা বোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রীকে জানিয়েছে, কোন ‘হিন্দু’ ব্যক্তি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে নাম দিতে পারবেন না। উগ্রবাদীদের এই দাবিগুলো শিক্ষা প্রশাসনের সবাই যেন মেনে নিয়েছেন। এর ফলে মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ের ভূমিকার নিচের অংশে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যানের নাম যায়নি। নামের জায়গায় শুধু ‘চেয়ারম্যান’ লেখা রয়েছে। সাধারণ স্তরের শিক্ষার পাঠ্যবইয়ে ভূমিকায় চেয়ারম্যানের নাম লেখা রয়েছে। এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলাম এবং তাদের ভাবাদর্শ কিছু আমলা এবং মাদ্রাসার কিছু কর্মকর্তা ও কথিক বিশেষজ্ঞ একত্রিত হয়ে কৌশলে পাঠ্যবইয়ের এসব পরিবর্তন এনেছে। সাধারণত পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পাঠ্যবই থেকে কিছু পরিবর্তন করতে হলে ‘এনসিসি’ নামে একটি কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এবার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এনসিসি বলেছে, এটা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। ফলে বিনা আলোচনায় পাঠ্যবইয়ে এসব বিষয় পরিবর্তন হয়ে যায়। দুই মন্ত্রণালয়ের কয়েক আমলা আছে এর পেছনে। যারা গত কয়েকমাস ধরে এনসিটিবিতে গেছেন কয়েক দফা। তাদের এজেন্ডাই ছিল হেফাজত জামায়াতের দাবি পূরণ করা। তাদের অপতৎপরতাতেই দ্বিতীয় শ্রেণীর ‘আমার বাংলা’ বইয়ে ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শীর্ষক একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। তেমনিভাবে তৃতীয় শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বইয়ে’ খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)’ শীর্ষক অধ্যায়, চতুর্থ শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বইয়ে’ ‘খলিফা হজরত ওমর (রা.)’ শীর্ষক অধ্যায়, পঞ্চম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা বইয়ে’ বিদায় হজ’ শীর্ষক অধ্যায়টি যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়াও পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘প্রার্থনা’ শীর্ষক কবিতার পরিবর্তে কবি কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হুমায়ুন আজাদের কবিতা ‘বই’। দেখা গেছে, অন্তর্ভুক্ত হওয়া এসব প্রবন্ধ ২০১২ সালের আগে ধর্ম বইয়ে ছিল। ‘বিদায় হজ’ নিবন্ধটি বাংলা বই থেকে সরিয়ে ২০১৩ সালে ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে পাঠ্যবইয়ে সবগুলো বাংলা বইয়ে ফিরে আসে। সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বই ‘সপ্তবর্ণা’র ‘গদ্য’ অংশ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাই’, মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরি’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’ ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লাল ঘোড়া’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে রবীন্দ্রাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’, লীলা মজুমদারের ‘পাখি’, এবং হাবীবুল্লাহ বাহারের ‘মরু ভাস্কর’ প্রবন্ধ সংযুক্ত করা হয়েছে। একই বইয়ের ‘কবিতা’ অংশে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সুকুমার রায়ের ‘আনন্দ’, কালিদাস রায়ের ‘অপূর্ব প্রতিশোধ’, জসীম উদ্্দীনের ‘বঙ্গবন্ধু’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে দিনের কবিতা’, স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘উপদেশ’, ফয়েজ আহমদের ‘স্মৃতিসৌধ’ কবিতাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে, রবীন্দ্রাথ ঠাকুরের ‘নতুন দেশ’ জসীম উদ্দীনের ‘আমার বাড়ি’, গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের ‘ শেনো একটি মুজিবরের থেকে’, সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’, সুকুমার রায়ের ‘শ্রাবণে’, সিকান্দার আবু জাফরের ‘গরবিনী মা-জননী’ ও সুফিয়া কামালের ‘সাম্য’ কবিতাটি যুক্ত করা হয়েছে। একই শ্রেণীর ‘আনন্দপাঠ’ থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনা ‘লালু’ গল্পটি বাদ দেয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. সরকার মোঃ আবদুল মান্নান বলছিলেন, ২০১২ সালের আগে এসব বিষয় পাঠ্য বইতে ছিল। মাঝখানে তিন বছর না থাকলেও এবার তা ফিরে এসেছে। পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বই থেকে হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতাটি কেন এবং কোন যুক্তিতে বাদ দেয়া হয়েছে তার কোন ব্যাখা দিতে পারেননি সরকার মোঃ আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, এটা আমি বলতে পারব না। এ বিষয়ে আমি মন্তব্য করতে রাজি নই। কিন্তু দায়িত্ব যেহেতু আপনি পালন করেছেন বক্তব্যতো আপনাকেই করতে হবে। এ প্রশ্নে তিনি বলেন, না বলতে পারব না। চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন। চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, কিছু পরিবর্তন হয়েছে যৌক্তিক কারণে। আর কিছু পরিবর্তনের বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। পরিবর্তনের মাধ্যমে চারদলীয় জোট সরকারের পাঠ্যক্রম ফিরে এলো কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন বইয়ের ‘অধ্যায়’ ধরে ধরে আমি বলতে পারব না। মাদ্রাসার পাঠ্যবইয়ে ভূমিকায় নিজের নাম না যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সব বিষয়ে আমি কথা বলতে পারি না। মাদ্রাসার বইয়ে ‘হিন্দু’ চেয়ারম্যানের নাম না থাকা প্রসঙ্গে সদস্য ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী বলেন, মাদ্রাসার বইয়ে চেয়ারম্যানের নাম বহাল নিয়ে ব্যাপক সংগ্রাম করেছি। কিন্তু পারিনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, যে ভুলত্রুটি ধরা পড়েছে তা খুব দ্রুত সংশোধন করা হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হেফাজতের মতাদর্শের কিছু ছাপ প্রাথমিকের বইয়ে পাওয়া যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেফাজতের চেতনায় নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাবে। সারাদেশে বিতরণ করা বইয়ে কীভাবে সংশোধনী আনবেন তা খোলাসা করেননি মন্ত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, যদি কোন পরিবর্তন যৌক্তিক ও স্বাভাবিক হয় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু যদি বিশেষ গোষ্ঠীর কথা অনুসারে হয় এবং সেখানে যৌক্তিকতা না থাকে তাহলে তো প্রশ্ন আসবেই। আর ভুলের বিষয়ে আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি যে, এনসিটিবিতে লেংগুয়েজ এডিটর, প্রুভ রিডার দরকার। কিন্তু হয়নি। আমার মনে হয় বইয়ের এই কাজটা কখনই ঠিকভাবে হয় না। কারও কবিতা ইচ্ছে মতো লেখার ঘটনাকে হতাশাজনক ও শিক্ষার জন্য ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করেন এ শিক্ষাবিদ। পাঠ্যবইয়ে ভুল হওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের স্ট্রং পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কারণ (শিক্ষাখাতে) যেটুকু সুনাম হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বইয়ে ঘন ঘন পরিবর্তন করলে শিশুদের ওপর তার প্রভাব পড়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিজে বানিয়ে কিছু লিখে দিলাম সেটা উচিত নয়। ভাষারও একটা স্বকীয়তা আছে, সেটা না জানলে সমস্যা। পাঠ্যবই থেকে যুক্তাক্ষর তুলে দেয়া ‘অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত’ বলে মন্তব্য করেন এ অধ্যাপক। সব কিছুকেই কেন সহজ করতে হবে? ছোটবেলায় যদি যুক্তবর্ণ না শেখে তাহলে কখন শিখবে? কানাডায় বিদ্যালয়গুলোতে তিনটি ভাষা শেখানোর প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, মাতৃভাষা যদি সহজ করে শেখাতে হয় এটা তুঘলকি কা-, এগুলো পরিহার করতে হবে। কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাসের প্রসিদ্ধ এই কবিতার এমন বিকৃতিতে সমালোচনার ঝড় চলছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পাঠ্য রচয়িতাদের তুলোধুনো করছেন তারা ন্যূনতম দায়বদ্ধতা না দেখানোয়। এ বিষয়ে শর্মা লুনা নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, ‘৪র্থ লাইনেও ভুল, সঠিক হবে: মানুষ হইতে হবে এই যার পণ; নবম লাইনেও ভুল, সঠিক হবে: সে ছেলে কে চায় বল কথায় কথায়। দাড়ি কমার ফালতু ব্যবহার। লেখকের হুবহু লেখা দেয়নি। তৃতীয় ব্যক্তির পা-িত্যে কবিতাটি ধর্ষিত হয়েছে।” নাজমুল হক নামে আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী বলেন, “চাই আর চায়- এর পার্থক্য তফাত বোঝে না।...” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোঃ দেলোয়ার হোসেন শেখ পাঠ্যবই প্রণয়নে সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বলন, শিশুরা এখন থেকেই যদি ভুল শেখে তাহলে আজীবন তা তাদের মধ্যে থেকে যাবে। সবারই যে কোন এক ধরনের বানানরীতি অনুসরণ করা উচিত। পাঠ্যপুস্তকে ভুল থাকার জন্য যারা দায়ী তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। শুধু সংশোধনী দিলেই হবে না। আমি মনে করি শিশুদের বইগুলো নতুন করে মুদ্রণ করে দেয়া উচিত। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ইতোমধ্যেই বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠা এবং দেশে জঙ্গীবাদের জন্ম না হওয়ার জন্য পাঠ্যবইয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা দেখলাম, ইতিবাচক পরিবর্তনের বদলে পাঠ্যবইয়ে নেতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই নেতিবাচক পরিবর্তন কাদের স্বার্থে করা হলো? এই আপস কার স্বার্থে? এই সরকারের আমলেও যদি এগুলো অব্যাহত থাকে তাহলে জাতির কপালে দুর্ভোগ আছে।
×