ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

জার্নাল

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

জার্নাল

ধানম-ির রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে চমৎকার একটি দ্বিভাষিক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান চলছে তখন। সময়টা শরৎকাল। আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। এই বর্ণাঢ্য, কিন্তু ছিমছাম ঘরোয়া অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বনানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং সৃজনশীল ছাত্রশিক্ষকরা। ইংরেজী এবং বাংলা দুই ভাষায়, দুই ভাষার কবিতা -বাংলা কবিতার পাশাপাশি সফল ইংরেজী অনুবাদে সেদিন অডিটোরিয়ামমুখর ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। উপস্থাপিকা ছিলেন দীর্ঘকায় লাবণ্যময়ী এক যুবতী, সম্ভবত ছাত্রী, দুটো ভাষায় যার রয়েছে ঈর্ষণীয় বুৎপত্তি ও অপরিমেয় দখল। অন্যান্য আলোচকের ভেতর আমিও একজন আলোচক ছিলাম সেদিন। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বনানীর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্যের ক্রিয়েটিভ রাইটিং এবং উত্তরাধুনিক ইংরেজী কবিতা পড়াই। খুব বিনয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের অধ্যাপনা, লেখালেখি এবং যৎকিঞ্চিত অনুবাদের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি স্পর্শকাতর প্রশ্ন উপস্থিত কবিতাপ্রেমী দর্শক-শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরি। ম্লান সন্ধ্যায় ঝিমিয়ে পড়া দর্শকবৃন্দ যেন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। সবার ভেতর এক ধরনের আলোড়ন লক্ষ্য করি। ভালো লাগে এই ভেবে যে, এখনও কবিতা নিয়ে মানুষের ভালোলাগা এবং ভালো না লাগা প্রতিক্রিয়া বেশ প্রবল, ব্যাপক এবং বিস্তৃত। সেদিন সন্ধ্যার প্রশ্ন ছিল আমার : ইদানীং কবিতা কেন পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে না? কেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কবিতা বেশি বেশি লেখা হচ্ছে না? আমাদের কবিতা কেন বৃত্তবন্দী হয়ে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে? বাংলা কবিতার ভবিষ্যত কি? তুমুল তোলপাড় তৈরি হয়ে গেল। কবি, সম্পাদক, সমালোচক, কবিতার শিক্ষক, আগ্রহী ছাত্রছাত্রী সবাই অংশগ্রহণ করলেন কবিতাবিষয়ক বিতর্কে। এদিকে রাত বাড়ছে। শহর ঢাকা নিরাপদ নয়। অডিটোরিয়াম কর্তৃপক্ষ দ্রুত শেষ করার জন্য একবার তাড়া দিয়েছেন। এক সময় আয়োজকরা বিপুল করতালির ভেতর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অসম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানতে বাধ্য হলেন। তারা আশ্বাস দিলেন, খুব অচিরেই এই বিষয়টি নিয়ে আরও একটি পরিপূর্ণ অনুষ্ঠানের সুচারু আয়োজন করা হবে। দোতলা থেকে নেমে নিচে সিঁড়ির শেষ ধাপে যখন পা রেখেছি, পেছন থেকে কে যেন আমার ঘাড়ে হাত রাখলেন। চোখ উজ্জ্বল, মাথার চুল সাদা, চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে। ইংরেজীতে একটা প্রশংসা বাক্য বললেন, ওয়েল ডান, ইয়াংম্যান। আমি হাত বাড়িয়ে উষ্ণ করমর্দন করে আমার পরিচয় ব্যক্ত করলাম : গ্ল্যাড টু মিট ইউ। দিস ইজ নাসিম, প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি... বনানী, ঢাকা। তিনি পকেট থেকে একটা বিজনেজ কার্ড বের করে আমার হাতে দিয়ে স্মিত ও রহস্যময় হেসে বললেন, আই এ্যাম মিখায়ূভ। রুশ দূতাবাসের সাংস্কৃতিক বিভাগ গুলশান অফিসে আছি। আমি চমকে উঠলাম। বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। অনেক বছর আগে, এরকমই এক অতিক্রান্ত সন্ধ্যায়, এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে ড. মীজানুর রহমান শেলী জীবনানন্দ দাশের ওপর লেখা ক্লিনটন বি বইয়ের লেখক সিলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। চোখে গোল চশমা, হেমিংওয়ের মতো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, নারী পরিবেষ্টিত; সাবলিল বাংলা বলে যাচ্ছেন। আমি যতই ইংরেজী বলছি, যতই ইংরেজীতে প্রশ্ন করছি, তিনি অবলীলাক্রমে উত্তর দিচ্ছেন বাংলায়, কিছুটা বরিশালের বাংলা এ্যাকসেন্টে, কখনও প্রমিত বাংলায়। মিখায়ূভত্ত স্ফতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল বাংলায় বলে যাচ্ছেন তার সমস্ত কথা। তার অবদমিত কৌতূহল আমাকে পেয়ে যেনবা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উপচে পড়ছে। আমি বিমূঢ়, হতভম্ব, অভিভূত। হঠাৎ কী মনে হতে; আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে, কানের কাছে মুখ এনে, যেনবা গোপন কোন তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন, এরকম এক ভঙ্গীতে বললেন, আপনি কি আমাকে ‘ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল’ বইটি সংগ্রহ করে দিতে পারেন? আমি অনেকদিন ধরে বইটি খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না। তিনি নীলক্ষেত, শাহবাগের আজিজ মার্কেট, নিউমার্কেটের কয়েকটি অভিজাত বই বিপণিতে রবীন্দ্রনাথের পরিবারের ওপর চিত্রাদেবের লেখা বহুলপঠিত বইটা খুঁজে ব্যর্থ হয়েছেন, পাননি। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম এবং এই বলে নিশ্চিত করলাম যে, শেষ পর্যন্ত বইয়ের দোকানে চিত্রাদেবের বিখ্যাত সেই বইটি না পাওয়া গেলে, আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে তা ব্যবস্থা করব। পরম পরিতৃপ্তির হাসিতে তার মুখম-ল ভরে উঠল। চোখে উজ্জ্বলতা এলো। তিনি আরও পানীয় নিলেন। আমার একটু তাড়া ছিল, ব্যস্ততাও ছিল। আমি ফোন করে জানানোর আশ্বাস দিয়ে, আমার ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমাকে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অনেকটা দূর যেতে হবে। এই শহর থেকে অন্য শহরে -উত্তরার ১২ নং সেক্টরে। এখন ঢাকার রাজপথে, এই ধানম-ির সড়কে তেমন একটা ভিড় নেই। কিন্তু কে জানে কত বড় যানজট বনানী এবং এয়ারপোর্ট রোডে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে!
×