ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ শহর ঢাকার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান শাহবাগ মোড়। জায়গাটির আলাদা খ্যাতি। স্বতন্ত্র আবেদন। গণজাগরণ মঞ্চের ঐতিহাসিক আন্দোলন এখান থেকেই সূচিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের প্রতিবাদের তীর্থভূমি হিসেবে সারাদেশে পরিচিতি অর্জন করেছে শাহবাগ। কিন্তু চোখে লেগে থাকা শাহবাগ মোড়ের চেহারাচরিত্র হঠাৎই বদলে দেয় একটি ডিজিটাল বিলবোর্ড। বিলবোর্ড বললে ভাল বোঝানো যাবে না। বিশাল জায়গা দখল করে এখানে দাঁড় করানো হয়েছে ডিসপ্লে টাওয়ার। প্রাণহীন কংক্রিটের স্থাপনা জগদ্দলের মতো শাহবাগের বুকে চেপে আছে। ত্রিকোণাকৃতি ডিজিটাল ডিসপ্লের অতি উজ্জ্বল আলো দুর্ঘটনাপ্রবণ শাহবাগ মোড়ের বিপদ আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘরের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেকে দেয় পুরোপুরি। শাহবাগ মোড় পেছনে ফেললে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা অনুষদ, জাতীয় গণগ্রন্থাগার। বাঙালী সংস্কৃতির প্রধান উৎসবগুলো এখানে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়। কিন্তু বিলবোর্ড স্থাপনের পর সব সবই আড়ালে চলে যায়। বিলবোর্ডের অন্যপাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। বারডেম হাসপাতাল। বিলবোর্ডের মনিটরের বিকট আওয়াজ দুটি হাসপাতালের রোগীকে ঘুমোতে দেয় না। এমনকি শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে এতকাল যে খোলা আকাশটি দেখা যেত সেটিও ঢেকে দিয়েছে বিজ্ঞাপন প্রচারের যন্ত্র! সুউচ্চ ডিসপ্লে টাওয়ারে বসানো এলইডি মনিটর থেকে বিস্কুট জুস চানাচুর মসলা টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন চলে বেশ কিছুদিন। তার পর বন্ধ। অজস্র অভিযোগ-আপত্তির মুখে বিলবোর্ডটি গত ১১ মাস ধরে বন্ধ। যতদ্রুত সম্ভব স্থাপনাটি এখান থেকে সরানো হবে- এমনটিই আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে জানা যায় নতুন তথ্য। সরানোর পরিবর্তে আবারও বিলবোর্ডটি চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এমন খবরে আবারও আলোচনায় চলে এসেছে শাহবাগের বিলবোর্ড। বিদায়ী বছরের শুরুর দিকে শাহবাগ মোড়ে এই বিলবোর্ড বসানো হয়। ডিসপ্লে টাওয়ারটির উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার। টাওয়ারের ওপর ২৫ ফুট দৈর্র্র্ঘ্যেের এবং ১০ ফুট প্রস্থের তিনটি মনিটর। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ‘শোয়িং প্ল্যানড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ নামে ১৪ কোটি টাকার একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রকল্পের অধীনে ডিজিটাল বোর্ডটি স্থাপন করা হয়। এ কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। কারিগরি সহায়তা ডিজিটাল টেক নামের একটি প্রতিষ্ঠানের। উদ্বোধনের পর তিনটি বড় মনিটরের সাহায্যে প্রচার শুরু হয়। আর তখনই ধরা পড়তে থাকে ঘোরতর সব সমস্যা। বিলবোর্ডটির তীব্র এবং চঞ্চল আলো অনেকদূর থেকেই গাড়ি চালকদের চোখে আছড়ে পড়তে থাকে। মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হন চালকরা। গাড়ি চলাচলে মারাত্মক বিঘœ ঘটে। একইভাবে বিলবোর্ডটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য বিপদ ডেকে আনে। রাস্তাটির ওপর দিয়ে প্রচুর শিক্ষার্র্থীর নিত্য আসা-যাওয়া করে। রাস্তা পারাপারের সময় তাদেরও চোখ চলে যায় বিলবোর্ডের দিকে। দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রচার বন্ধ করা হয় বিলবোর্ডের। কিন্তু আবারও চালু করার প্রক্রিয়া বিশিষ্টজনদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল বিশিষ্ট জাদুঘরবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, জাতীয় জাদুঘর যেনতেন প্রতিষ্ঠান নয়। বাঙালী জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অপরিহার্য উপাদান প্রতিষ্ঠানটি সংরক্ষণ করে। প্রদর্শন করে। জাদুঘরকে বলা হয় জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ এমন একটি প্রতিষ্ঠানের চেহারা দেখা যায় না বিলবোর্ডটির কারণে। ভাবা যায়? জাদুঘরের এক কর্মকর্তা তো মারাত্মক রেগে গেলেন। বললেন, দুর্ভাগ্য যে, জাদুঘর বোঝার মতো লোক নেই আমাদের। তা না হলে কী করে এই প্রতিষ্ঠানটির নাকের ওপর টেলিভিশন বসিয়ে দেয়! ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জাদুঘর পরিদর্শনে আসেন জানিয়ে তিনি বলেন, দূর থেকে তারা জাদুঘর ভবনটি খুঁজে নিতে পারেন না। কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেনের সঙ্গেও। তিনি বলেন, আমাদের চারুকলা অনুষদে প্রবেশের পথে বিজ্ঞাপন বাক্স বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এর কোন নান্দনিক সৌন্দর্য নেই। সিমেন্টের ঢিবি বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য নষ্ট করা হয়েছে। আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করার আগে বিলবোর্ডটি সরিয়ে নেয়ার দাবি জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আনিস স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, এর আগেও এখানে একটি বিশাল বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল। সেটি কয়েকদিনের মাথায় তুলে নিতে বাধ্য করা হয়। এটির বেলায় তা-ই করা হবে বলে জানান তিনি। নিউ ভিশন সার্ভিসের বাস প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। একটি বাসের চালক আয়নুল বলেন, ‘চোখ দিয়া ভাই তাকানো লাগে না। আগেই চোখ ওই দিকে (বিলবোর্ড) চলে যায়। ধরেন, গানটান হয়। চোখ যাইব না? তখনই এক্সিডেন্টের অবস্থা হইয়া যায়। চালকদের পক্ষে এখান থেকে বিলবোর্ডটি সরানোর দাবি জানান তিনি। এবার নববর্ষের আলোচনাটা করা যাক। নববর্ষ মানে, ইংরেজী ২০১৭ সাল। হ্যাঁ, আসন্ন। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই নতুন ক্যালেন্ডার। তার আগে শহর ঢাকায় চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। থার্টিফার্স্ট নাইট নিয়ে কতশত পরিকল্পনা! তরুণদের একটি অংশ পাশ্চাত্যের অনুসরণে বরণ করার চেষ্টা করে নববর্ষ। রাত বারোটা বাজার আগে রাস্তায় নেমে যায়। এবারও ব্যতিক্রম হবে না। তবে উচ্ছৃঙ্খলতা সৃষ্টির চেষ্টা হলে বিপদেই পড়তে হবে। কারণ, পুলিশ প্রস্তুত! জানা গেছে, এবার ঢাকায় থার্টিফার্স্ট নাইটে নিরাপত্তার জন্য পোশাক ও সাদা পোশাকে ১০ হাজার পুলিশ নিয়োজিত থাকবে। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনে বলেন, শহর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে। কোন জঙ্গী সংগঠন হামলা করার সুযোগ পাবে না। জঙ্গী দমনে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে জানালেও পাশাপাশি শহরবাসীকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান তিনি। এদিকে, বৃহস্পতিবার থেকে ঢাবি চারুকলা অনুষদে শুরু হয়েছে জয়নুল মেলা। মেলায় বিভিন্ন লোকপণ্যের পসরা সাজানো হয়েছে। সব বিভাগের আছে আলাদা আলাদা স্টল। স্টলগুলোতে দারুণ ভিড় লেগে আছে। একইদিন চারুকলা ক্যাম্পাসে কিংবদন্তি শিল্পী জয়নুল আবেদিনের দুটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। অনন্যসাধারণ দুটি ভাস্কর্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে ক্যাম্পাসে। তিন দিনব্যাপী মেলা শনিবার পর্যন্ত চলবে। এ সময়ের মধ্যে একবারটি ঘুরে আসা আনন্দের হবে বৈকি!
×