ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াঙ্গুনে সুচির প্রতি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আহ্বান আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের

রাখাইনে গুলিবিদ্ধ শাহ আলমের টেকনাফের আশ্রয় কেন্দ্রে মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

রাখাইনে গুলিবিদ্ধ শাহ আলমের টেকনাফের আশ্রয় কেন্দ্রে মৃত্যু

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার। ইতোমধ্যে সেদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশ সীমান্তরক্ষী ও ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পৈশাচিক হামলা, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও এবং দেশান্তরী হওয়ার ঘটনা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিলেও শুদ্ধি অভিযানের নামে গণহারে রোহিঙ্গা হত্যা নিপীড়ন-নির্যাতনের হিংস্র ছোবল থামছে না। প্রায় ২ মাস ধরে কত রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষ প্রাণ হারিয়েছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনও মেলেনি। তবে এ সংখ্যা যে অগণন তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। পক্ষান্তরে মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি সোমবার সর্বশেষ বক্তব্যে জানিয়েছেন রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর অনুমতি দেয়া হবে। উল্লেখ্য, গত দু’মাস ধরে শুদ্ধি অভিযানের নামে গণহারে রোহিঙ্গাদের হত্যার পাশাপাশি ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে হাজার হাজার অসহায় পরিবারকে পথে বসানো হয়েছে। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা দফায় দফায় ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য ও ত্রাণ তৎপরতা চালানোর উদ্যোগ নিয়েও অনুমতি না পেয়ে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় পালিয়ে থেকে অনাহারে অর্ধাহারে বহু রোহিঙ্গার প্রাণহানি ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও সাহায্য সংস্থার পক্ষ থেকে নানা বক্তব্য দিয়ে মিয়ানমার সরকারের আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও সবই যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কতিপয় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর সহিংসতার জন্য সংখ্যালঘু গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর দমন নিপীড়ন, হত্যা, গুম, নির্যাতন নেমে আসতে পারে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সকল রীতিনীতিই উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চলছে তা বিশ্ববিবেককে ভাবিয়ে তুললেও প্রতিকারের পথ যেন রুদ্ধ করে রেখেছে খোদ মিয়ানমার সরকার। ফলে রাখাইনে চলমান পুরো ঘটনাটি রোহিঙ্গাশূন্য করার সুগভীর নীলনক্সার অংশ হিসেবে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে। এদিকে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রাখাইনে গত প্রায় দুইমাস ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর শুদ্ধি অভিযানের নামে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার নির্যাতন নিপীড়ন বর্তমানে কিছুটা কমে এলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। এখনও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দফায় দফায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ হত্যা, গুম, নির্যাতন অব্যাহত রাখা হয়েছে। সেনা সদস্যদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলতে ব্যর্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় বহু রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে টেকনাফে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। টেকনাফের লেদা বস্তিতে (অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প) আশ্রয় নেয়া শাহ আলম নামে এক রোহিঙ্গা সোমবার সকালে মারা গেছে। গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গার মৃত্যু ॥ সোমবার সকাল দশটায় টেকনাফের লেদা ক্যাম্পের ‘এ’ ব্লকের ১০৬ নং কক্ষে শাহ আলম (৪৫) নামে এক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। নিহত শাহ আলম মিয়ানমারের মাঙ্গালা পাড়ার মৃত ছৈয়দুল আমিনের পুত্র। নিহতের খালাত বোন ফাতেমা খাতুন জানায়, ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মিয়ানমারের মাঙ্গালা গ্রামে এক দল রাখাইন সেনা ঢুকে শাহ আলমকে বাড়ি থেকে ধরে কিছুদূর নিয়ে গিয়ে তাকে বাঁ পাঁজরে গুলি করে ফেলে দেয়। তাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য ১৯ ডিসেম্বর ভোরে দমদমিয়া ঘাট দিয়ে অনুপ্রবেশ করে লেদা রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থান নেয়। রোহিঙ্গা নারী ফাতেমা আরও জানায়, লেদা রোহিঙ্গা বস্তিতে পূর্ব থেকে অবস্থান নেয়া আমার ছোট বোন রমিজা বেগমের ‘এ’ ব্লকের ১০৬ নং রুমে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়। লেদা রোহিঙ্গা বস্তির সভাপতি দুদু মিয়া জানান, মিয়ানমার থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আসা মাঙ্গালার শাহ আলমের মৃত্যুর বিষয়টি টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করা হয়েছে। ফাতেমার ভাষ্যমতে এঘটনায় মাঙ্গালা পাড়ায় অনেকে হতাহত হয়েছে। সেখানে চিকিৎসার অভাব ও বাহিনীদের হামলায় সর্বস্ব হারিয়ে অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গুলিবিদ্ধ শাহ আলমকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘এ’ ব্লকে ১০৬ নম্বর কক্ষে আশ্রিত নিহত শাহ আলমের ছোট বোন রমিজা বেগম জানায়, শাহ আলমের ৮ জন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজন সকলে এখনও মিয়ানমারে। ভাবী মাজুমা খাতুন সন্তান প্রসব করায় সঙ্গে আসতে পারেনি। খালাত বোন ফাতেমা বেগমকে নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এদিকে, সোমবার আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের রাখাইনে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর আউং সান সুচি। রাজধানী ইয়াঙ্গুনে এ বক্তব্য দেন সুচি। তিনি রাখাইনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেন এবং রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর অনুমতি দেয়া হবে বলেও জানান। আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সুচিকে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানের আহ্বান জানান।
×