ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কেটের আগুন কি নাশকতা, না অন্য কিছু

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

মার্কেটের আগুন কি নাশকতা, না অন্য কিছু

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর গুলশানে ডিএনসিসি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন জায়গা দখলে নিতেই এই আগুন লাগানো হয়েছে। ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হক বলছেন বৈদ্যুতিক গোলযোগেই আগুন লাগতে পারে। সঠিক কারণ জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসও। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি নিছকই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত নাশকতা- তা খতিয়ে দেখতে সব পক্ষকে নিয়ে তদন্ত করতে বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। অন্যদিকে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের গাফিলতির কথাও বলেছেন অনেক ব্যবসায়ী। পাকা মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এসএম তালাল রিজভী বলেন, রাত আড়াইটার দিকে আগুন লেগেছে খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘তখন ফায়ার সার্ভিসের মাত্র দুটি ইউনিট ছিল। ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটের স্বল্পতার কারণে দুই মার্কেটই আগুনে পুড়েছে। ভোর ৪টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট বাড়ানো হয়। আগে বাড়ালে ক্ষতি এত হতো না।’ ফায়ার সার্ভিস তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ জানাতে না পারলেও দুই মার্কেট মিলিয়ে কমপক্ষে দেড় শ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করেন রিজভী। ১২৯ নম্বর দোকানের মালিক মোঃ বাবু বলেন, ‘মার্কেট বিক্রি হয়েছে কয়েক বার। ভাঙতে না পেরে সিস্টেমে ফেলে দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে কেউ আগুন দিয়েছে।’ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেনের ছিল খেলনার দোকান। দু’দিন আগে নতুন মাল তুলেছিলেন তিনি। দেলোয়ার বলেন, ‘একটা সুতাও বের করতে পারি নাই। সব জিনিসপত্র ছাই হয়ে গেছে। যারা মার্কেট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করছিল তারাই আগুন দিয়েছে। এই মার্কেটটা ঘিরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হতো।’ ডিসিসি কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি ১৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন সিদ্দিকী জানান, সাত বিঘা জমির ওপর এই মার্কেটের পাকা মার্কেট অংশটি আছে ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে। ১৯৮২ সালে সিটি কর্পোরেশন কাঁচা মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেয়। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সময়ে মার্কেটের জায়গায় পিপিপির আওতায় ১৮ তলা গুলশান ট্রেড সেন্টার নির্মাণের দরপত্র দেয়া হয়। সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েও তা করতে অপারগতা জানালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা মেট্রো গ্রুপের আমিন এ্যাসোসিয়েটস ওভারসিজ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। তিনি আরও জানান, ওই চুক্তিতে বলা হয়, ভবনের আটতলা পর্যন্ত থাকবে দোকান, নয় থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত হবে অফিস। দুই হাজার ২৪টি দোকানের মধ্যে ডিসিসি পাবে ২৭ শতাংশ। আর আমিন এ্যাসোসিয়েটস ৭৩ শতাংশ দোকান পাবে এবং তা বিক্রি করে লাভ তুলে নেবে। কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই চুক্তি স্থগিত করে ভবনে ডিসিসির মালিকানা বাড়াতে বলা হয়। এরপর ডিসিসির মালিকানা বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করে নতুন চুক্তি হয়। কিন্তু দোকান মালিক সমিতি এরপর মামলা করলে ঠিকাদার কোম্পানি সেখানে আর ভবন তুলতে পারেনি বলে জানান ডিসিসি কাঁচাবাজার ব্যসায়ী সমিতির এই সহ-সভাপতি। ডিসিসি কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ দাবি করেন, ‘সিটি কর্পোরেশনের কিছু অসাধু কর্মচারী এবং মেট্রো গ্রুপ এই নাশকতার সঙ্গে জড়িত।’ ডিসিসি পাকা মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সহ-সভাপতি জয়নাল আবেদীনও একই সন্দেহের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা পরিকল্পিতভাবে কেউ করেছে। আমরা দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’ তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলছেন, নাশকতা নয়, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই আগুন লেগেছে বলে তিনি ধারণা করছেন। মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পর তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে মনে হচ্ছে, আগুন ইলেক্ট্রিসিটি থেকেই লেগেছে। এখানে এত বেশি ফ্লেইমেবল প্রোডাক্টস, খাবার, পারফিউম ছিল। যার ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেছে। আপনারা দেখেছেন দোতলার একটি অংশ ধসে গেছে। আমাদের জানা মতে, কোন হতাহত হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, ‘নাশকতা কিনা, এটা মেয়রের পক্ষে বলা সম্ভব না, মেয়র নাশকতা এক্সপার্ট না। পুলিশ ভাল বলতে পারবে। তবে মেয়র হিসেবে আমার মনে হয়, নাশকতা না হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ পারসেন্ট।’ মার্কেটের আগুন কীভাবে লেগেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানাতে পারেননি ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স এ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটা বিল্ডিং কলাপস করেছে। কোন ক্যাজুয়ালটি হয়নি। এখানে কমবাস্টেবল ও ফ্লেইম্লে লিকুইড ছড়িয়ে আছে। ডেঞ্জারাস জিনিসপত্র আছে।’ আগুন লাগার কারণ তদন্তের পরই জানা যাবে বলে জানান তিনি। মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক সাংবাদিকদের বলেন, এ অগ্নিকা- দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত নাশকতা তা খতিয়ে দেখতে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি পুলিশ, দোকান মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা একটি তদন্ত কমিটি করা উচিত। পরিস্থিতি দেখার পর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগে। কখনও বস্তির ঘর পুড়ে যায়, কখনও দোকানপাট পুড়ে যায়। সেখানে যারা বসবাস করত, তারা চলে গিয়ে আরও কিছু নতুন লোকজন সেখানে বসবাস করা শুরু করে। এভাবে চলতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘গুলশানে কীভাবে আগুন লেগেছে- তা নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিতভাবে কেউ আগুন লাগিয়েছে তা তদন্ত করে খুঁজে বের করতে হবে।’ এই তদন্তের দায়িত্ব কেবল ফায়ার সার্ভিসের ওপর না দিয়ে পুলিশ, দোকান মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা একটি তদন্ত কমিটি করে আগুনের কারণ খুঁজে বের করতে বলেন তিনি। রিয়াজুল হক বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা হলে কীভাবে তার সমাধান করা যায় সে বিষয়েও ওই তদন্ত কমিটি সুপারিশ করবে। ব্যবসায়ীরা ফায়ার সার্ভিসের কাজে ধীরগতির অভিযোগ আনলেও অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ফায়ার সার্ভিস বলছে, মার্কেটে অগ্নি নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাঁচা মার্কেট সমিতির সহ-সভাপতি হুমায়ুন সিদ্দিকী বলেন, তাদের গোটা ১৫ এক্সটিংগুইশার ছিল। আগুন লাগার পর সেগুলো ব্যবহার করে নেভানোর চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
×