ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘বুলেট’ ছিন্টু শোনান সেদিনের সেই সম্মুখযুদ্ধের কথা

হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে রামশীল যুদ্ধে ৪০ পাকসেনা খতম হলো

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে রামশীল যুদ্ধে ৪০ পাকসেনা খতম হলো

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ‘বরিশাল ও কোটালীপাড়ার সীমান্তবর্তী একটি গ্রামের নাম রামশীল। শতাধিক পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকাররা দ্বিতল লঞ্চযোগে রামশীল বাজারে আসে। পরে তারা রামশীল থেকে বাটরাবাজারের দিকে হেঁটে অগ্রসর হতে থাকে। এর পূর্বে আমরা হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত ভাইয়ের নেতৃত্বে ২৫ মুক্তিযোদ্ধা খালের দু’পাশে বাঙ্কার তৈরি করে বন্দুক তাক করে অবস্থান নিই। পাকিস্তানী সেনাদের দেখামাত্রই আমরা বৃষ্টিরমতো গুলিবর্ষণ শুরু করি। পাল্টা আক্রমণ চালায় পাকসেনারাও। ওদের ছোড়া গুলিতে মাদারীপুরের কালকিনি থানার গোপালপুর এলাকার বাসিন্দা সহযোদ্ধা মকবুল ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন হেমায়েত ভাই। চলতে থাকে গুলির লড়াই। তুমুল যুদ্ধ। আমাদের ছোড়া গুলিতে সেখানে নিহত হয় ৪০ পাকসেনা। এক পর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকসেনারা লঞ্চযোগে উজিরপুরের সাতলার দিকে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা নিহত পাকসেনাদের লাশ পয়সারহাট নদীতে ভাসিয়ে দেয়।’Ñ মহান বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই যুদ্ধদিনের স্মৃতি তুলে ধরছিলেন রণাঙ্গন কাঁপানো যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম ছিন্টু। সম্মুখযুদ্ধে বুলেটের মতো কার্যকর ভূমিকা পালন করায় রণাঙ্গনে বসেই তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘বুলেট’। সেই থেকে তিনি বুলেট ছিন্টু নামেই পরিচিত। বয়স ৭০-এর কোঠায় হলেও কাজকর্ম ও মনোবলে এখনও তিনি তরুণ। সংগঠনের কাজে ছুটে চলেন বুলেটের মতো। বেঁচে থাকা সহযোদ্ধাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ান ছায়ার মতোই। বরিশালের গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় সহযোদ্ধারা এখনও পাশে পাচ্ছেন তাকে। জনকণ্ঠকে মুক্তিযোদ্ধা বুলেট ছিন্টু বলেন, ‘পরে আমরা হেমায়েত ভাইকে নৌকাযোগে নিয়ে যাই রামশীলের জহরেরকান্দি গ্রামের এমবিবিএস চিকিৎসক সুরেন বাবুর কাছে। তিনি (সুরেন) হেমায়েত ভাইর মুখে ক্ষত ও রক্ত দেখে সেলাই করতে গিয়ে ঘাবড়ে যান। পরে আমি নিজ হাতে হেমায়েত ভাইয়ের মুখে সেলাই করি। চিকিৎসকের কাছ থেকে ফিরে আমি নিজেই নিহত মুক্তিযোদ্ধা মকবুলকে তার শ্বশুরবাড়ি আগৈলঝাড়ার রাজিহার ইউনিয়নের ভালুকসী গ্রামের ফকিরবাড়িতে নিয়ে দাফন করি।’ একান্ত আলাপনে সদালপী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু বর্ণনা করেন যুদ্ধদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি। বলেন, দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ জুন। রাত দুটার দিকে জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার বান্দাবাড়ীর নাগরা গ্রামের নদীর মাঝখানে নৌকায় অবস্থান করছিলাম আমরা ১২ মুক্তিযোদ্ধা। এমন সময় স্থানীয় রাজাকারদের ইশারায় অর্ধশতাধিক পাকিস্তানী পুলিশ আমাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে নদীর তীরে আসার জন্য হুকুম করে। নৌকার অগ্রভাগেই বন্দুক নিয়ে বসা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাসদস্য ইব্রাহিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন। আমি ছিলাম নৌকার মাঝখানে। নৌকা নদীর তীরে আসার পূর্ব মুহূর্তেই আমিসহ সহযোদ্ধা ইব্রাহিম ও হেমায়েত ভাই পাকিস্তানী মিলিশিয়া এবং রাজাকারদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকি। এতে ঘটনাস্থলেই এক পাকিস্তানী নিহত হয়। এ সময় পাকিস্তানী মিলিশিয়া ও রাজাকারের