ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘নিউ ইকোনমিক থিংকিং’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনে সহযোগিতা দিয়ে যাব

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনে সহযোগিতা দিয়ে যাব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বেসরকারী খাতের উন্নয়নে আর্থিক, নীতিনির্ধারণ ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গঠনে সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্থ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদেশী বিনিয়োগ আনতে তার সরকার ব্যাপক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে আমরা একশত বিশেষ অথনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হবে। শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালে আইটি সেক্টরে দশ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এবং এ সেক্টর থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করার টার্গেট নিয়ে কালিয়াকৈরে ৩৫৫ একর জমির ওপর পিপিপির ভিত্তিতে হাইটেক পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। একইভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ ২০৩০ সালের মধ্যেই অর্জন করে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী এসডিজি বাস্তবায়নেও রোল মডেল হিসেবে পরিচিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার সকালে রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে আয়োজিত ‘নিউ ইকোনমিক থিংকিং : বাংলাদেশ ২০৩০ এ্যান্ড বিয়ন্ড’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এই সম্মেলনের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বক্তৃতা করেন। ঢাকা চেম্বার্স অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি হোসেইন খালেদের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী প্লানারি সেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিঙ্গাপুর ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের গ্রুপ প্রেসিডেন্ট লিম জিয়ন গুয়ান। ডিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি হুমায়ুন রশিদ অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনকে ’দি ইলাস্ট্রিয়াস সান অব ঢাকা’ পুুরস্কারে ভূষিত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৭০তম জয়ন্তী উদযাপন করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে এবং জনপ্রতি মাথাপিছু আয় প্রায় ১২,৬০০ ডলারে উন্নীত হবে। শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালে আমাদের অর্থনীতি এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। স্থানীয় সাপ্লাই চেইন এবং গ্লোবাল ভ্যালু চেইন আঞ্চলিক, উপ আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সংযোগ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ও প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতীম দেশসমূহের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরী। এছাড়া বিসিআইএম, বিবিআইএন, সার্ক, আসিয়ান, বিএমসটেক, সাসেক এবং পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশাধিকার দ্রুত ও উন্নত আঞ্চলিক সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে আরও সহজতর ও গতিশীল করবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার বেসরকারী খাতের উন্নয়নের জন্য প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট পলিসি কো-অর্ডিনেশন কমিটি (পিএসডিপিসিসি) গঠন, সুসংহত শিল্পোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা-বিইজেডএ), বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা-বিআইডিএ), সব অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পিপিপি অফিস, দেশী ও বিদেশী বেসরকারী বিনিয়োগ উন্নয়নে সময়োপযোগী শিল্পনীতি, রফতানিনীতি এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত করতে বিশ্বব্যাংক প্রণীত ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স’, ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ প্রণীত ‘গ্লোবাল কমপিটিটিভ ইনডেক্স’, জাতিসংঘ প্রণীত ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ এবং অন্যান্য সংস্থা প্রণীত ‘গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স’সহ ‘লজিস্টিক পারফর্মেন্স ইনডেক্স’ এ বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়নে সরকার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালে আমাদের অর্থনীতি এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। স্থানীয় সাপ্লাই চেইন এবং গ্লোবাল ভ্যালু চেইন আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ ও সংযোগ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসডিজি ২০৩০ ও পরবর্তী ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কৌশল নির্ধারণে আন্তর্জাতিক এই কনফারেন্স আয়োজনের জন্য ‘ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিকে’ অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস-এর (পিডব্লিইসি) ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। যার বর্তমান অবস্থান ৩১তম। শেখ হাসিনা বলেন, এ লক্ষ্য অর্জনে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন, বাণিজ্যের প্রসার, রেমিটেন্স বৃদ্ধি, যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের ধারায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করবে। এই লক্ষ্য পূরণে বিনিয়োগ সম্ভাবনা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন, কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস হ্রাসকরণ ও অগ্রাধিকারমূলক শিল্পে বর্তমান সরকারের নৈতিক ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরই আমরা রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের কাজে হাত দেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার গৃহীত কর্মসূচীর ফলে গত কয়েক বছর বাংলাদেশ নিরবচ্ছিন্নভাবে ৬ শতাংশর বেশি জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও সাম্প্রতিক সময়ে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশ জাতির পিতা স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। এই দেশের প্রতিটি মানুষ অন্তত দু’বেলা পেট ভরে খেতে পাবে। রোগে চিকিৎসা পাবে, শিক্ষা পাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে- সরকার সে লক্ষ্য বাস্তবায়নেই কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কুঁড়েঘর বাংলাদেশে থাকবে না এই ঘোষণা দিয়েছিলাম। এখন আর কুঁড়েঘর দেখা যায় না। সারাদেশের ২ লাখ ৮০ হাজার গৃহহীনকে আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় বিনা পয়সায় ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার প্রকল্প সরকারের বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রাসহ জাতিসংঘ গৃহীত এসডিজি ২০৩০ এর লক্ষ্যসমূহ জাতীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ব্যাপক কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় তার সরকারের সময়ে দেশের আর্থ সমাজিক উন্নয়নে গৃহীত কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্যসীমা ২০০৫ সালে থাকা ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০১৫ সালে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১৪শ’ ৬৬ মার্কিন ডলার হয়েছে। ২০০৫-০৬ সালে যেখানে রফতানি আয় ছিল ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে বর্তমান অর্থবছরে তা ৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বর্তমানে ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের ৯০ শতাংশ নিজস্ব অর্থায়নেই বাস্তবায়ন করছি। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও বেগবান করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৭ বছরে দেশে ৮০টি নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি করে আমরা বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করেছি। দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। দেশে অফগ্রীড এলাকার ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। আমাদের ভিশন ২০২১ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুত দিতে সক্ষম হব, ইনশাল্লাহ। শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। গ্যাসের গড় উৎপাদন দৈনিক ১,৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট হতে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে দৈনিক ২,৭৪০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ফার্স্ট ট্রাক প্রকল্প গ্রহণ করেছি। গভীর সমুদ্রবন্দর, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প, মেট্রোরেল, আন্তঃদেশীয় রেল প্রকল্প এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এ সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমাদের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা চেম্বার- এই কনফারেন্সের মাধ্যমে আগামী ২০৪১ সালের বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় রূপরেখা, ইনোভেটিভ কনসেপ্ট ও চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় প্রয়েজনীয় দিকনির্দেশনা তুলে ধরা হবে। আজ যে কৌশলপত্র তৈরি হবে তাতে দেশের উদীয়মান সম্ভাবনাগুলোকে তুলে ধরা হবে।
×