ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের  বিচিত্র কর্মজীবন

সপ্তম অধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ বছরের প্রথম পর্ব- ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ (গতকালের পর) রাওয়ালপিন্ডি শহরের উচ্চতা ছিল ২ হাজার ফুট আর এবোটাবাদের উচ্চতা ছিল প্রায় ৪ হাজার ফুট। কাকুলে ছিল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি। এসব প্রতিষ্ঠানই ছিল হাজারা জেলায়। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বাড়ি ছিল হাজারা এলাকায়। রাস্তা দিয়ে তার বাড়ি পেরিয়ে কাকুল হয়ে এবোটাবাদে যেতে হতো। তার বাড়ির সঙ্গে সংলগ্ন ছিল একটা মালটা অথবা কেনো বাগান। সম্ভবত একটি আমেরও বাগান ছিল। কমলা জাতীয় ফলের বাগান পশ্চিম পাকিস্তানের নানা জায়গায় বিস্তৃত ছিল এবং কমলা তাদের দেশে একটি আদি ফল। এই কমলা আবার ছিল নানা রকমের, যেমন- সানতারা, মালটা অথবা কেনো এবং এ সবই বিভিন্ন ধরনের গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়। ফল-ফুলের উদ্ভাবনে এবং তাদের চাষ সম্প্রসারণে কালাবাগের নবাব অত্যন্ত মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজেই কৃষি বিজ্ঞানী ছিলেন এবং তার ছিল বিরাট বাগান এলাকা। সিন্ধু প্রদেশে অনেক যুগ আগে থেকেই এক ধরনের আম উৎপাদন হতো, যাকে বলা হতো সিন্দরী আম। এই আমটিতে বিশেষ কোন খশবু ছিল না কিন্তু আমটি বেশ মিষ্টি এবং কি রকম সাদামাটা একটা মিষ্টি ফল বলে বিবেচিত হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যত্র কোন প্রদেশে আমের চাষ ছিল না। আমের চাষের প্রবর্তন করেন কালাবাগের খান সাহেব। ১৯৫৭ সালে আমরা যখন লাহোরে ছিলাম তখন পশ্চিম পাকিস্তানে আম বা কলা বলে কিছু ছিল না। সিন্ধুর আম করাচীর বাইরে বিশেষ ছিল না এবং সিন্ধুর কলা মাঝে মধ্যে লাহোরেও আসত। ৮ বছর পরে আমি যখন পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করলাম প্রায় পাঁচ বছর তখন পশ্চিম পাকিস্তানে আমের তো কোন অভাবই ছিল না বরং তার গুণগত মান মুর্শিদাবাদকেও হারিয়ে দেয়। আমের বীজ এবং চারাগাছ ভারত থেকে কালাবাগের খান সাহেব চোরাচালান করে নিয়ে আসেন এবং তার বাগানে এই বিষয়ে নানা ধরনের গবেষণা-পরীক্ষা পরিচালনা করেন। পাঞ্জাব এলাকা এই ৮ বছরে আমের চাষের জন্য সারা উপমহাদেশে খ্যাতি লাভ করে। মালদার সুপ্রসিদ্ধ ল্যাংড়া সেখানে গুণগতভাবে অনেক সমৃদ্ধ ছিল। উপমহাদেশে আমের চাষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় সুবা বাংলায়। এখানে গোপালভোগ, ফজলি, মালদহ, ল্যাংড়া, হিমসাগর এ রকম বিভিন্ন ধরনের আম উদ্ভাবিত হয় এবং আম চাষ বিস্তৃতি লাভ করে। মোটামুটিভাবে এই বাগানগুলো যমুনার পশ্চিম পাড় থেকে শুরু করে সুবা বাংলার পশ্চিমে বিহার ও নিকটস্থ এলাকায় বৃদ্ধি পায়। উপমহাদেশে আম চাষের সূচনা এভাবেই হয়। পরবর্তীকালে অন্যান্য অঞ্চলে এই আমের নানা জাত খ্যাতি লাভ করে। যেমন- আলফানসো সিন্দরী বা মুলতানী। পাকিস্তান এসব বিভিন্ন জাতের সঙ্গে একটি নতুন জাতের সৃষ্টি করে যার নাম ছিল আনোয়ার রাটোর। অধুনা হয়ত তারা আরও নতুন আম উদ্ভাবন করেছে। আমকে বিশ্ববাজারেও প্রতিষ্ঠিত করতে আমার মনে হয় ভারতের চেয়ে বড় ভূমিকা পাকিস্তানই পালন করে। এখন উপমহাদেশের আম সারাবিশ্বে একটি ঈর্ষণীয় স্থান দখল করে আছে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমচাষও অনেক বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে উপমহাদেশীয় জনগণ যারা বিভিন্ন দেশে প্রবাসনে যায় তারাই এটার সূচনা করে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে