ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোহ্ওয়ার্দী উদ্যানে জাপা মহাসমাবেশে এরশাদ

আরেকবার ক্ষমতায় যাওয়াই আমার শেষ চাওয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২ জানুয়ারি ২০১৭

আরেকবার ক্ষমতায় যাওয়াই আমার শেষ চাওয়া

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সারাদেশের নেতাকর্মীদের ডেকে জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা জানালেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বলেছেন, ‘আমার জীবনের শেষ চাওয়া হলো জাতীয় পার্টির আরেকবার ক্ষমতায় নিয়ে যাবে তোমরা’। আগামীতে একক নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। হয়ত এটাই শেষ নির্বাচন। তোমাদের কাছে বেঁচে থাকতে চাই। ক্ষমতায় যেতে চাই। জাপাকে ক্ষমতায় এনে তোমরা আমাকে নতুন জীবন দাও। কারণ জাতীয় পার্টির ক্ষমতায় যাওয়ার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এজন্য দল শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়ে নেতাকর্মীদের তিনি বলেন, দল শক্তিশালী হলে ক্ষমতার দ্বারে আমরা পৌঁছাবই। রবিবার রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ১৪ দফা ইশতেহারও ঘোষণা করেন এরশাদ। দেশের ৬৪ জেলার নেতাকর্মীরা সমাবেশে অংশ নেন। ঢাক-ঢোলের তালে তালে সকাল থেকে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নামে নেতাকর্মীদের ঢল। অনেকেই হাতি, ঘোড়ার গাড়িসহ মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। এতে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। সমাবেশ কেন্দ্র করে সকাল থেকেই রাজধানীতে যানজটের সৃষ্টি হয়। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে এরশাদ বলেন, তোমাদের মনে সন্দেহ রয়েছে আগামী নির্বাচন আমরা কিভাবে করব এ নিয়ে। তিনি বলেন, আমাদের আর কারও সঙ্গে হাত মেলানোর প্রয়োজন নেই। জোটগত নির্বাচন করে জাপা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাই না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ বলেন, আমরা একক নির্বাচনে ভাল ফল করেছিলাম। জোটগত নির্বাচন করে আমাদের আসন কমেছে। আজকের লাখো মানুষের মহাসমাবেশ প্রমাণ করে জাতীয় পার্টি এককভাবেই ক্ষমতা যাওয়ার শক্তি অর্জন করেছে। একক নির্বাচনের জন্য জাতীয় প্রস্তুত আছে। তাই আমরা আগামীকে এককভাবেই নির্বাচন করব। তোমরা সারাদেশে এ খবর ছড়িয়ে দাও। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় গেলে দেশের জন্য কী কী করবে- নিজ বক্তব্যে ১৪ দফা ইশতেহার তুলে ধরেন জাপা চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ক্ষমতায় গেলে আমরা প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু করব। এই সরকার দিয়ে আমরা উপকৃত হইনি, জনগণ নিষ্পেষিত হয়েছে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। এ থেকে মুক্তি চাই। নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের কথা তুলে ধরে এরশাদ বলেন, ক্ষমতা গেলে পূর্ণাঙ্গ উপজেলা পদ্ধতি চালু করব। ক্ষমতায়ন করা হবে উপজেলা চেয়ারম্যানদের। এছাড়া বিচার ব্যবস্থা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সকল বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠনের ঘোষণা দিয়ে এরশাদ বলেন, ঘরে ঘরে বিদ্যুত দেব। শিল্পয়নের মাধ্যমে বেকারদের চাকরির ব্যবস্থা করার ঘোষণা দিয়ে এরশাদ বলেন, প্রত্যেক উপজেলায় গুচ্ছগ্রাম করে দেব। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় এলে বিদেশের দরজা খুলে যাবে। তখন কর্মসংস্থানের জন্য লাখ লাখ মানুষের বিদেশ যাবার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়াও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংসদীয় কোটা, চাকরিতে কোটা, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা এবং জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ আইন প্রণয়ন, সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান এবং সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ঘুষ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন, চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, বাল্যবিয়ে রোধ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে- মহাসড়কে ডিভাইডার নির্মাণ এবং সড়ক প্রশস্তুকরণ। জাতীয় পার্টি থেকে চলে যাওয়া নেতাদের ফের ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়ে সমাবেশে দলের সিনিয়র কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বলেন, জাতীয় পার্টি কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবে না। অনেকেই আমাদের সমালোচনা করেন। দেশে এখন কোথায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র নেই। দেশের অবস্থা ভাল নেই মন্তব্য করে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, যে কোন মূল্যে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নেতাকর্মীদের দাবির প্রেক্ষিতে রওশন বলেন, দলের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যান। মামলার ব্যাপারে আমি দায়িত্ব নিলাম। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হবেই। মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন দলের কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সালমা ইসলাম, সাহিদুর রহমান টেপা, এস এম ফয়সল চিশতী, হাজী সাইফুদ্দিন মিলন, এটিইউ তাজ রহমান, মেজর (অব) খালেদ আখতার, আশরাফ সিদ্দিকী, একেএম আসরাফুজ্জামান খান প্রমুখ। কর্মীদের তোপের মুখে রওশন-আনিস ॥ সমাবেশ চলাকালীন সময়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বক্তব্য রাখার সময় কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখার দাবি জানিয়ে সেøাগান দিলে আনিস দ্রুত তার বক্তব্য শেষ করে দেন। পরবর্তীতে রওশন এরশাদ বক্তব্য শুরু করলে কর্মীরা এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের কি করলেন জানতে চান। একপর্যায়ে পুরো মাঠের কর্মীরা এরশাদের মামলা প্রত্যাহারের সেøাগান দিতে থাকলে এরশাদ দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানান। বলেন, চিন্তা করও না মামলা প্রত্যাহার হবে। এরপর রওশন বলেন, আমিও চাই মামলাগুলো প্রত্যাহার হোক। আপনারা চিন্তা করবেন না। মামলা প্রত্যাহার হবে। তোমরা আমার প্রতি আস্থা রাখ। হাওলাদার-বাবলার শোডাউন ॥ দলের ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মহাসমাবেশে শোডাউন করেছেন দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার এবং ঢাকা-৪ আসনের জাপার এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। সমাবেশে তারা তাদের নির্বাচনী এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে সমাবেশে উপস্থিত হন। বাবলা তার নির্বাচনী এলাকা রাজধানীর শ্যামপুর কদমতলী থেকে ১৩ থেকে ১৫ হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশে বিশাল মিছিল নিয়ে যোগদান করেন। এই সময় মিছিলে এরশাদ, রওশন এরশাদ ও বাবলার বিশাল আকৃতির ছবি শোভা পায়। ভ্যানের ওপর বিশাল আকতির লাঙ্গলসহ নানা রংয়ের সাজসজ্জায় নেচে গেয়ে মিছিলে অংশ নেন শ্যামপুর কদমতলীর হাজার হাজার জাপার নেতাকর্মী সমর্থক ও সাধারণ মানুষ। আমাদের ভোটারদের ৭০ ভাগ ভোটারের বয়স ২৪ কিংবা তার নিচে উল্লেখ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন, এই তারুণ্য এখন আমাদের শক্তি। তরুণরা যুগে যুগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। তারাই পরিবর্তনের কা-ারি। তারাই দেশের সম্পদ। আগামী নির্বাচনে এই তরুণরাই হবে প্রধান শক্তি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ দেশের চরম ক্রান্তিলগ্নে আমার উপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল এ কথা উল্লেখ করে ক্ষমতাকালীন সময়ের নানা ঘটনা তুলে ধরেন। বলেন কাউকে হত্যা কিংবা কাউকে দেশান্তরিত করে আমি ক্ষমতা লাভ করিনি। তাঁর শাসনামল ও বর্তমান শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে এরশাদ বলেন, আজ দেশের কী পরিস্থিতি? আমরা ২৬ বছর আগে যখন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলামÑ তখন মানুষ যতটুকু শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বাস করতে পেরেছে এখন কী সেভাবে পাচ্ছে? আমরা যে সুশাসন উন্নয়নের ধারা প্রবর্তন করেছিলাম তা-কি এখনও বহাল আছে? থাকতে পারছে? এখন আমরা দেশে কী দেখতে পাচ্ছি। আমরা খবরের কাগজ খুললেই প্রতিদিন দেখতে পাই- খুন-গুম, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, যৌতুকের বলি, এ্যাসিড সন্ত্রাস, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাংচুর, দলীয় কোন্দলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এই ধরনের সব খবর। এই দৃশ্য দেখার জন্যই কী জনগণ দেশকে স্বাধীন করেছিল। তিনি বলেন, এদেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিলাম। তাহলে কেন আজ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে? কোন পুরোহিত, পাদ্রি, ভিক্ষুরা হামলার শিকার হচ্ছে? কোন নিরীহ মানুষদের জঙ্গীদের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে, কোন সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর লুট হচ্ছে? তাদের জায়গা-জমি বেদখল হচ্ছে? এসব তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন হতে পারে না। আমি দ্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই- যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাচ্ছে, তাদের সম্পদ লুট করছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে এসবের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, গত ২৬ বছর ধরে আমরা কঠিন সময় অতিক্রম করে চলছি, এখনও আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্যে আছি।
×