ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

সপ্তম অধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ বছরের প্রথম পর্ব- ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ (গতকালের পর) সামান্য একটি কথা এখানে বলা যায় সেটি হলো আমার ওয়াশিংটনে পদায়নের বিষয়ে। ওয়াশিংটনে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর পদবিটি ছিল অত্যন্ত কাক্সিক্ষত একটি পদ। যেখানে দায়িত্বও ছিল ব্যাপক এবং সে জন্য উৎকৃষ্টভাবে কাজ করার সুযোগও ছিল অনন্ত। এই পদে পদায়নের জন্য প্রতিযোগিতা ছিল অত্যন্ত প্রকট। আমি যে এই পদের জন্য প্রার্থী সেই বার্তাটি আমি যথাসময়ে উচ্চমহলের নজরে আনি। ওয়াশিংটনে তখন একজন বাঙালী এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন প্রথম সচিব হিসেবে। কাউন্সিলররা অন্ততপক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতি না পেলে কাউন্সিলর পদমর্যাদা পেতে পারতেন না। তখনকার ওয়াশিংটনের প্রথম সচিব আমাকে জানালেন যে, তিনি উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন সে জন্য কিছু সময় পেলে কাউন্সিলর হিসেবে ওয়াশিংটনেই পদায়িত হতে পারেন। তিনি আমাকে জানালেন যে, তার সামান্য মেয়াদ বৃদ্ধি হলেই তিনি সেই সুযোগটি পাবেন। আমার তাতে কোন আপত্তি ছিল না। কারণ আমি ১৯৬৮ সালেই সে পদের জন্য নির্বাচিত হয়ে যাই। এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটিও বেশ ঝামেলাপূর্ণ ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব তার প্রার্থীর জন্য খুব জোর তদ্বির চালাচ্ছিলেন। তিনি যখন খুব বেশি এগুতে পারলেন না তখন শেষ অস্ত্র হিসেবে যুক্তি দিলেন যে, আমি ইকোনমিক পুলের সদস্য নই। এই যুক্তির মধ্যে আংশিক সততা ছিল। আমি ইকোনমিক পুলের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করি এবং অনেকেই করেন। সিএসপি কর্মকর্তাদের জন্য এই আবেদনটি ছিল একান্তই লৌকিক। কোন সিএসপি কর্মকর্তা ইকোনমিক পুলের সদস্য হতে চাইলেই সেটি বিনা প্রশ্নে মঞ্জুর করা হতো, তবে সংখ্যা সব সময়ে সীমিত ছিল। দুর্ভাগ্যবশত সেই নিযুক্তি প্রক্রিয়া যথাসময়ে সম্পাদিত হতে পারল না। তার ফলে লৌকিকভাবে আমি পুলের সদস্য ছিলাম না। এই যুক্তিটি শেষ বিচারে টিকল না। অতিরিক্ত সচিব প্রস্তাব করলেন যে, এই পদে দু’জন প্রার্থীকে বিবেচনা করা যায়। একজন আমি এবং অন্যজন তার মনোনীত প্রার্থী। সেইখানে তিনি বলতে ভুললেন না যে, আমি লৌকিকভাবে ইকোনমিক পুলের সদস্য নই। তখন অর্থ বিভাগের সচিব ছিলেন সেই দেশের প্রথিতযশা একজন পাঠান কর্মকর্তা গোলাম ইসহাক খান। তিনি পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অবসর নেন। তিনি প্রস্তাবটি যখন মন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠালেন তখন বলে দিলেন যে, এই পদে সারা পাকিস্তানে আমার চেয়ে অন্য কোন যোগ্য কর্মকর্তা ছিল না। এই মন্তব্যে আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবও বেশ অসন্তুষ্ট হন এবং তাদেরই কল্যাণে এই খবর ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক কাউন্সিলরের পদটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রথমেই বলা উচিত যে, সাহিত্যের ছাত্র থেকে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ হওয়ার ইতোমধ্যে আমি যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম সেইটির পালে হাওরের হাওয়া লাগল। বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশ এবং ধারা সম্বন্ধেও সেই সময় আমার জ্ঞানোদয় হতে থাকে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নেগোশিয়েশনেও আমার সেখানেই হাতেখড়ি হয়। কাকতালীয়ভাবে আমি বিশ্ব পরিম-লের অর্থনৈতিক বিভিন্ন উদ্যোগে তখনই শামিল হতে থাকি। সামান্য ব্যবধানে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলে আমার সেই সুযোগ আরও প্রসারিত হয়। আমি আগেই বলেছি যে, ১৯৬৯ এর মধ্যভাগে আমি ওয়াশিংটনে যাই এবং ১৯৭৪ এর শেষ মাসে আমি সেখান থেকে ম্যানিলায় রওনা হই। এই বিস্তৃত সময়ে ওয়াশিংটনে উপস্থিতি এবং বিশ্ব পরিম-লে কাজ করার সুবাদে আমার মনে হয় আমি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কলাকৌশলে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সময়ে ওয়াশিংটনে আমিই ছিলাম প্রথম বাঙালী কূটনীতিবিদ যে বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি আনুগত্য পরিবর্তন করেন। আমি ৩০ জুন ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করি এবং জেনারেল ইয়াহিয়াকে পত্র মারফত যুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশের প্রতি আমার আনুগত্য জানিয়ে দিই। বস্তুতপক্ষে ২৭ মার্চেই ঘোষণা দিই আমি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করলাম। পরবর্তী মাসে আমাদের মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। মে মাসে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে আমার ও আরও কয়েকজনের যোগাযোগ হয়। ১৯৬৮ সালের শেষ সময়ে ওয়াশিংটনে আমার নিযুক্তি পাকাপাকি হওয়ার পর আমি দুই মাসের ছুটি নেই। আমার ইচ্ছা ছিল যে, আমি সিলেট এবং ঢাকায় ছুটি উপভোগ করে রাওয়ালপিন্ডি যাব ১৯৬৯ সালের মার্চ বা এপ্রিলে। মে-তে ওয়াশিংটনে পাড়ি দেব। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সংসদ অধিবেশন শুরু হয় এবং মাস দুয়েক অধিবেশন চলবে বলে ধারণা ছিল। তাই ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে আমি রাওয়ালপিন্ডি ছেড়ে ওয়াশিংটন যাবার পরিকল্পনা করি। আমি আমার প্রিয় কিছু মালপত্র এবং বইয়ের সংগ্রহ ছাড়া সব কিছুই বিক্রয় করে দিই। কিছু বিশেষ ধরনের আসবাবপত্র ওয়াশিংটনে নিয়ে যাব বলে সেগুলো প্যাক করে নিই। আমি যে বাড়িতে ছিলাম সেটাও ছেড়ে দিই। সেই বাড়িটি তখন আমার প্রস্তাবিত উত্তরসূরি এবিএম গোলাম মোস্তাফাকে বরাদ্দ দেয়া হয়। আমার বাক্সবন্দী মালপত্র আমাদের এক পাঠান বন্ধু আকবর আজিজের স্যাটেলাইট টাউনের বাড়িতে রেখে যাই। আকবর এক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খানের মেয়েকে বিয়ে করেন। তারা দু’জনই আমাদের খুব আপনজন ছিলেন। তিনি কোন তেল কোম্পানিতে কাজ করতেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ম্যানিলায় আমাকে খুঁজে বের করেন এবং দেখা করতে আসেন। সেই মোলাকাত ভুলবার নয়; আকবর আমাকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে ক্রন্দন শুরু করেন। আমার সহায়ক পিলার আফুয়াং বুদ্ধি করে আমার খোলা দরজাটি বন্ধ করে দেয়। তা না করলে হয়ত আকবরের ক্রন্দন আমার দফতরে অনেক লোকের ভিড় সৃষ্টি করত। আকবরের সঙ্গে পরে পাকিস্তানে এবং সম্ভবত আমেরিকায় দেখা হয়। ডিসেম্বর মাসে আমরা সপরিবারে ঢাকায় পৌঁছি। আমার হিসাব ছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানের অবসান হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অতঃপর আমাকে সেখানে আরও সাত আট মাস থাকতে হয়। রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ফিদা হাসান ঢাকায় পৌঁছে আমাকে জানালেন যে, আমার ছুটি করা হবে বলে মনে হয় না। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধানের জন্য খুব সম্ভব একটি গোলটেবিল বৈঠক ডাকবেন। সেক্ষেত্রে আমাকে জানুয়ারি মাসেই ফিরে যেতে হবে এবং গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজনে লিপ্ত হতে হবে। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ঢাকায় ৬ ডিসেম্বরে একটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে জানিয়ে দিলেন যে, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হবে। আমাকে জানুয়ারি মাসেই রাওয়ালপিন্ডি ফিরতে হলো। চলবে...
×