ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

সপ্তম অধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ বছরের প্রথম পর্ব- ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ (গতকালের পর) একনেকের কাজ ছিল বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন এবং সেই কাজের বিষয়াবলী প্রস্তুত করে দিত দুই প্রদেশের উন্নয়ন কার্যকরী দলের একটি কমিটি ঈউডচ। মোটামুটিভাবে এই কায়দাটি এখনও বহাল আছে। তফাৎ হয়েছে দুটি ক্ষেত্রে। ঈউডচ-এর জায়গাটি নিয়েছে পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) এবং একনেকের সভাপতিত্ব আগে করতেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এখন তার সভাপতি হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ঈউডচ-এর আর একটি ক্ষমতা ছিল, তারা একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের নিচে যেসব প্রস্তাব হতো সেগুলো পাস করলে প্রাদেশিক পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় তার চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে পারত। বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী ছোট ছোট প্রকল্পের অনুমোদন প্রদান করেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হতো। তার অনেকগুলো এখনও অন্য কায়দায় বহাল আছে। জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল বা এনইসি পাকিস্তানে যা করত এখানেও তাই করে। তারা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বিবেচনা করে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয় বিবেচনা করে। এসব বিবেচনায় খুব প্রাধান্য পেত দুই অঞ্চলের বৈষম্য। এই বৈষম্য বাংলাদেশের বিবেচনায় সামান্যই আসে এবং তার একটা যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের প্রধান কৌশল হচ্ছে সারাদেশে একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক সত্তা সৃষ্টি। আমাদের বর্তমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা যার সহযোগী হিসেবে রয়েছে রেলপথ এবং অনেক সংকুচিত জলপথ এবং তার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে আমাদের দেশে মোটামুটিভাবে একটি একক অর্থনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমাদের সারা দেশটি মোটামুটিভাবে একটা একীভূত বাজারে পরিবর্তিত হয়েছে। দিনাজপুরের ধান চাষী ঢাকার বাজারের চালের দাম ভালভাবেই জানেন এবং তাতে সে মধ্যস্বত্বাধিকারীদের বড় ধরনের শিকার হয় না। অবশ্যি, ধান মাড়াইয়ের জন্য চালের কলের মালিকরা ধান বিক্রিতে তাদের যে লভ্যাংশ হওয়া উচিত সেখানে এই মধ্যস্বত্বাধিকারীরা একটি বড় হিস্যা নিয়ে নেয়। পাকিস্তানে আর একটি উচ্চপদস্থ নিয়মিত সম্মেলন ছিল প্রাদেশিক গবর্নরদের সম্মেলন। একটি ফেডারেশনে এই সম্মেলনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্তত সেখানে বড় ধরনের অভিযোগ আলোচনা করা যেত। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে এ রকম একটি সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের লাট সাহেব আবদুল মোনেম খান দুই অঞ্চলের বৈষম্যের কথা বলতে গিয়ে মন্তব্য করেন ‘এসব কারণে আমাদের বিরোধী শক্তি বলে পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে ব্যাপক খরচে তারবেলা বাধ নির্মাণ হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে হয় শুধুমাত্র কারবালা।’ আমাদের বাংলাদেশে ভবিষ্যতে হয়ত এই ধরনের সম্মেলন খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। এখানে এই সম্মেলনটি হবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সম্মেলন। আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এবং রংপুরের বিভাগীয় শহরের জন্য আছে মহানগর কর্পোরেশন। অন্যান্য সম্ভবত ৬৭ জেলার জন্য রয়েছে জেলা পরিষদ যেখানে অদূর ভবিষ্যতে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের জেলাগুলো আয়তনে এবং জনসংখ্যায় পৃথিবীর স্বাধীন-সার্বভৌম ৫০ থেকে ৭০টি দেশের চেয়ে বৃহৎ। এসব অঞ্চলে আমরা মোটামুটি বহু সরকারী কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে সম্পাদন করতে পারি। সেজন্য প্রয়োজন হলো ৩টি উপাদানের। প্রথমটি হলো প্রত্যেকটি জেলায় স্বশাসিত স্বয়ম্বর প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান বা সরকার গড়ে তোলা। সেজন্য জেলা সরকারের জন্য দায়িত্বগুলো নির্দিষ্ট করতে হবে। সেজন্য দুটি তালিকার প্রয়োজন। একটি হলো কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আর অন্যটি হলো জেলা সরকারের বিভাজিত দায়িত্ব। দ্বিতীয়টি হলো প্রত্যেকটি জেলার জন্য স্বতন্ত্র বাজেট। তৃতীয় যে উপাদানের প্রয়োজন সেটি হলো জেলার কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য তার আর্থিক সামর্থ্য। আমরা যদি মনে করি যে, বড় ধরনের রাজস্ব আহরণের যথাযথ প্রতিষ্ঠান হলো কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড তাহলে আমরা রাজস্ব বোর্ডের আয়ের বৃহত্তর অংশকে জেলায় জেলায় ভাগ করে দিতে পারি। আমরা ইচ্ছা করলে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর আদায়ের দায়িত্ব জেলা কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দিতে পারি। জেলা কর্তৃপক্ষের অন্য আয়ের প্রধান সূত্র হবে সম্পদ কর। এছাড়া জেলা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কাজের বিনিময়ে ফিস, যেমন- স্বাস্থ্য বা শিক্ষা সেবার জন্য কিছু ফিস আদায় করতে পারেন। পূর্বে বর্ণিত তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছেÑ জেলা ইউনিটে শক্তিশালী জেলা প্রশাসন গড়ে তোলা। কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রকে এই দায়িত্ব দিলে কোন দিনই স্বয়ম্বর এবং স্বশাসিত জেলা প্রশাসন হবে না। তাই একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে হবে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায়। বর্তমানে যারা প্রশাসনে আছেন তাদের সুযোগ দিতে হবে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার। সেজন্য তারা আর কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের অংশ থাকবেন না, তাদের জেলা আমলাতন্ত্রের সদস্য হতে হবে। তাদের নিযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রীয়ভাবে করা যেতে পারে। কিন্তু তারা যখনই নিযুক্তি পাবেন তখন একটি জেলার কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্তি পাবেন। কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র এই ব্যবস্থার ফলে ব্যাপকভাবে সংকুচিত হবে। বর্তমানে এতে কাজ করেন প্রায় ১৮ লাখ কর্মচারী। এই ১৮ লাখের অন্তত ১৬ লাখকেই বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তা হিসেবে রূপান্তরিত হতে হবে এবং ভবিষ্যতে তারা জেলার কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্তি পাবেন। পশ্চিম পাকিস্তানে আর একটি বিষয় বুঝতে পাই যে, সেখানে সরকারী কর্মচারীদের দাপট এবং দায়িত্ব অনেক বেশি। তারা ব্রিটিশ আমলের মা-বাপ হিসেবেই কাজে লিপ্ত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে জেলা প্রশাসকদের যথেষ্ট দাপট তখনও