তাদের নিজস্ব আমচাষ প্রচলিত ছিল। সেখানেও গুণগত মান উন্নয়নে উপমহাদেশীয় আম মূল্যবান ভূমিকা পালন করে। অধুনা ফ্লোরিডা এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় বেশ ভাল আম উৎপাদিত হয়। আফ্রিকায় শোনা যায় যে, তাদের নিজস্ব আম ছিল। কিন্তু গুণগতভাবে তা খুব আকর্ষণীয় ছিল না। অধুনা সেই দেশের আম বাগানও উপমহাদেশীয় প্রভাবে ব্যাপকভাবে উন্নত হচ্ছে। আমাদের একটা উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ ছিল কাগান মালভূমিতে। কাগান যেতে হতো এবোটাবাদ থেকে একটি সঙ্কীর্ণ অথচ উঁচু পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তায় অনেক দূরত্বব্যাপী এক লেন রাস্তা ছিল। তাই সেখানে যাওয়া-আসার জন্য নির্দিষ্ট নির্ঘণ্ট ছিল। উত্তরে যখন গাড়ি যেত তখন দক্ষিণ থেকে কোন গাড়ি আসতে পারত না। সে রকম ব্যবস্থা দক্ষিণ থেকে যাতায়াতকারীদের জন্যও ছিল। এই রাস্তায় বিশেষভাবে অভ্যস্থ শকট চালক ছাড়া অন্য কেউ গাড়ি চালাত না। কাগান মালভূমিতে পৌঁছে গেলে অবশ্যি সেখানে ভাড়ায় গাড়ি পাওয়া যেত। কাগানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল মাছ শিকার। বরফগলা পানিতে এই মাছের প্রজনন হতো। এই মাছও ছিল পাহাড়ীয় স্যামন (ঝধষসড়হ)। আমরা প্রত্যেক দিনই অনেক সময় ধরে মাছ শিকার করতাম। কিন্তু কোনদিনই একটি মাছও ধরতে পারিনি। আমরা যে কটেজে ছিলাম তার পাশেই আর একটি কটেজে একটি পাঠান পরিবার ছিল। সে দলে সম্ভবত ৩/৪টি কিশোর ছিল। তারা কিন্তু অতি সহজেই মাছ ধরতে পারত এবং প্রত্যেক দিনই তারা তাদের শিকার করা মাছ আমাদের দিত। কাগানে এই মাছটি নানাভাবে খাওয়া হয় এবং মাছটি খুব বড় আকার ধারণ করে না। সম্ভবত সেটা হয় মাছটি যখন সমুদ্রে বেড়ে উঠে। এই মাছটির স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা। ছোট আয়তনের মাছকে পুড়িয়ে খাওয়া যায়। বড় আয়তনের মাছকে নানাভাবে রান্না করা যায়। আমাদের দেশীয় কায়দায় সুরুয়া দিয়ে রান্না করলেও মাছ খুব সুস্বাদু। স্মোক করে, ভাজা অথবা ভুনা করে মাছটি খাওয়া যেত। কাগানের অন্যতম আকর্ষণ হলো বরফগলা জলের বিরাট হ্রদ সাইফুলমূলক। গ্রীষ্মকালে বরফ গলে পাহাড় দিয়ে প্রবহমান পানি পান করা অথবা স্পর্শ করা খুবই আনন্দদায়ক। কাগান মালভূমির মেয়েরা বাস্তবেই খুব সুন্দরী। বলা হয় এখানে আলেকজান্ডারের আমলের সৃষ্ট একটি গ্রীক উপনিবেশ বহুদিন অনাবিষ্কৃত ছিল। তাদের সঙ্গে স্থানীয় পাঠানদের সংমিশ্রণে যে গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে তাতে অনন্য সুন্দরী মেয়ের প্রাচুর্য লক্ষণীয়। সামান্য একটি কথা এখানে বলা যায় সেটি হলো আমার ওয়াশিংটনে পদায়নের বিষয়ে। ওয়াশিংটনে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর পদবিটি ছিল অত্যন্ত কাক্সিক্ষত একটি পদ। যেখানে দায়িত্বও ছিল ব্যাপক এবং সে জন্য উৎকৃষ্টভাবে কাজ করার সুযোগও ছিল অনন্ত। এই পদে পদায়নের জন্য প্রতিযোগিতা ছিল অত্যন্ত প্রকট। আমি যে এই পদের জন্য প্রার্থী সেই বার্তাটি আমি যথাসময়ে উচ্চমহলের নজরে আনি। ওয়াশিংটনে তখন একজন বাঙালী এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন প্রথম সচিব হিসেবে। কাউন্সিলররা অন্ততপক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতি না পেলে কাউন্সিলর পদমর্যাদা পেতে পারতেন না। তখনকার ওয়াশিংটনের প্রথম সচিব আমাকে জানালেন যে, তিনি উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন সে জন্য কিছু সময় পেলে কাউন্সিলর হিসেবে ওয়াশিংটনেই পদায়িত হতে পারেন। চলবে...
×