ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কর্ণফুলী টানেল, মীরসরাই ইকোনমিক জোন ও চীনা ইকোনমিক জোন বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে তিন মেগা প্রকল্পের সূচনা বিদায়ী বছরে

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১ জানুয়ারি ২০১৭

চট্টগ্রামে তিন মেগা প্রকল্পের সূচনা বিদায়ী বছরে

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রমের শুভ সূচনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ২০১৬ সাল। বিদায়ী বছরেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল, আনোয়ারায় চীনা ইকোনমিক জোন এবং দেশের বৃহত্তম মীরসরাই ইকোনমিক জোন বাস্তবায়নের কাজ। বৃহৎ এই তিন প্রকল্পের মধ্যে যৌথভাবে প্রথম দুই প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে শুরু হওয়ার অপেক্ষায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপনের কাজ। এই তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে চট্টগ্রাম, যার প্রভাব পড়বে সারাদেশে। কর্ণফুলীর তলদেশে হতে যাচ্ছে উপমহাদেশের প্রথম টানেল, যা সুড়ঙ্গপথে যুক্ত করবে নদীর এপার-ওপারকে। চীনের সাংহাইয়ের আদলে চট্টগ্রাম রূপ নেবে ওয়ান সিটি টু টাউনে। চীনের অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে। টানেলকে ঘিরে রয়েছে বিশাল পরিকল্পনা। চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে শুরু হওয়া মেরিন ড্রাইভ এ টানেলের ভেতর দিয়ে পৌঁছবে কক্সবাজার পর্যন্ত। ভবিষ্যতে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত সংযোগ স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ এবং চীন সরকার। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৩৯ ফুট থেকে ১১৮ ফুট গভীরতার দুই টিউববিশিষ্ট এই টানেল দৃষ্টিনন্দন যেমন হবে তেমনিভাবে দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বিরাট ভূমিকা। ভিত্তিস্থাপনের মধ্য দিয়ে সকল অনিশ্চয়তা দূরীভূত হওয়ায় স্বপ্নের এই পরিকল্পনা এখন আর অলীক নয়। নতুন বছরের শুরুতেই পুরোদমে কাজ শুরু করা যাবে বলে আশা করছেন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের টানেল প্রকল্পটি স্বপ্নবিলাসী এক পরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত হলেও সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী ইফতেখার কবির জনকণ্ঠকে জানান, চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড়করণসহ কাজ শুরুর পূর্বে ৮টি শর্ত রয়েছে। এ শর্তগুলোর সবই পূরণ করেছি আমরা। কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে ঢাকার চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে। চীনের এক্সিম ব্যাংক আগামী ৫ বছরে ধাপে ধাপে অর্থ প্রদান করবে। ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণসহ মাঠ পর্যায়ের প্রাথমিক কাজগুলো প্রায় শেষ। কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে না গড়ালেও টানেল নির্মাণের ওয়ার্মআপ পুরোদমে চলছে। যারা নির্মাণ করবেন তারা টানেলের ডিজাইন কাজ শেষ করে এনেছেন। ঠিকাদারদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে। টানেল নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য এর সীমানা চিহ্নিত হয়েছে অনেকে আগেই। চট্টগ্রাম নগরীর নেভাল পয়েন্ট এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে কর্ণফুলী টানেলের ফলক। স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ করবে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। অভিজ্ঞ এ প্রতিষ্ঠান চীন ছাড়াও বিভিন্ন দেশে টানেল নির্মাণ করেছে। টানেলের অর্থায়ন করছে চীনের রাষ্ট্রায়াত্ত এক্সিম ব্যাংক। শর্ত পূরণ প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই মিলেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), পরিবেশ অধিদফতর, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো), নগর উন্নয়ন অধিদফতর এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের ছাড়পত্র। নক্সা অনুযায়ী কর্ণফুলী টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ হাজার ৫ মিটার বা ৩ কিলোমিটারের চেয়ে সামান্য বেশি। চট্টগ্রাম নগরীর নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে তলদেশে ঢুকে তা বেরুবে ওপারে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এবং চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝামাঝি স্থান দিয়ে। নদীর তলদেশে এর গভীরতা হবে ৩৯ ফুট (১২ মিটার) থেকে ১১৮ ফুট (৩৬ মিটার)। মোট দুটি টিউব নির্মিত হবে। এর একটি দিয়ে গাড়ি শহরপ্রান্ত থেকে প্রবেশ করবে, আরেক টিউব দিয়ে ওপার থেকে শহরের দিকে আসবে। টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়ায় হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার ৩৫ ফুট এবং উচ্চতায় হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউবে বসানো হবে দুটি স্কেল। এর উপর দিয়ে দুই লেনে গাড়ি চলাচল করবে। পাশে হবে আরও একটি টিউব। যে কোন বড় যানবাহন খুব স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারবে এই টানেল দিয়ে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজটি হাতে নেয়া হয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বিবেচনায় নিয়ে। মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। এই সড়ক যাবে টানেলের ভেতর দিয়ে। চট্টগ্রাম নগরীর বাস্তবায়নাধীন আউটার রিং রোড কাজ করবে টানেলের এপ্রোচ সড়ক হিসেবে। নগরী থেকে টানেল অতিক্রম করে মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার যাবে আনোয়ারা উপজেলা হয়ে। সেই আনোয়ারাতেই বাস্তবায়িত হবে চীনা ইকোনোমিক জোন। উত্তর দিকে এই মেরিন ড্রাইভ চলে যাবে বাস্তবায়নাধীন দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল মীরসরাই ইকোনোমিক জোন পর্যন্ত। আবার মীরসরাই ইকোনোমিক জোন সম্প্রসারিত হচ্ছে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার উপকূলীয় এলাকা পর্যন্ত। এছাড়া মীরসরাই-সীতাকু-ের মাঝামাঝি এলাকায় নির্মিত হবে মাঝারি সাইজের একটি সমুদ্র বন্দর। তাছাড়া মীরসরাই ইকোনোমিক জোনকে কেন্দ্র করে ছোট একটি বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাও রয়েছে। চট্টগ্রামকে ঘিরে গ্রহণ করা হয়েছে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা। কর্ণফুলী টানেল হয়ে যে সড়ক কক্সবাজার যাবে তা কোন এক সময়ে মিয়ানমার হয়ে প্রসারিত হবে চীনের কুনমিং সিটি পর্যন্ত। মহাপরিকল্পনার আওতায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বিদ্যুত হাব। মহেশখালীর মাতারবাড়িতে হচ্ছে এলএনজি টার্মিনাল। এই কর্মযজ্ঞ পৃথকভাবে চলমান থাকলেও মূলত সরকারের মেগা উন্নয়ন পরিকল্পনারই অংশ। টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনসহ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে পাল্টে যাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের চেহারা, আর এর ছোঁয়া লাগবে সারাদেশে। কারণ, এই চট্টগ্রাম হয়ে খুলে যাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বার। মীরসরাই ইকোনমিক জোন ॥ ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মহাপরিকল্পনা বিবেচনায় নিয়ে দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছে বর্তমান সরকার। এর মধ্যে বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চলটি হবে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে। চীনা ইকোনমিক জোন ॥ চট্টগ্রামের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে চীনের। কেননা, এখানেই দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। তাছাড়া চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পূর্বমুখী হওয়া সম্ভব নয়। চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে ভিত্তি স্থাপিত হয় আনোয়ারায় চীনা ইকোনমিক জোন প্রকল্পের। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।
×