ছিল। কিন্তু এই দায়িত্ব তাকে অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে পালন করতে হতো। বলা যেতে পারে যে, এক হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারী সেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন ধরনের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের গণতন্ত্র ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে সেটা অনেক ব্যাপক হয়েছে এবং সামান্য কিছু সংশোধন করলে এটা মোটামুটিভাবে একেবারেই গণতান্ত্রিক হতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় পাঁচ বছর অবস্থানের সময় আমি এবং আমার পরিবার এমনকি আমার আত্মীয়-স্বজন এবং পিতা-মাতাকেও নিয়ে আমরা অনেক জায়গায় ভ্রমণ করি। লাহোর সম্বন্ধে আগেই বলেছি, এটি একটি সুদৃশ্য মুঘল আমলের বহু আগের যুগের শহর। লাহোরের শালামার বাগান, লাহোর দুর্গ বা জিমখানা ক্লাবে সবুজ বলয় সত্যিই খুবই আকর্ষণীয়। রাওয়ালপিন্ডি মোটামুটি একটি সামরিক বাহিনীর শহর ছিল। তবে পাকিস্তানের সাময়িক রাজধানী হওয়ার ফলে সেই চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। আমরা রাওয়ালপিন্ডি থাকতেই ইসলামাবাদের পত্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইসলামাবাদ একটি সুপরিকল্পিত সুন্দর রাজধানী হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেখানে সরকারী প্রচেষ্টায় সবুজের শ্যামলিমা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। উত্তরে পেশোয়ার অতি সুন্দর একটি শহর ছিল। যদিও সেখানে সেই সময়ই পাঠান উপজাতীয় বিভিন্ন নিদর্শন বহাল তবিয়তে বজায় ছিল। যেমন- সেখানেও আগ্নেয়াস্ত্র ধারণ করা মোটামুটিভাবে পাঠানদের একটি অধিকার বলে বিবেচিত হতো। পেশোয়ারের বাইরে আফগান সীমান্তের পথে পাঠানদের এলাকায় মোটামুটিভাবে এক ধরনের স্বশাসন কায়েম ছিল এবং অনেক উপজাতীয় সনাতনী অনুষ্ঠান এবং ব্যবহার স্বদম্ভে প্রতিপালিত হতো। আফগান সীমান্তে পাঠান এলাকার লান্ডিকোটাল বাজার ছিল একটি আন্তর্জাতিক মুক্তবাজার। এখানে নানা ধরনের আন্তর্জাতিক পণ্য এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পণ্য সবই সস্তা দরে পাওয়া যেত। পেশোয়ার থেকে সোয়াত এলাকায় গেলে এক ধরনের ভূস্বর্গের সন্ধান পাওয়া যেত। আমার পিতা-মাতা সোয়াত এলাকাকে খুবই পছন্দ করেন এবং আমাদের যাত্রাটি সোয়াতের যুবরাজ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জামাতা আওরঙ্গজেব খান অনেক আনন্দময় করে তোলেন। রাওয়ালপিন্ডির অদূরেই ছিল কয়েকটি পর্বতচূড়ায় অবস্থিত রিসোর্ট শহর। প্রায় ৭ হাজার ফিট উচ্চ মারী ছিল মাত্র ৪০ মাইল দূরে। যার অর্ধেকের বেশি রাস্তাই ছিল পাহাড়ী। মারী শীতকালে বেশি সময়ই বরফ আবৃত থাকত। মারী ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় পর্যটন এলাকা। আর সেখানে সেই সময়ে একটি অত্যন্ত সুদৃশ্য পূর্ব পাকিস্তান হাউস নির্মিত হয়। আমরা প্রায়ই সেখানে সময় কাটাতাম। এছাড়া পর্যটন শহর হিসাবে মারীতে হোটেল বা গেস্ট হাউসের কোন সীমা সংখ্যা ছিল না। মারী থেকে সম্ভবত ২ ঘণ্টার রাস্তা ছিল আর একটা রিসোর্ট এলাকা খানপুর। এবং সেখান থেকে আরও প্রায় ২ ঘণ্টার রাস্তা ছিল তৃতীয় রিসোর্ট শহর নাথিয়াগলি। গ্রীষ্মকালে রাওয়ালপিন্ডির তাপমাত্রার অত্যাচার থেকে রেহাই পাবার লক্ষ্যে আমরা সপরিবারে প্রতি শনিবার বিকেলে এসব জায়গায় চলে যেতাম। দু’দিনের অতিরিক্ত কোন ছুটির সময় আমাদের আর একটি ভ্রমণের এলাকা ছিল কাকুল হয়ে এবোটাবাদ। এবোটাবাদ থেকে আবার নাথিয়াগলি, খানপুর, মারী এসব জায়গায় যাওয়া যেত। চলবে...
×