পাল্টাগুলিতে বুকে একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার কোলের ওপর লুটিয়ে পড়ে শহীদ হন সহযোদ্ধা ইব্রাহিম। একাধিক গুলি এসে বিদ্ধ হয় আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে। এক পর্যায়ে আমাদের রক্ষা করার জন্য হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন তার হাতে থাকা এলএমজি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে পালাতে থাকে পাকিস্তানী মিলিশিয়া ও রাজাকাররা। এসময় এলাকাবাসী ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা ধাওয়া করে ১৭ মিলিশিয়া ও ১৮ রাজাকারকে আটক করে তাদের হত্যা করে। পাকবাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল হেমায়েত বাহিনীতে যোগ দেয়ার পর আমার ও বাহিনীর প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বুলেট ছিন্টু আরও বলেন, সেদিন হেমায়েত বাহিনীর প্রথম সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন সহযোদ্ধা গাজীপুরের বাসিন্দা সেনাসদস্য মোঃ ইব্রাহিম। তিনি ছিলেন তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সেদিনের যুদ্ধ শেষে সহকর্মীরা আমাকে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় উদ্ধার করে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট এলাকার পল্লী চিকিৎসক রনজিত ব্যানার্জীর কাছে নিয়ে যায়। তিনিসহ তার পরিবারের সদস্যরা আমাকে চিকিৎসা করে শরীর থেকে একাধিক বুলেট বের করলে আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠি। পরে অন্যান্য সহযোদ্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিমকে পয়সারহাট সংলগ্ন রাজাপুরের একটি বাগানে নিয়ে কবর দিয়েছিলেন। সূত্রমতে, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সেনাবাহিনীর কমান্ডার কোটালীপাড়ার বাসিন্দা হেমায়েত উদ্দিন একটি এলএমজি, রাইফেল, বন্দুক গ্রেনেডসহ বিপুল গোলাবারুদ নিয়ে আগৈলঝাড়ার আহুতিবাটরা এলাকার সেনা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসেন। পরবর্তীতে বাটরা বাজারে বসেই তার নেতৃত্বে গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের হেমায়েত বাহিনী। প্রথমে এ বাহিনীতে আমরা ৪৫ সদস্য ছিলাম। ১৪ জুনের প্রথম যুদ্ধের পর ১৪ জুলাই দ্বিতীয় সম্মুখ যুদ্ধ হয় বরিশাল ও কোটালীপাড়ার সীমান্তবর্তী রামশীল গ্রামে। ওদিন শতাধিক পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকার দ্বিতল লঞ্চযোগে রামশীল বাজারে আসে। পরে তারা রামশীল থেকে বাটরাবাজারের দিকে হেঁটে অগ্রসর হতে থাকে। এর পূর্বে আমরা হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েতের নেতৃত্বে ২৫ মুক্তিযোদ্ধা খালের দুপাশে বাঙ্কার তৈরি করে অস্ত্রসহ অবস্থান নিই। এখানে যুদ্ধের এক পর্যায়ে ৪০ পাকসেনা নিহত হয়। আহত হন হেমায়েত ভাই। নিহত হয় আমাদের এক সহযোদ্ধা। যাকে নিজ হাতে দাফন করেছি। তিনি বলেন। তার ভাষ্য, সেদিন সহযোদ্ধার লাশ দাফন করতে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করি, প্রাণ গেলেও দেশের জন্য লড়ে যাব। দেশকে শত্রুমুক্ত না করে ঘরে ফিরব না। এর পর বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য যুদ্ধে ও চোরাগোপ্তা হামলার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখি। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক নিকটাত্মীয় ও সহকর্মীর অকালে চলে যাওয়ার কথা মনে পড়লে আজও চোখের জল ধরে রাখতে পারি না। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না একাত্তরের সেই স্মৃতিগুলো। তবে সহযোদ্ধা, আত্মীয়-স্বজনদের হারানোর পরেও ভাল লাগছে এই ভেবে যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজাকার-আলবদরদের বিচার হচ্ছে। একের পর এক রাজাকারের ফাঁসি হওয়ায় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এখন অনেকটাই আত্মতৃপ্ত। অবিলম্বে বাকি রাজাকারেরও বিচারের রায় কার্যকর করা হবে, এটাই আশা করি।
×