ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিজ্ঞাসাবাদে দুই নারী জঙ্গীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

মেজর জিয়া ও মারজানের বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা ছিল

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

মেজর জিয়া ও মারজানের বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা ছিল

শংকর কুমার দে ॥ রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গী আস্তানায় সন্তানসহ আত্মসমর্পণকারী দুই নারী জঙ্গী মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা জিজ্ঞাসাবাদে নব্য জেএমবির নেটওয়ার্ক এবং শীর্ষ জঙ্গী নেতা মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও নূরুল ইসলাম মারজানের বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এই মেজর জিয়া ও মারজান কি পলাতক, না গ্রেফতার- এ প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দুজনই পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে, গ্রেফতার হতে পারে যে কোন সময়। আত্মঘাতী নারী জঙ্গীর স্বামী শীর্ষ জঙ্গী মুসার হদিস রবিবার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, তবে সে বাংলাদেশেই আছে বলে নিশ্চিত করেছেন ডিএমপি কমিশনার। এদিকে আত্মঘাতী নারী জঙ্গীর সঙ্গে বের হয়ে আসা চার বছরের শিশু সাবিনা এখনও শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। পুলিশ বলছে, আশকোনার জঙ্গী আস্তানায় নিহত কিশোরের মৃতদেহটি আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায় নিহত তানভির কাদেরীর ছেলে আসিফ কাদেরী ওরফে আদরের। রাতে তার লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। রবিবার আশকোনার সেই জঙ্গী আস্তানার সূর্য ভিলা বাড়িটি ঘিরে রেখে সতর্কতার সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের টিম নিয়ে পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল দল, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও পুলিশ টিম তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা অবিস্ফোরিত এগারোটি গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। সূত্র মতে, উদ্ধার হয়েছে তিনটি পিস্তল, সুইসাইডাল ভেস্ট ও বিপুল বিস্ফোরক, জঙ্গীদের সঙ্গের পুড়ে যাওয়া ১২ লাখ টাকা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন বলেন, রবিবার সকাল থেকেই আশকোনার সূর্য ভিলায় কাজ শুরু করে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের দলও বাড়িটি থেকে আলামত সংগ্রহ করে। বাড়িটির একটি কক্ষে জঙ্গী কিশোরের লাশ পড়ে ছিল তা আজিমপুরে নিহত শীর্ষ জঙ্গী তানভির কাদেরীর ছেলে আসিফ কাদেরী আদরের লাশ। পুলিশ সূত্র দুপুরে জানায় লাশের কাছেই রয়েছে পাঁচটি গ্রেনেড। দুটির পিন খোলা। খাটের পাশে একটি গ্রেনেড, আরেকটি রয়েছে ড্রেসিং টেবিলের ওপর। বম্ব ডিসপোজাল টিম জানায়, ওই কক্ষের দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাঁ পাশে একটি সুইসাইডাল ভেস্ট পড়ে আছে। আরেকটি সুইসাইডাল ভেস্ট পড়ে আছে কিশোরের লাশের পাশে। রান্নাঘরের তাকের ওপরও একটি গ্রেনেড দেখা গেছে। এর মধ্যে দুটি গ্রেনেড বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, খুব সতর্কতার সঙ্গে তারা কাজ করছেন। কোন্ গ্রেনেড কী অবস্থায় আছে বুঝতে পারছেন না। ঘরটির ভেতরে এত গ্রেনেড, বিস্ফোরক রয়েছে যে এটা মনে হবে অনেকটাই মৃত্যুফাঁদ। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের স্পেশাল এ্যাকশন ডিভিশনের উপকমিশনার (ডিসি) প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার জানিয়েছেন, গ্যাস দূর করার পর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল কাজ করেছে। এর পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম ইউনিট ও কাউন্টার টেররিজমের ক্রাইম ইউনিট কাজ করেছে। সবশেষে পুলিশ লাশ নিয়ে যাবে। সূর্য ভিলার কাজ শুরু করেছে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দমকল কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম রবিবার বলেন, আগের দিন শনিবার অভিযান চলাকালে ছোড়া গ্যাস ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঝাঁঝ ঘরটিতে জমেছিল। গ্যাস বের করার কাজ আপাতত শেষ। ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট এখনও ঘটনাস্থলে। আত্মঘাতী নারীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন ॥ আশকোনায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানে আত্মঘাতী নারী জঙ্গীর মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন বোমা বিস্ফোরণেই মৃত্যু হয়েছে এই নারীর। রবিবার বেলা এগারোটায় শুরু নিহত নারীর মরদেহের ময়নাতদন্ত এক ঘণ্টা ধরে সম্পন্ন করা হয়। এরপর ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার সোহেল মাহমুদ বলেন, মরদেহ থেকে ভিসেরার (পাকস্থলী, লিভার, কিডনি) নমুনা ও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য চুলও সংগ্রহ করা হয়েছে। এগুলো এখন মহাখালী পাঠানো হবে। অভিযানে অংশ নেয়া পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, নিহত নারী জঙ্গী সুমনের স্ত্রী, তার নাম শাকিরা। নিহত কিশোর জঙ্গী ॥ আশকোনার সেই জঙ্গী আস্তানায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানে বাসার ভেতরে আসিফ কাদেরী ওরফে আদর নামের এক কিশোর নিহত হয়। আসিফ আজিমপুরে নিহত জঙ্গী তানভীর কাদেরীর যমজ দুই ছেলের একজন। আসিফের ভাই তাহরীম কাদেরী ও মা আবেদাতুন ফাতেমা আজিমপুরে গ্রেফতার হন। তারা গ্রেফতারের পর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জঙ্গীগোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে ভুল করেছেন বলে অনুতপ্ত ও অনুশোচনায় ভুগছেন। আবেদুন ফাতেমা এখন কারাগারে। কিন্তু জমজ দুই ছেলের মধ্যে তাহরীম কাদেরী স্বীকারেক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর তাকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। নিহত আসিফ কাদেরী দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গী আস্তানায় আত্মগোপন করে থাকার পর শনিবারের অভিযানের সময়ে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানালে আত্মঘাতী ও গুলিতে নিহত হয়। শিশুটি আশঙ্কামুক্ত নয় ॥ আশকোনার জঙ্গী আস্তানা থেকে আত্মঘাতী নারী জঙ্গীর পাশে আহত অবস্থায় পড়ে থাকা শিশুটিকে উদ্ধারের পর শনিবার ঢাকা মেডিক্যালে অস্ত্রোপচার শেষে তাকে পোস্ট অপারেটিভে রাখা হয়। ঢাকা মেডিক্যালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আরএমও জেসমিন নাহার জানান, শিশুটিকে হাসপাতালে আনার পর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে সে বলেছে, তার নাম সাবিনা। বাবার নাম ইকবাল (জঙ্গী) ও মায়ের নাম শাকিরা। মেজর জিয়া ও মারজান কি গ্রেফতার ॥ আশকোনার সেই বাড়ি থেকে দুই শিশুকে নিয়ে বের হয়ে এসে আত্মসমর্পণ করে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও জঙ্গীনেতা মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা। তারা শনিবার আত্মসমর্পণ করার পর গোয়েন্দা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গী নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সকল তথ্য দিয়েছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান শীর্ষ জঙ্গী নেতা মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডার নূরুল ইসলাম মারজান কোথায় আছে সে বিষয়ে তথ্য দেয়ার পর তাদের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে গ্রেফতারের বিষয়টি কোন মহল থেকেই নিশ্চিত করা হচ্ছে না। বড় ধরনের আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা ছিল ॥ ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীর দক্ষিণখানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত সেই নারীকে দিয়ে জঙ্গীদের হামলার পরিকল্পনা ছিল। তিনি বলেছেন, যে বিস্ফোরক ও সরঞ্জামাদি ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছে সামনে জঙ্গীদের হয়ত কোন হামলার পরিকল্পনা ছিল। এতে ওই নারীকেই ব্যবহার করা হতো। রবিবার সন্ধ্যায় দক্ষিণখানে জঙ্গী আস্তানা ‘সূর্য ভিলা’র সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি। মনিরুল ইসলাম বলেন, এখানে যে নারী সুইসাইডাল এ্যাটাক করে মারা গেছে, তার দুই বিয়ে হয়েছিল। আগের স্বামীর নাম ইকবাল। জানতে পেরেছি তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এর পর সন্ত্রাসী সুমনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ওই বিয়ের পর থেকেই এই নারী নব্য জেএমবির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আটজনের বিরুদ্ধে মামলা ॥ বাংলানিউজ জানায়, আশকোনায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানের পর সন্ত্রাস দমন আইনে ৮ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। রবিবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দক্ষিণ খান থানায় এ মামলাটি দায়ের করে। থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহিনুল ইসলাম বাদী হয়ে মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পলাতক জঙ্গী মাইনুল ইসলাম মুসা, নিহত দুইজন ও আত্মসমর্পণকারী ৪ জনকে এই মামলার আসামি করা হয়েছে। দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন চন্দ্র সাহা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
×